বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্বভার গ্রহণকালে বাংলাদেশের টেলিডেনসিটি ছিল ৩০ শতাংশ। বর্তমানে এই হার প্রায় শতভাগে উন্নীত হয়েছে। ২০০৮ সালে যেখানে মোবাইল গ্রাহক ছিল ৪ কোটি ৪৬ লাখ, বর্তমানে তা ১৮ কোটি ২০ লাখ অতিক্রম করেছে। ওই সময়ে দেশে ইন্টারনেট গ্রাহক ছিল মাত্র ৪০ লক্ষ, বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি ৯১ লাখ। ব্যান্ডউইডথের ব্যবহার যেখানে ছিল ৭ দশমিক ৫ জিবিপিএস বর্তমানে তা ২৭শত জিবিপিএস অতিক্রম করেছে। ২০০৮ সালে টেলিযোগাযোগ সংক্রান্ত লাইসেন্স ছিল ৬০৮টি, বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে এ সংখ্যা ৩,৩৯৬টি। ২০০৮ সালে এক এমবিপিএস ব্যান্ডউইডথ চার্জ ছিলো ২৭০০০ টাকা, যা ২০১৮ সালের পর সর্বনিম্ন ২৮০ টাকা নির্ধারিত হয়। এক দেশ এক রেট কর্মসূচির আওতায় প্রতি এমবিপিএস ইন্টারনেটের মাসিক তা ১০০ টাকায় নির্ধারিত হয়। ২০০৮ সালে ২-জি নেটওয়ার্ক যুগ থেকে বর্তমানে বাংলাদেশ ফাইভ-জি যুগে প্রবেশ করেছে।
২০১৮ সালে বিশ্ব যখন ফাইভ-জি প্রযুক্তি নিয়ে ভাবছে বাংলাদেশ সেই বছরই এই প্রযুক্তির পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব আহমেদ ওয়াজেদ দেশে ফাইভ-জির সফল এই পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। এর আগে ২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ফোর-জি বেতার তরঙ্গ নিলাম এবং একই বছর ২০ ফেব্রুয়ারি মোবাইল অপারেটরদের ফোর-জি লাইসেন্স প্রদানের মাধ্যমে ফোর-জি সেবা চালু করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ফাইভ-জি যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। ফাইভ-জি প্রযুক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া এবং বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হিসেবে প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো। ফাইভ-জি প্রযুক্তি হচ্ছে একটি শিল্প পণ্য। আগামী দিনের প্রযুক্তি এআই, রোবটিক্স, আইওটি, বিগডাটা কিংবা ব্লকচেইনের যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিল্প প্রতিষ্ঠান কিংবা মৎস্য ও কৃষির জন্য ফাইভ জি অপরিহার্য। এমনকি শিল্প কারখানায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও ফাইভ-জি ছাড়া বিনিয়োগ করবে না। এজন্য প্রাথমিকভাবে দেশের পাঁচটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ফাইভ-জি সংযোগ দেওয়ার জন্য বিটিসিএল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।
২০১৮ সালের ১২ মে বাংলাদেশের প্রথম যোগাযোগ উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। এরই মধ্যদিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশ অভিসিক্ত হলো ৫৭তম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশের মর্যাদায়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ সুবিধার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর পর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের অভিযাত্রা শুরু হয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ২০২৩ সালের মধ্যে এটির কার্যক্রম চালু করার চেষ্টা অব্যাহত আছে। দেশের প্রথম স্যাটেলাইটের মাধ্যমে স্যাটেলাইট নির্ভর সম্প্রচার ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জন করে। অন্যান্য প্রকৃতি ও ধরনের স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণ একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য ডিজিটাল সংযুক্তির সক্ষমতা তৈরি সৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ জাতীয় জীবনের জন্য আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হতে যাচ্ছে।
কুয়াকাটায় দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগের পর দেশের তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বহুল প্রত্যাশিত তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সি-মি-উই-৬ কনসোর্টিয়ামের সাথে কনস্ট্রাকশন এন্ড মেইনটেনেন্স এগ্রিমেন্ট এবং কনসোর্টিয়ামের সরবরাহকারীগণের সাথে ২০২১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার আনুষ্ঠানিক এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
দেশের ৫৮৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফ্রিওয়াইফাই জোন স্থাপনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় দ্বীপ, চর ও হাওর অঞ্চলসহ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ডিজিটাল কানেক্টিভিটি পৌঁছে দিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ কাজ করার পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের অর্থে ইতোমধ্যে দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চলের ৬শত ৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ডিজিটাল শিক্ষার কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এরই মধ্য দিয়ে দেশে ডিজিটাল শিক্ষা বিস্তারের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হতে চলেছে। ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল সম্প্রসারণ করা হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, হাওর, পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গম পাহাড় উপকূলীয় ও দ্বীপ এলাকায় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত হচ্ছে।
২০২১ সালে আইএসপি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এর ফলে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ইন্টারনেটের একদেশ একরেট নির্ধারণ করা হয়েছে। সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে একদেশ এক রেট চালু করা হয়। কোভিডকালে মানুষের জীবনযাত্রা সচল রাখতে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত শতভাগ টাওয়ার ফোরজি নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। দেশ ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদন ও রপ্তানি শুরু হয়েছে।
মোবাইল ফোন ও নেটওয়ার্ক এখন মানুষের জীবনের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রযুক্তিবান্ধব বিনিয়োগ নীতির ফলে দেশে বর্তমানে মোবাইল ফোনের চাহিদার শতকরা ৬৩ ভাগই বাংলাদেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। স্যামসাং ও শাওমিসহ দেশে ১৪টি মোবাইল কোম্পানি অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে মেড-ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ডের ফাইভজি মোবাইল রপ্তানি করছে। মোবাইল ফোন এবং এর বিভিন্ন অ্যাপসের ব্যবহার, উচ্চগতির ব্রডব্র্যান্ড ইন্টারনেট, ওভার দ্যা টপ (ওটিটি) অ্যাপস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্যাটেলাইটসহ আধুনিক টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি দেশের জনগণের জীবনকে সহজ ও সাবলীল করেছে। ডিজিটাইজেশনের প্রসারের পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর।
টেলিযোগাযোগ সুবিধা বঞ্চিত হাওর, দ্বীপ ও দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি স্থাপনে সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল (এসওএফ) ১৫২৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে আইসিটি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল ৫০৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে টেলিযোগাযোগ সুবিধা বঞ্চিত এলাকাসমূহে ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি স্থাপন, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর মাধ্যমে দ্বীপ এলাকায় নেটওয়ার্ক স্থাপনে ৪৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, টেলিটকের মাধ্যমে ৩৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে হাওর ও দ্বীপাঞ্চলে ব্রডব্যণ্ড নেটওয়ার্ক স্থাপন, বিটিসিএল এর মাধ্যমে ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে হাওর-বাওর ও প্রত্যন্ত ব্রডব্যান্ডন্ড ওয়াই ফাই নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজ চলছে।
২০৪১ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের বিশটি উন্নত দেশের কাতারে সামিল হবে। সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণের এ অভিযাত্রায় তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের নিরন্তর এ পথ চলা আরো গতিময় হোক, ডিজিটাল কানেক্টিভিটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্নের সোনার বাংলা হোক আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন