রমজান শুরুর আরো দেড় মাস বাকি। অথচ এই ফাল্গুন মাস শুরুতেই নিত্যপণ্যের বাজারে যেন আগুন লেগে গেছে। প্রতিটি পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে- চাল, ডাল, তেল, মাছ, গোশত, সবজিসহ প্রতিটি পণ্যমূল্য। বাধ্য হয়েই গরুর গোশতের বদলে একটু কম দরে খাসির মাথা, মুরগির বদলে বয়লারের খুচরো গোশত, ছাগল-ভেড়ার পা, মুরগির হাড়-গলা-গিলা-কলিজির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাওয়া হাজারো নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত। সবজির ভরা মৌসুমে সংসারের চাহিদা মতো তরিতরকারি ক্রয়ের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছেন অনেক ভোক্তা। অথচ সরকারের দায়িত্বশীলদের দাবি বাজার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে; পণ্যমূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
গতকাল রংপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘অসৎ উপায়ে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করা হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তেল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি করতে হয়। ৯০ শতাংশ তেল বাইরে থেকে আসে। আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভর করে তেলের দাম ওঠা-নামা করে। প্রতি সপ্তাহে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ছে। সেসঙ্গে কন্টেইনার ভাড়াও বেড়েছে। পেঁয়াজের দাম এখন কমে গেছে। কৃষকরা দাম পাচ্ছেন না। প্রতি কেজি পেঁয়াজ উৎপাদনে কৃষকদের খরচ ১৮ থেকে ২০ টাকা। সেখানে বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়। রংপুর সার্কিট হাউস মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী যখন ২৫ টাকা দরে পেঁয়াজ বিক্রির দাবি করেন; তখন তার সংবাদ সম্মেলনস্থল থেকে কয়েকগজ দূরে রংপুর সিটি কর্পোরেশন মার্কেটে ৫০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছিল।
বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর গতকাল শুক্রবার ‘কমন’ খবর ছিল বাজারদর। সবগুলো চ্যানেলের রিপোর্টার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে গিয়ে সরেজমিন সরাসরি বাজারের পণ্যমূল্যের চিত্র তুলে ধরেন। ওই সব খবরে ক্রেতা ও বিক্রেতার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হয়। এসব প্রতিক্রিয়ায় বাজারে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের নিদারুণ কষ্ট-দুঃখ ও যন্ত্রণার চিত্র উঠে আসে। বেশির ভাগ ক্রেতাই পণ্যমূল্য নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে নিজেদের অসহায়ত্ব তুলে ধরেন। আর বিক্রেতারা বলছেন, আড়ত ও পাইকারি বাজার থেকে বেশি দামে পণ্য কিনে তাদের বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। পাইকারি বিক্রেতাদের বক্তব্য- বগুড়ায় যে আলু ৫ টাকা কেজি, সেটা ঢাকায় নিয়ে আসতে পরিবহন খরচ ও চাঁদা দিয়ে ১২ টাকা থেকে ১৫ টাকা কেজি দর পড়ে যায়। বাধ্য হয়েই তাদের লাভ রেখেই পণ্য বিক্রি করতে হয়।
কারওয়ান বাজারের এক ব্যবসায়ী জানান, রংপুর থেকে একটি ট্রাক রাজধানী ঢাকায় পৌঁছতে ১০ থেকে ১৫ পয়েন্টে চাঁদা দিতে হয়। সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ হলে এমনিতেই সবজির দাম কমবে। মোহাম্মদপুর বাজারে সবজি কিনতে আসা মেহেরুন নেছা নামের একজন গৃহিণী অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বললেন, বাজারে কোনো পণ্যই আমাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নেই। সংসারে যে পণ্যের চাহিদা তার চেয়ে অর্ধেক পণ্য কিনে বাসায় ফিরতে হয়। কারণ প্রতিটি পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই অর্ধেক পণ্য কিনতে হচ্ছে। হাতিরপুল বাজারে আবদুর রহিম নামের এক ক্রেতা বললেন, বাচ্চারা মাছ ছাড়া ভাত খেতে চায় না। কিন্তু মাছ আর সবজি কেনার সামর্থ নেই। সন্তানদের খেতে দিতে না পারার নীরবে চোখের পানি ফেলছি। কিন্তু দেখার যেন কেউ নেই। হালিম উদ্দিন নামের এক ক্রেতা জানান, গরুর গোশতের দাম বেড়ে যাওয়ায় তিনি ঘাসির মাথা ক্রয় করে সংসারে গোশতের জোগান দিচ্ছেন। খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, চালের দাম আরো বাড়লে বিদেশ থেকে আমদানি করা হবে।
মেহেরুন নেছা, হালিম উদ্দিন আর আবদুর রহিম নয়, রাজধানীতে বসবাস করেন এমন হাজার হাজার মানুষ পণ্যমূল্যের সঙ্গে পকেটের অবস্থা মেলাতে না পেরে অর্ধেক পণ্য কিনে ঘরে ফিরছেন। আর ডিজিটাল বাংলাদেশের উন্নয়নের জোয়ারের মধ্যে সংসারে খাবার জোগান দিতে না পারার গ্লানিতে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন। লাখ লাখ মানুষের এই বোবা কান্না দেখার যেন কেউ নেই।
প্রতিদিন বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। রাজধানীর বাজারগুলোতে প্রতিটি পণ্যের প্রচুর সরবরাহ। সঙ্কট না থাকলেও তিন দিনের ব্যবধানে খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকা। দুই দিনের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ১০ টাকা এবং এক দিনের ব্যবধানে ডিম ডজনে ৫ টাকা বেড়েছে। এক সপ্তাহ ব্যবধানে সব ধরনের সবজির দাম কেজিতে বেড়েছে ৫ থেকে ২০ টাকা। চাল, ডাল, তেল, চিনির দাম তো আগেই বেড়েছে। দাম বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেশি দামে পণ্য কিনে আনতে হচ্ছে। তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। দাম শুনে অনেক ক্রেতা রাগারাগি করেন। তবে কিছু করার নেই। বাজার ঘুরে শেষ পর্যন্ত তারা ঠিকই কিনে নেন। যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ায় বাজার করতে আসা মো. হোসেন আলী বলেন, বাজারে কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় প্রতিদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। বাজারে এখন কোনো কিছুই নিম্নবিত্তের নাগালে নেই। মাছ, মাংস, চাল, ডাল, তেল, সবজি, পেঁয়াজ সব কিছুরই দাম বাড়তি। মুন্সিগঞ্জে যে সবজি ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে; সেটাই রাজধানীতে ৬০ টাকা থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর কয়েকটি কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেল, গরুর গোশতের দোকানের চেয়ে ভিড় বেশি খাসির মাথা ও কলিজির দোকানো। মুরগির দোকানের চেয়ে ভিড় বেশি মুরগির পা-চামড়া ও পিছ করে কেটে বিক্রি করে মুরগির দোকানে। যারা এসব দোকানে ভিড় করছেন তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা কথা বলতেও বিব্রতবোধ করেন; কারণ অস্বাভাবিকভাবে দাম বেড়ে যাওয়ায় গরুর গোশত বা মুরগি ক্রয়ের মতো আর্থিক সামর্থ তারা হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে গরুর গোশতের বদলে গাসির মাথা এবং মুরগির বদলে কম দামে ফার্মের কাটা মুরগির গোশত কিনে সংসারের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছেন।
রাজধানীর বাজারগুলোতে মূলত ২০০ থেকে ২৫০ টাকার নিচে কোনো মাছ নেই। ভালো মাছ ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি। ১৭০ টাকা কেজি ব্রয়লার মুরগি, ৬৫০ টাকা কেজি গরুর গোশত, ১০০০ টাকা কেজি খাসির গোশত বিক্রি হচ্ছে। ১৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি। লাল লেয়ার মুরগি ২৬৫ থেকে ২৭০ টাকা, সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ২৯০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ভরা মৌসুম থাকলেও চড়া সবজির বাজার। ছিমের মতো সবজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে। মোটা চালের কেজি ৫২ টাকা, সয়াবিন তেলের লিটার ১৬৫ থেকে ১৬৮ টাকা। অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামও বাড়ন্ত। বাজারের এমন পরিস্থিতিতে অনেকটা অসহায় নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ। কিছু দাম কমানোর আশায় এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ঘুরে ঘুরে হয়রান তারা। রাজধানীর কয়েকটি পাইকারি ও খুচরা মাছ, সবজি, মুদি বাজার ঘুরে এমন পরিস্থিতিই দেখা যায়। আবার পাইকারি বাজারেই এমন বেশি দামে হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা যায় অনেককে।
সরেজমিনে ফকিরাপুল মার্কেটের মাছ ও সবজির বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি বড় রুই মাছ ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, মাঝারি রুই মাছ ২৫০ থেকে ২৭০ টাকা, ছোট কাতল মাছ ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, বড় কাতল ৪০০ টাকা, বড় পাঙাশ মাছ ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা, আকার ভেদে ইলিশ মাছ ৭০০ থেকে ১২০০ টাকা, সিলভার কার্প মাছ ২০০ টাকা, বোয়াল ৫০০ টাকা, কালিবাউশ ৩৫০ টাকা, ফালি মাছ ৪৫০ টাকা, আইর ৬০০ টাকা, বড় কৈ ৬০০ টাকা, বেলে ৪৫০ টাকা, শিং ৮৫০ টাকা, চিংড়ি মাছ ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়াও ছোট মাছের মধ্যে চিংড়ি ৩০০ টাকা, কাচকি ৪৫০ টাকা, মলা ৩০০ টাকা, টাটকিনি ২৫০ টাকা, পাবদা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, গলদা চিংড়ি আকার ভেদে ৬৫০ থেকে ৭৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। সামুদ্রিক মাছের মধ্যে বড় সুরমা মাছ ৩০০ টাকা, রূপচাঁদা ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, লাল কোরাল ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা ও বাটা মাছ ২০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে মাছ বাজার কিছুটা চড়া জানিয়ে শহিদ উল্লাহ নামে মাছ বিক্রেতা বলেন, বাজারে পর্যাপ্ত মাছের সরবরাহ থাকার পরও খাবারের দাম ও জ্বালানি খরচ বেশি হওয়ায় বাজারে এর প্রভাব পড়ছে। শুধুমাত্র হোটেলগুলোতেই বড় মাছ বিক্রি হচ্ছে। খুব কম সংখ্যক সাধারণ মানুষই বড় মাছ কিনছে। যারা দুই কেজি কিনতেন, তারা এখন এক কেজি কিনছেন। কেউ কেউ কমদামি মাছের দিকে ছুটছেন।
অপরদিকে বাজারে শাক সবজির পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও চড়া সবজির বাজার। টমেটো ৪০ টাকা, গোল বেগুন ৮০ টাকা থেকে একশ টাকা, লম্বা বেগুন ৭০ টাকা, করলা ৮০ থেকে টাকা, শিম ৫০ থেকে ৮০ টাকা, কাঁচা পেঁপে ৫০ টাকা, শসা ৩৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা, গাজর ৩০ টাকা, ফুলকপি ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা, বরবটি ১০০ টাকা, চিচিঙ্গা ৮০, পেঁয়াজ ৫০ থেকে ৫২ টাকা, কাঁচামরিচ ৬০ টাকা, রসুন ১১০ থেকে ১২০ টাকা, গোল আলু ২০ টাকা, দেশি আদা ৭০ থেকে ৮০ টাকা, পটল ২০০ টাকা, সজনে ডাটা ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও লাউ ৯০ থেকে ১০০ টাকা, ব্রুকলি, ফুলকপি, পাতা কপি ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে।
মুদি পণ্যের মধ্যে মুগডাল ১২৫ টাকা, বুটের ডাল ৮০ টাকা, এংকর ডাল ৪৫ টাকা, মসুর ডাল ১১৫ টাকা, ছোলা ৭৫ টাকা, খোলা চিনিগুড়া চাল ৯০ থেকে ১০০ টাকা, মিনিকেট চাল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, নাজিরশাইল চাল ৭০ থেকে ৭২ টাকা, চিনি ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। কয়েকজন ক্রেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। সংসার চালানো খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা হিমশিম খাচ্ছি। সবকিছুর দাম এভাবে বাড়তে থাকলে চলার উপায় থাকবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন