শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আন্তর্জাতিক সংবাদ

মুসলমানদের একত্রিত করাতে তৈরি যে রেলপথ

দ্য হিজাব রেলওয়ে

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০০ এএম

জর্দানের রাজধানী আম্মানের ধূলিধূসরিত প্রধান সড়ক দিয়ে চলার সময় হয়তো হিজাব রেলওয়ে স্টেশন আপনার চোখে পড়বে না। সেখানে যাওয়ার জন্য আপনাকে শহরের ভেতরের সর্পিল পথ দিয়ে বেশ কিছুটা যেতে হবে। আম্মান শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্র, পর্বত আর দুর্গকে কেন্দ্র করে তৈরি করা সেসব রাস্তা গোলকধাঁধার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
শহর থেকে হিজাব রেলওয়ে স্টেশনের দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার হলেও আম্মানের ট্রাফিক জ্যামের কারণে সেখানে পৌঁছোতে প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই সময় লাগে। পাথর দিয়ে তৈরি রেলওয়ে স্টেশনের প্রবেশ তোরণ দিয়ে ভেতরে ঢোকার সাথে সাথেই আপনার মনে হবে আপনি হঠাৎ ভিন্ন একটু যুগে, অথবা ভিন্ন এক পৃথিবীতে এসে পড়েছেন। এখানে এখনো স্টিম ইঞ্জিন বা বাষ্পীয় ইঞ্জিন চালিত ট্রেন চলে। এই রেল লাইন মুসলিম বিশ্বকে একত্রিত করবে - যারা এটি তৈরি করেছিলেন তারা এমনটাই প্রত্যাশা করেছিলেন। মক্কা নগরীতে সহজে এবং নিরাপদে সফর করার উদ্দেশ্যে ১৯০০ সালে ‘দ্য হিজাব রেলওয়ে’ প্রকল্প শুরু করেছিলেন দ্বিতীয় আবদুল হামিদ, যিনি ওসমানিয়া সালতানাতের (বর্তমান তুরস্ক) সুলতান ছিলেন। তার আগ পর্যন্ত উটের কাফেলায় কয়েক সপ্তাহ ধরে মক্কায় সফর করতেন মুসলিম পূণ্যার্থীরা। সেসময় দামেস্ক থেকে মক্কায় পৌঁছাতে অন্তত ৪০ দিন সময় লাগতো। যাত্রা পথে শুষ্ক মরুভূমি আর পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে গিয়ে কাফেলার বহু যাত্রীর মৃত্যু হত। রেলওয়ে প্রতিষ্ঠার পরে এই ৪০ দিনের যাত্রা নেমে আসে মাত্র পাঁচ দিনে।
এই প্রকল্পের অধীনে রেলওয়ে লাইনের দামেস্ক-মদিনা অংশ তৈরি হয়ে যাওয়ার পর তৎকালীন কনস্টান্টিনোপোল পর্যন্ত রেল লাইন তৈরির কাজ শুরু হয়, যা উত্তরে অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী থেকে দক্ষিণে মক্কা নগর পর্যন্ত যোগাযোগের রাস্তা তৈরি করে। তবে ইসলামে এই রেল প্রকল্পের তাৎপর্য কিন্তু স্রেফ এতটুকুই নয়। এই প্রকল্পটি যখন বাস্তবায়ন করা হচ্ছিল, তখন এটি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের পুরোটাই জোগাড় হয় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মুসলিমদের অনুদান, অটোমান সালতানাতের আয় ও নাগরিকদের করের টাকায়। প্রকল্পটি তৈরির সময় বিদেশি কোনো বিনিয়োগ বা সহায়তা নেয়া হয়নি।
আর এই কারণেই আজ পর্যন্ত এই রেলপথটিকে ‘ওয়াকফ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ‘ওয়াকফ’ এমন সম্পত্তি যেটিতে বিশ্বের সব মুসলমানের অধিকার আছে। জর্দানে হিজাব রেলওয়ের মহাপরিচালক জেনারেল উজমা নালশিক বলেন, ‘এটি কোনো দেশ বা কোনো ব্যক্তির সম্পদ নয়। এটি বিশ্বের প্রত্যেক মুসলিমের সম্পদ। এটি মসজিদের মত এমন এক সম্পদ যা বিক্রি করা যায় না।’ ‘বিশ্বের যে কোনো দেশের মুসলমান এখানে এসে দাবি করতে পারেন যে, এই সম্পদে তার অংশ রয়েছে’, বলেন উজমা নালশিক। সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের জন্য এই রেলওয়ে প্রকল্পের ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি রাজনৈতিক গুরুত্বও ছিল। ঐ প্রকল্প শুরুর আগের কয়েক দশকে প্রতিপক্ষ শক্তিগুলো তুরস্কের আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে তাদের প্রভাব বিস্তার করা শুরু করে। তিউনিসিয়া দখল করে নেয় ফ্রান্স, মিসরে আগ্রাসন চালায় ব্রিটিশরা। সেই সাথে রোমানিয়া, সার্বিয়া আর মন্টেনেগ্রো স্বাধীনতা লাভ করে।
ওসমানিয়া সালতানাতের মানুষকে একত্রিত করার মাধ্যমে শুধু বিশ্বের মুসলিমদেরই নয়, সালতানাতকেও একত্রিত করার চেষ্টা করেছিলেন সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ। তবে তার সেই প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। ১৯০৮ সালে দামেস্ক থেকে মদিনায় প্রথম ট্রেন যাত্রা শুরু হয় এই রেলপথে, আর তার পরের বছরই সুলতান ক্ষমতাচ্যুত হন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ওসমানিয়া সালতানাত সুদূর অতীতের বাস্তব। এই রেলপথটি এখন পাঁচটি দেশের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করে (তুরস্ক, সিরিয়া, জর্দান, সউদী আরব ও ইসরাইল)। ১৯১৪ সাল পর্যন্ত বছরে তিন লাখ যাত্রীকে সেবা দিতো হিজাব রেলওয়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই রেলওয়ে তৈরির এক দশক পর্যন্তই সেটিকে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুরস্কের সেনাবাহিনী যখন এই রেলপথটি ব্যবহার করা শুরু করে তখন এটি ব্রিটিশ অফিসার টিই লরেন্স (যাকে ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’ খেতাব দেয়া হয়) এবং বিদ্রোহী আরব যোদ্ধাদের আক্রমণের শিকার হয়। যুদ্ধের পর যখন ব্রিটিশ ও ফরাসীরা পূর্ব ভূমধ্যসাগরের লেভান্ত অঞ্চল পুনর্দখল করে, তখন তাদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল এই রেলওয়ে লাইন পুনর্র্নিমাণ করা। ফলে, সেসময় রেল লাইনের একটা বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বর্তমানে আম্মানের মূল ট্রেন স্টেশনে ‘রঙিন, কিন্তু নীরব’ বাষ্পীয় রেল ইঞ্জিন অলস দাঁড়িয়ে থাকে। এখানকার জাদুঘরে এই রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট নানাবিধ জিনিস - যেমন পুরনো টিকিট, ছবি, ট্রেনের বাতি - রয়েছে। বিলাসবহুল ভেলভেট চেয়ার আর সোনালী রংয়ের বাতি দিয়ে সাজানো বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকের একটি ট্রেনের বগি এখনো সেই সময়ের ঐশ্বর্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই রেল লাইন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পণ্ডিত শেখ আলী আতানতাভি লিখেছিলেন, ‘হিজাব রেলওয়ের গল্পটা আসলেই ট্র্যাজিক। সেখানে লাইন আছে কিন্তু কোনো ট্রেন চলে না, স্টেশন আছে কিন্তু যাত্রী নেই।’ তবে এই রেলওয়ের গল্প কিন্তু শুধু ভুল আর হতাশার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সময়ের সাথে সাথে এই রেলওয়ের কিছু কিছু অংশ নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে। ২০১৬ সালে এই রেলওয়ের হাইফা থেকে বেইত শিয়ন পর্যন্ত পুনর্নির্মিত অংশে রেল চলাচল শুরু করে ইসরাইল। ২০১১ সালে আম্মান থেকে দামেস্ক পর্যন্ত যখন এই ট্রেন চলতো তখন তা স্থানীয়দের কাছে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সে সময় ‘সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে’ সিরিয়া যাওয়ার বেশ জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছিল।
এই রেলওয়ে ট্র্যাক বর্তমানে মূলত পর্যটন আর বিনোদনের জন্য ব্যবহৃত হলেও হিজাব রেলওয়ে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে আশা রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। প্রতিদিন যারকা থেকে আম্মানের মধ্যে ৩০ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দেন ছয় লাখ মানুষ। এই রেলপথের জর্ডান অংশের মহাপরিচালক উজমা নালশিক বলেন, যাত্রীদের যাওয়া-আসার চাহিদা থাকলেও এখানে খুব কম সংখ্যক গণ পরিবহণের ব্যবস্থা রয়েছে। হিজাব রেলওয়ে পুনঃসংষ্কার করা হলে এই দুই শহরের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতি হবে কিনা তা যাচাই করতে গবেষণা শুরু হয়েছে। এই রেলওয়েকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করাও এর পুনঃসংষ্কারের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। ২০১৫ সালে এটিকে ইউনেস্কোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্রস্তাব করে সউদী আরব (যদিও সউদী আরব জর্দানের মত তাদের অংশের রেল লাইন সংস্কার করে চালু করেনি, তবে এই রেলওয়ে লাইন নিয়ে তাদের একটি ছোট জাদুঘর রয়েছে এবং তারা এটিকে তাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়)।
সিরিয়া থেকে যাত্রী নিয়ে সউদী আরবে কোন ট্রেন যাবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি চিন্তা করা কঠিন। তবে যতদিন হিজাব রেলওয়ের ঐতিহ্য এবং এর ইতিহাস অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে, ততদিন ঐতিহাসিক এই রেলওয়ে সেবা নতুন করে চালু হওয়ার সম্ভাবনা টিকে থাকবে। সূত্র : বিবিসি বাংলা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (9)
MD Year Ali Sikder ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১:৪২ এএম says : 0
এই রেল লাইন মুসলিম বিশ্বকে একত্রিত করবে - যারা এটি তৈরি করেছিলেন তারা এমনটাই প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে মুসলিম বিশ্ব এখন হাজারো দলে বিভক্ত।
Total Reply(0)
Mohammad Abul Mamun ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১:৪২ এএম says : 0
মাশাআল্লাহ্, খুবই সুন্দর পোস্ট। ইতিহাস জানতে হবে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে জানাতে হবে।
Total Reply(0)
Sakib Hasan ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১:৪৩ এএম says : 0
আল্লাহ অটোম্যানদের বা উসমানীয়দের শেষ সুলতান, সুলতান আব্দুল হামিদকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন |
Total Reply(0)
Juned Ahmed ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১:৪৩ এএম says : 0
এখানে তত্ত্বগত ভূল আছে। যদি এটা ১৯১৪ সালের দিকে তৈরী হয়, তাহলে সেখানে ৫ টি দেশের মধ্যে ইজরাইল আসবে কিভাবে?
Total Reply(0)
D. H Sumon ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১:৪৩ এএম says : 0
সেই খিলাফত ব্যবস্থা আবারো পুনঃপ্রতিষ্ঠত হবে ইনশাআল্লাহ এবং পূজিবাদি জুলুমের শাসন থেকে বিশ্ব কে মুক্ত করবে ন্যায়পরায়ণ খলিফারা।
Total Reply(0)
Md Arif Rabbani Arif ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১:৪৩ এএম says : 0
আল্লাহ আমাদের আবারও একত্রিত করবেন ইনশাআল্লাহ ।
Total Reply(0)
Harunur Rashid ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ৩:৩০ এএম says : 0
Must see!
Total Reply(0)
Md. Shahidullah ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ৭:১৩ এএম says : 0
আমাদের পূর্ববর্তীদের এই মহতী কর্মের জন্য আমরা পরবর্তীরা দোয়া করি যেন আল্লাহ পাক উনাদের জান্নাতে আ'লা মাকাম দান করেন। আমিন
Total Reply(0)
Md Mahabbur Rahman ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ৭:৫১ এএম says : 0
Assalamu alaikum
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন