শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমছে

সুদের হার কম, টাকা তুলে নিচ্ছে গ্রাহকরা করযোগ্য আয় না হলেও কর দিতে বাধ্য হচ্ছেন

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০১ এএম

ব্যাংক আমানতের সুদহার কম। আবার সময়মতো গ্রাহককে অর্থফেরত না দেয়া, অনিয়মের কারণে দেউলিয়া হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মানুষ আস্থা হারিয়েছে। শেয়ার বাজার বা বন্ড মার্কেট দীর্ঘদিন পর কিছুটা আস্থা ফিরলেও অতীত অভিজ্ঞতাও বেশ নেতিবাচক। দেশে প্রবীণ, কর্মহীন বা দরিদ্র মানুষের জন্য ব্যাপক অর্থে কোনো সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। তাই সরকার অল্প আয়ের মানুষদের জন্য নিরাপদ সঞ্চয়ের সুযোগ হিসেবে সঞ্চয়পত্রে বাড়তি সুদে বিনিয়োগের সুযোগ রেখেছিল। যাতে প্রবীণ, কর্মহীন বা দরিদ্র মানুষ উপকৃত হন। এতে আগে মানুষ তুলনামূলকভাবে বেশি সঞ্চয়পত্র কিনেছে। কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে সকল ধরনের সঞ্চয়পত্রে সুদ হার কমানো এবং টিআইএন নম্বরসহ নানা নিয়ম-কানুন চালু করায় গ্রাহকরা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন। অনেকেই টাকা উত্তোলন করে নিচ্ছেন। এতে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ধারাবাহিকভাবে কমছে। অথচ বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রয়লব্ধ সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ঘাটতি অর্থায়নের জন্য বৈদেশিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো এবং অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থার উপর চাপ কমানোর ক্ষেত্রে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। জাতীয় সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ঘাটতি অর্থায়নের মূল্যস্ফীতি প্রভাবও কম নয়। এছাড়া, জাতীয় সঞ্চয় স্কিমে বিনিয়োগের মাধ্যমে মহিলা ও প্রবীণ ব্যক্তিরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে সামাজিক নিরাপত্তা লাভেরও ভুরিভুরি উদাহরণ রয়েছে। একই সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে আহরিত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে, যা দিয়ে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে।

এদিকে করযোগ্য আয় না হলেও কর দিতে বাধ্য হচ্ছেন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারী গ্রাহকরা। সঞ্চয়পত্র থেকে অর্জিত সুদের ওপর থেকে কর কেটে নেয়ায় এসব প্রান্তিক করদাতাদের বেশি পরিমাণ কর দিতে হচ্ছে। তবে আয় নির্বিশেষে সঞ্চয়পত্রে সুদের ওপর কর কেটে রাখার কারণে যারা বছরে ৩ লাখ টাকার চেয়ে কম উপার্জন করেন তাদেরকেও কর দিতে হচ্ছে যা প্রত্যক্ষ কর আদায়ের মূলনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। অবশ্য সঞ্চয়পত্রে সুদ হার কমানোর বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি হিসেবে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে, বেশ কিছুদিন থেকে প্রবীণ, কর্মহীন বা দরিদ্র মানুষের নিরাপদ সঞ্চয়ে কালো টাকার মালিকরা বিনিয়োগ করছেন। তাই এসব নিয়ম-কানুন চালু করা হয়েছে।

ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, পুঁজিবাজারের অবস্থা খুব একটা ভালো না, ব্যাংকে সুদ কম। সাধারণ মানুষ অন্য কোথাও বিনিয়োগ করতে পারছে না। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অংশ ডাকঘর স্কিম ও সঞ্চয়পত্র। সত্যিকার প্রবীণ, অবসরপ্রাপ্ত, কর্মহীন বা দরিদ্র মানুষ সঞ্চয়পত্রের এই সুবিধা ভোগ করেন। তাই এদের কথা চিন্তা করে হলেও কিছু নিয়ম-কানুন শিথিল করা প্রয়োজন বলে মনে করেন রাশিদুল ইসলাম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বরে ৭ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন গ্রাহকরা। একই সময়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ এসেছে ৭ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। অধিক মুনাফার আশায় ব্যাংকে আমানতের চেয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের প্রতি কয়েক বছর যাবৎ আগ্রহ বেশি ছিল গ্রাহকদের। গত সেপ্টেম্বরে সকল ধরনের সঞ্চয়পত্রে সুদ হার কমানোর ফলে বিনিয়োগ ধারাবাহিকভাবে কমছে।

ফলে গত ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রে ঋণের তুলনায় আগের ঋণের মূল ও মুনাফা পরিশোধ বেশি করেছে সরকার। এ সময় সঞ্চয়পত্র বিক্রির তুলনায় পরিশোধ ৪৩৬ কোটি টাকা, যা ১৮ মাস পর প্রথম। এর আগে অক্টোবরে গ্রাহকরা তুলেছেন ৭৯৫৬ কোটি। নভেম্বরে তুলেছেন ৮২৪০ কোটি টাকা। এ সময়ে সঞ্চয়পত্র কিনেছেন যথাক্রমে ৮৭২২ এবং ৮৯৪১ কোটি টাকা। তিন মাসেই বিনিয়োগের তুলনায় গ্রাহকদের টাকা উত্তোলন ধারাবাহিকভাবে কমেছে।

এর আগে সরকারের সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও পরিশোধ নিট ঋণ নেগেটিভ অবস্থানে গিয়েছিল ২০২০ সালের এপ্রিলে। ওই মাসে সরকার সঞ্চয়পত্রের মোট বিনিয়োগের তুলনায় ৬২২ কোটি টাকা বেশি মূল ও মুনাফা পরিশোধ শেষে নিট ব্যয় করেছিল।
চলতি অর্থবছরের আগস্টে সরকারের সঞ্চয়পত্রে নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৬২৮ কোটি টাকা। এক মাস পর সেপ্টেম্বরে নিট ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে ২৮২৫ কোটি টাকা, অক্টোবরে এসে ব্যাপক কমে নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৬৬ কোটি টাকা। সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে নভেম্বরেও। নভেম্বরে নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ৭০১ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে এসে একটাও নিট ঋণ না নিয়ে পরিশোধ বেশি করেছে ৪৩৬ কোটি টাকা।

সঞ্চয় অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, গেল বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে ১ শতাংশ এবং ৩০ লাখ থেকে ৪৫ লাখ টাকা বা এর বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেয় সরকার।

এদিকে সঞ্চয়পত্র থেকে অর্জিত সুদের ওপর থেকে কেটে নেয়া কর অন্য ধরনের আয়ের সঙ্গে সমন্বয় করা যায় না। ফলে প্রান্তিক করদাতাদের বেশি পরিমাণ কর দিতে হচ্ছে। কর বিশ্লেষক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যদি সঞ্চয়পত্রের সুদ থেকে অর্জিত আয়ের সঙ্গে অন্যান্য আয়কে সমন্বয় করার সুযোগ দিতো, তাহলে প্রান্তিক করদাতারা উপকৃত হতেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি জানান, যদি একজন করদাতার বার্ষিক আয় ৪ লাখ টাকা হয় এবং এর মধ্যে ১ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্রের সুদ থেকে আসে, তাহলে বর্তমান নীতি অনুযায়ী তিনি এই আয়কে অন্য আয়ের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারবেন না এবং ফলশ্রুতিতে তাকে অতিরিক্ত কর দিতে হবে। এনবিআর যদি সমন্বয়ের সুযোগ দিতো, তাহলে সেই ব্যক্তিকে শুধুমাত্র ৫ হাজার টাকা কর দিতে হতো। কিন্তু এ ধরনের বিধান না থাকায় তার করের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে ১০ হাজার টাকা হচ্ছে। তিনি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে অতিরিক্ত করের বোঝা থেকে রেহাই দেয়ার ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন।

ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি সৈয়দ ইকবাল মোস্তফা বলেছেন, অনেক পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদ থেকে পাওয়া আয়ের ওপর নির্ভরশীল। এটি নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য অনেক বড় বোঝা।
এনবিআর’র আয়কর নীতির সাবেক সদস্য ড. সৈয়দ মো. আমিনুল করিম বলেছেন, ফাইনাল সেটেলমেন্টের নীতি করযোগ্য আয় নেই এরকম মানুষের জন্য বোঝাস্বরূপ। তিনি বলেন, এটি একটি রিগ্রেসিভ করে পরিণত হচ্ছে। যাদের কোনো করযোগ্য আয় নেই (সঞ্চয়পত্র ছাড়া) তাদের জন্য কর ফেরতের ব্যবস্থা করা উচিত। রিগ্রেসিভ কর হচ্ছে এমন এক ধরণের কর, যেটি সবার জন্য একই হারে প্রযোজ্য হয়। এক্ষেত্রে উচ্চ আয়ের মানুষদের চেয়ে নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছ থেকে তুলনামূলকভাবে বেশি হারে কর কেটে নেয়া হয়। তাই কর কর্তৃপক্ষের উচিত হবে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত আয় সমন্বয়ের সুযোগ তৈরি করা।
সূত্র মতে, বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য রয়েছে। বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের পুরো সময়ে (জুলাই-জুন) সঞ্চয়পত্র থেকে ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা নিট ঋণ নেয় সরকার। যেখানে গত অর্থবছরে মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের শেষদিকে এ খাতের ঋণ বেড়ে যাওয়ায় সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৩০ হাজার ৩০২ কোটি টাকা করা হয়। ওই অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার অনেক বেশি ঋণ আসায় চলতি অর্থবছরে এ খাতের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। তবে গত সেপ্টেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগের অঙ্কের ওপর ভিত্তি করে সরকার মুনাফার হার পুনঃনির্ধারণ করায় এ খাতের বিনিয়োগ আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।

গত ২১ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকলে মুনাফা কমিয়ে আনার কথা বলা হয়। ওই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী এখন থেকে কোনো বিনিয়োগকারী সঞ্চয়পত্রে প্রথম ১৫ লাখ টাকার বিনিয়োগের ওপর আগের হারেই মুনাফা পাবেন। ১৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে মুনাফার হার ১ শতাংশ কমবে। ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করলে ওই বিনিয়োগের মুনাফার হার ২ শতাংশ কমবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন