বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনের বিদায়ের আগে ইউনিয়ন পরিষদের সপ্তম ধাপের নির্বাচনেও রক্ত ঝরিয়েছে। খুন, অস্ত্র প্রদর্শনী, মারামারি, রক্তাক্ত সংঘাত-সহিংসতার মধ্য দিয়ে আগামী বৃহস্পতিবার শেষ হচ্ছে সাড়ে চার মাস ধরে চলা সারা দেশের ইউপি নির্বাচন। সপ্তম ধাপের ভোটে গত সোমবার পর্যন্ত ১০১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। তাদের বেশির ভাগের মৃত্যু হয়েছে সংঘর্ষে, ধারালো অস্ত্রের কোপে, গোলাগুলি ও পিটুনিতে। ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু দেখেছে নরসিংদীর মানুষ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে সংঘাতে এই জেলায় ১১ জন নিহত হয়েছে। তাদের প্রায় সবাই গুলিতে নিহত হয়েছেন। নির্বাচনকেন্দ্রিক দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু বগুড়া জেলায়। পঞ্চম ধাপে নির্বাচনে এ জেলায় সাতজন নিহত হয়েছেন। গত সোমবার ভোটের দিন চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় দুজন এবং আগের দিন কুমিল্লার দেবীদ্বারে এক চেয়ারম্যান প্রার্থী প্রাণ হারিয়েছেন। নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। প্রশংসার চেয়ে নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসের অভিযোগের তীরই বেশি এই কমিশনের দিকে। এ কমিশনের সঙ্গী হচ্ছে সমালোচনা আর বিতর্ক।
এছাড়া সপ্তম ধাপের ইউপি নির্বাচনে এখন পর্যন্ত ৩৬৮ জন বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় এসব ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে ভোটের প্রয়োজন হয়নি। এর মধ্যে বেশকিছু ইউনিয়নে চেয়ারম্যানসহ কোনো পদেই ভোট নিতে হয়নি। সব মিলিয়ে এবার ইউপি নির্বাচনে বিনা ভোটে জনপ্রতিনিধি হওয়ার ক্ষেত্রে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এবার সাত ধাপে দেশে ৪ হাজার ১১৩টি ইউপিতে ভোট হয়েছে। এর মধ্যে ৩৬৮টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে ভোট দেয়ার সুযোগ পাননি সাধারণ মানুষ। এদিকে আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে বর্তমান কমিশনের শেষ ভোট। এ ভোটেও খুন, অস্ত্র প্রদর্শনী, মারামারি, সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানা গেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমান হুদা নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বিতর্কহীন কোনো ভোট তারা করতে পারেনি। তারা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল না। বুঝতেও পারে না তাদের কী দায়িত্ব। ওখানে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। ৪২ জন নাগরিক প্রেসিডেন্টের কাছে তাদের অসদাচরণের জন্য লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তাদের কোনো বিচার করতে পারেনি সরকার।
এসব প্রাণহানির ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দায় নেই বলে দাবি করেছেন ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ। সপ্তম বা শেষ ধাপের ইউপি ভোট গ্রহণ শেষে বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত নির্বাচন ভবনে ইসির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে এসে এমন দাবি করেন এ অতিরিক্ত সচিব। ইউপির সাত দফা ভোটে নির্বাচনী সহিংসতায় কতজন মারা গেছেন জানতে চাইলে সেই তথ্য এই মুহূর্তে নেই। এ ধাপের ভোটে নির্বাচনী সহিংসতায় দুজন মারা গেছেন। অতিরিক্ত সচিব বলেন, স্থানীয়ভাবে ভোটকেন্দ্রে গোলমালের জন্য ভোটকেন্দ্রের বাইরেই মারা গেছে বলে শুনেছি। পুরো প্রতিবেদনটি এখনো আমরা পাইনি। এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
শেষ ধাপের ভোটেও রক্ত ঝরল। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় গতকাল সোমবার ভোট গ্রহণকালে গোলাগুলি ও সংঘর্ষে দু’জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন কিশোর। তার নাম মো. তাসিব। সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। ভোটকেন্দ্রের বাইরে দাড়িয়ে ছিল ওই কিশোর। তখন তাকে প্রতিপক্ষ ভেবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত অপরজন বহিরাগত। তার নাম আবদুস শুক্কুর (৪০)। তিনি চট্টগ্রাম নগরের শুলকবহরের বাসিন্দা। বাজালিয়া ইউপিতে নৌকার প্রার্থী তাপস দত্তের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে বহিরাগত এই যুবক প্রতিপক্ষের গুলিতে মারা যান।
কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার ভানী ইউপিতে ভোট গ্রহণের আগের দিন গত রোববার স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর আত্মীয়ের লাথিতে আওয়ামী লীগের মনোনীত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মো. নুরুজ্জামান ভূঁইয়া মারা গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ওই ইউপির নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। এই তিনজনসহ সাত ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সংঘাত ও সহিংসতায় ১০১ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটল।
সপ্তম ধাপের ভোটে গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত ২৭টি ইউপির বেসরকারি ফলাফল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়লাভ করেছেন ১০টিতে, আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ ৫টিতে, স্বতন্ত্র হিসেবে জিতেছেন বিএনপির দুজন এবং স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন ১০ জন। এর আগে ষষ্ঠ ধাপ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা ২ হাজার ১৩৩টিতে এবং বিএনপি নেতারা ৩৩৮টিতে জয়লাভ করেছেন।
১০১ জনের মৃত্যু : মারামারি, সংঘাত-সহিংসতার মধ্য দিয়ে শেষ হলো সাড়ে চার মাস ধরে চলা ইউপি নির্বাচন। সাত ধাপের ভোটে গতকাল পর্যন্ত ১০১ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটল। তাদের বেশির ভাগের মৃত্যু হয়েছে সংঘর্ষে, ধারালো অস্ত্রের কোপে, গোলাগুলি ও পিটুনিতে। ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু দেখেছে নরসিংদীর মানুষ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে সংঘাতে এই জেলায় ১১ জন নিহত হয়েছে। তাঁদের প্রায় সবাই গুলিতে নিহত হয়েছেন। নির্বাচনকেন্দ্রিক দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু বগুড়া জেলায়। পঞ্চম ধাপে এ জেলায় সাতজন নিহত হয়েছেন।
নরসিংদীর দুই উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নে সহিংসতায় মোট ১১ জন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের সবাই মারা গেছেন গুলিবিদ্ধ হয়ে। সে সময় স্থানীয় লোকজন, রাজনীতিবিদ ও পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, কেন্দ্রীয় নির্দেশ অমান্য করে আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতার স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করা, চরাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা খুব একটা ভালো না থাকায় পুলিশের কম নজরদারি এবং অবৈধ অস্ত্র সহজলভ্য হওয়া এমন সহিংসতার অন্যতম কারণ।
নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু বগুড়ায়। এ জেলায় চতুর্থ ও পঞ্চম দফায় অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় সাতজন নিহত হন। এর মধ্যে ৫ জানুয়ারি ভোট গ্রহণের দিন ফলাফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গাবতলী উপজেলার একটি কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে পোলিং এজেন্টসহ চারজন, অন্য আরেকটি কেন্দ্রে ছুরিকাঘাতে একজন নিহত হন। এ ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় গাবতলী ও কাহালু উপজেলায় ছুরিকাঘাতে আরো দু’জন নিহত হন।
মারামারি ও সহিংসতাকে সঙ্গে করে প্রথম ধাপের ভোটের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় গত ২০ সেপ্টেম্বর থেকে। সেবার ৫ জন নিহতের ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয় ধাপে সবচেয়ে বেশি ৩০ জন নিহত হন, তৃতীয় ধাপে ২৬, তুর্থ ধাপে ১০, পঞ্চম ধাপে ২৩, ষষ্ঠ ধাপে ২ ও সপ্তম ধাপে ৫ জনসহ মোট ১০১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সপ্তম ধাপে গতকাল ১৩৮টি ইউপিতে ভোট গ্রহণের কথা থাকলেও ভোট হয়েছে ১৩৬টিতে। গত ৩১ জানুয়ারি ষষ্ঠ ধাপে ২১৯ ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গত ৫ জানুয়ারি পঞ্চম ধাপে ৭০৭টি ইউপিতে ভোট হয়। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর চতুর্থ ধাপে ৮৪০টি ইউপিতে, ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপে ১ হাজার ৭, ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে ৮৩৩, ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর দুই পর্বে প্রথম ধাপের ৩৬৯টিসহ মোট ৪ হাজার ১১১টি ইউপিতে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ভোট চলাকালে গত সোমবার দিনভর বিভিন্ন ইউনিয়নে গোলাগুলি, কোপাকুপি ও মারামারিতে দুজন নিহত ও অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে কাঞ্চনা ইউনিয়নে এক পুলিশ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশকিছু বহিরাগতও রয়েছেন। তারা বিভিন্ন ইউনিয়নে ভোটে প্রভাব বিস্তার করতে গিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সাত ধাপে ইউপি নির্বাচনে এখন পর্যন্ত ৩৬৮ জন বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় এসব ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে ভোটের প্রয়োজন হয়নি। এর মধ্যে বেশকিছু ইউনিয়নে চেয়ারম্যানসহ কোনো পদেই ভোট নিতে হয়নি। সব মিলিয়ে এবার ইউপি নির্বাচনে বিনা ভোটে জনপ্রতিনিধি হওয়ার ক্ষেত্রে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এবার সাত ধাপে দেশে ৪ হাজার ১১৩টি ইউপিতে ভোট হয়েছে। এর মধ্যে ৩৬৮টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে ভোট দেয়ার সুযোগ পাননি সাধারণ মানুষ।
সাত ধাপের প্রতিটি ধাপের নির্বাচনেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বিতর্কিত ব্যক্তিদের চেয়ারম্যানপ্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছে। পঞ্চম ধাপের নির্বাচনে হত্যা, ধর্ষণ, অর্থ ও চাল আত্মসাৎসহ চাঁদাবাজি মামলার অনেক আসামিকে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দিয়েছিল দলটি। পঞ্চম ধাপে আট জেলায় এমন ১৫ জন সম্ভাব্য চেয়ারম্যান প্রার্থীর খবর পাওয়া গিয়েছিল। এর আগে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে ১৯ জনকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছিল, যাদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, অর্থ ও চাল আত্মসাৎসহ নানা অভিযোগ ছিল। বিতর্কিত ব্যক্তিদের পাশাপাশি নির্বাচনকে ঘিরে বিতর্কিত কথাবার্তা বলেও সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কর্মীসমর্থকদের কেউ ক্রসফায়ারে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন, কেউবা একে-৪৭ রাইফেলের ভয় দেখিয়েছেন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা নানা উসকানিমূলক বক্তব্য দিলেও কারো বিরুদ্ধে সাংগঠনিক বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন