মহামারি করোনার কবলে পড়ে দীর্ঘ ৫৪৪ দিন প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বন্ধ ছিলো। বন্ধের কারণে ছিটকে পড়েছে অসংখ্য শিক্ষার্থী। আবার হতাশায় আত্মহত্যা করেছে কেউ কেউ। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, গ্লোবালাইজেশনের যুগে শিক্ষাঙ্গনে সেশনজট কোনোভাবেই মেনে নেয়ার নয়। সেশনজট শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে কেড়ে নিচ্ছে সব চেয়ে মূল্যবান সম্পদ ‘সময়’। সেই সাথে কেড়ে নেওয়া শুরু করেছে মানুষের অমূল্যবান সম্পদ জীবনও। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন। সংস্থাটির তথ্যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পর গত দেড় বছরে অন্তত ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে ৭৩ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ৪২ জন বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজ শিক্ষার্থী ও ৯ জন মাদরাসার শিক্ষার্থী। এদের বেশির ভাগের বয়স ১২ থেকে ২০ বছরের মধ্যে।
করোনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ বেড়েই চলেছে। পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, পরিবারের শাসন, কোনো কিছু বায়না ধরে না পাওয়া, আর্থিক সংকট, পরিবারের অনটন, বিষণ্নতা ও একাকিত্বসহ ছোট ছোট সমস্যায়ও অনেকে নিয়ন্ত্রণ হারা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে প্রায় দেড় বছর হারিয়ে গেছে। এই দেড় বছর হারিয়ে যাওয়া মানে একজন শিক্ষার্থী দেড় যুগ হারিয়ে ফেলেছে। মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো শিক্ষা জীবন। এই জীবনের তৎপরতার উপর ভবিষ্যৎ জীবন দাঁড়ায়। তাই এই জীবনে সময় নষ্ট হওয়া কোনোভাবেই মেনে নেয়ার নয়। মহামারির বাস্তবতা আমাদের মেনে নিতেই হবে। তাই উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করার পর অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০২০ সালের মে থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা ও জুলাই থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় ডিভাইসের অভাব, দুর্বল ও ধীরগতির ইন্টারনেট সংযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তির উচ্চমূল্যের কারণে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পক্ষে অনলাইনে ক্লাস করা সম্ভব হয়নি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নতুন ব্যাচের ভর্তিও পিছিয়ে আছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোয় অন্তত ৫০০ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছিলো। ২০২০ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠান খুললেও করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ফের জানুয়ারি ২০২২ এর ২১ তারিখ থেকে পুনরায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়, যা ক্রমবর্ধমান হারে আগের মতো বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠান পুনরায় বন্ধ হওয়ায় শিক্ষার্থীরা উদ্বেগ প্রকাশ করছে। পড়াশোনায় বুঝি আবারও ঘটল ছন্দপতন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার তারিখ নিয়ে ছেলেখেলা চলছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলমান ও ঘোষিত পরীক্ষা ব্যতীত অন্যান্য পরীক্ষা না নেয়ার সীদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ক্লাস শেষ হলেও পরীক্ষার তারিখ অঘোষিত থাকায় পরীক্ষার হলে বসতে পারছে না।
এভাবে দিনের পর দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা শিক্ষাবিদগণের দৃষ্টিতে ঠিক নয়। ২১ জানুয়ারি যে ৬টি নির্দেশনা জারি করে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয় তার ৩ নম্বর নির্দেশনায় বলা হয়: রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ১০০ জনের বেশি যোগদান করতে পারবে না। আর যারা অংশগ্রহণ করবে তাদের ভ্যাকসিন সনদ থাকতে হবে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে ১০০ জনের বিধি চালু থাকলে তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও চালু করা জরুরি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্লাস রুমে শিক্ষার্থীর আসন সংখ্যা ৬০-৮০। সরকার চাইলে জোড়বেজোড় রোল বিভাজন করে একদিন পর একদিন স্বশরীরে ক্লাস নেয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। দেশের সবচেয়ে সচেতন মহল হলো শিক্ষার্থী সমাজ। বোধকরি, করোনার অজুহাতে ঘরবন্দী করার পাঁয়তারা চলছে। এদিকে মেলা, হাটবাজার, কলকারখানা, নির্বাচনসহ সবকিছুই দিব্যি চলছে। ব্যতিক্রম শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দিনের পর দিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা করোনায় না মরে হতাশায় মরছে। সরকার বারবার অনলাইন ক্লাসের কথা বললেও তা তেমন কোনো উপকার বয়ে আনেনি। অনেকাংশে শিক্ষকরা নিজেরাই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে অপারগতা প্রকাশ করছে। বাস্তবিক জটিলতায় শিক্ষার্থীরা চাইলেও অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হয়ে ক্লাসের উপকারিতা লাভ করতে পারছে না। ফলে অনলাইন ক্লাস নামমাত্র ক্লাসে পরিণত হয়েছে। অনলাইনে ক্লাস নেয়ার ব্যবস্থা করা হলেও পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রথম দিকে ক্লাসে উপস্থিতির নম্বর না থাকার কথা ঘোষণা দিলেও শিক্ষকরা সেকথা রাখেননি। বরং নিজের পছন্দের তালিকামত শিক্ষার্থীদের নম্বর দিয়েছেন।
এদিকে ডেল্টা, ওমিক্রন, ফ্লোরোনা, ইহুর পর নিওকভ নামক নতুন ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে উহানের বিজ্ঞানীরা এই নতুন ভ্যারিয়েন্টের কথা জানিয়ে বলেছেন, করোনা ভাইরাসের যতগুলি ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে, তার মধ্যে নিওকভ সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। গবেষকদের মতে, এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন মৃত্যুবরণ করার আশঙ্কা রয়েছে। করোনা ভাইরাস বারবার নতুন নতুন রূপ ধারণ করছে। পৃথিবী থেকে আপাতত করোনা চলে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা যেহেতু নাই, সেহেতু করোনার সাথে পাল্লা দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা সমীচীন নয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন করোনা মোকাবেলায় ঔষধ আবিষ্কারে ব্যস্ত বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বারান্দায় তখন ধুলোবালি ও ঘাস জন্মেছে।
সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট নিরসনের বিবিধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট নিরসন সম্ভব হয়নি। অধিকাংশ বিশ্বদ্যিালয়ে আগে থেকেই সেশনজট লেগে আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কতেক বিভাগে ৪ বছর মেয়াদী অনার্স সম্পন্ন করতে কমপক্ষে সময় লাগে ৬-৭ বছর, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর চেয়েও বেশি। তারপর আবার মাস্টার্স। একটি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ মাসের সেমিস্টার শেষ করতে ১০/১১ মাস সময় লাগে, ৪ বছরের কোর্স সম্পন্ন করতে ৬/৭ বছর লাগে, বিষয়টি ভাবতেও অবাক হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে করোনার কারণে আবার নতুন মাত্রায় সেশনজট যুক্ত হলো। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার অনুমতি থাকলেও পরীক্ষা গ্রহণ পূর্বক সেশনজট নিরসন করার কোনো উদ্যোগই দেখা যাচ্ছে না। ফলে চার বছরের অনার্স শেষ করতে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮/৯ বছর লেগে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’র শামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এহেন অবস্থার দরুন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আজ রসাতলে।
বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২.৬ বছর। কিন্তু এই ক্ষণিক জীবনের বৃহদাংশই যদি শিক্ষার্জন ও শিক্ষার্থী হিসেবে কেটে যায় তাহলে শিক্ষার্থী তার বাকি কাজ কখন করবে? শিশু শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা শেষ করতে সময় লাগে প্রায় ১৩/১৪ বছর, স্নাতক (পাস ও অনার্স) সম্পন্ন করতে সময় লাগে ৬/৭ বছর, স্নাতকোত্তরে সময় লাগে আরো ১.৫/২ বছর। সব মিলিয়ে মাস্টার্স পাস করতে সময় লাগে ২৫/২৬ বছর। ৫ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে প্রায় ২৬-২৮ বছর বয়স সময় লাগে। বাংলাদেশের চাকরির বাজার আজব প্রকৃতির। এখানে শিক্ষার্থীর নির্ধারিত বিষয়ের উপর মূল্যায়ন না করে তার বিপরীতধর্মী পড়াশোনার মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করে চাকরি দেয়া হয়। আমরা জানি, বাংলাদেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্র বয়সের সময়সীমা ৩০ বছর। তাহলে কখন পড়াশোনা শেষ করবে আর কখন চাকরির প্রস্তুতি নিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করবে?
এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীর কোন শ্রেণি কত বছরে সম্পন্ন করতে হবে তা সরকারের নির্ধারণ করে দেয়া জরুরি। বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নতুন করে ভাবতে হবে। ইউজিসি ও সরকারকে বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করে সমাধানের পন্থা বের করতে হবে। নচেৎ এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ সার্টিফিকেটধারী মূর্খের দেশে পরিণত হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন