রোববার ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ কার্তিক ১৪৩১, ৩০ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

দেশে বিভিন্ন খাতে বহু সফল উদ্যোক্তা গড়ে উঠেছে

আবুল কাসেম হায়দার | প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৭ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এনভয় গ্রুপের কুতুবউদ্দিন ও আবদুস সালাম মুর্শেদী তৈরি পোশাকের পর টেক্সটাইল শিল্পে ভালো বিনিয়োগ করেন। আবদুল সালাম মুর্শেদী ফুটবল ফেডারেশন থেকে অবশেষে সংসদ সদস্য ও শিল্পপতি হিসেবে বেশ সফল।

তৈরি পোশাকশিল্প থেকে বস্ত্রখাতের অন্যান্য শাখায় ভালো বিনিয়োগ করে সফল শিল্প উদ্যোক্তা বাদশাহ মিয়া, ফকির গ্রুপের ফকির, ইউসুফ আলী, হা-মীম গ্রুপের এ কে আজাদসহ অনেকে।

মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম চট্টগ্রাম থেকে খালি হাতে ঢাকায় আসেন। কথিত আছে, মাত্র ৬৭ টাকা নিয়ে তিনি ইসলামপুরের এক দোকানে বিক্রয় কর্মী হিসাবে চাকরি নেন। সেই নুরুল ইসলাম পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠা করেন নোমান গ্রুপ। দোকানদারী থেকে শুরু যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠা করেন নুরুল ইসলাম বাবুল। প্রথম জীবনে ফুটপাতে হকারী করেন। এরপর ধীরে ধীরে বড় শিল্পপতিতে আত্মপ্রকাশ করেন।

নোয়াখালী জেলার বাসিন্দা পার্টেক্স গ্রুপের কর্ণধার আবুল হাশেম। পরবর্তীতে রাজনীতিতে জড়িত হয়েছিলেন। ক্ষুদ্র থেকে অনেক ব্যবসার জন্ম দিয়েছিলেন। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। বর্তমান দ্বিতীয় প্রজন্ম পার্টেক্স গ্রুপ পরিচালনা করছে।

পোশাকখাত দিয়ে ব্যবসা শুরু করে ডিবিএল বা দুলাল ব্রার্দাস লিমিটেড। চার ভাই শুরু থেকে একত্রে ব্যবসা করছেন। বর্তমানে টাইলস, তথ্যপ্রযুক্তিসহ অন্যান্য খাতে সফল বিনিয়োগকারী। আরও অনেক সফল উদ্যোক্তা তৈরি পোশাকের খাতে রয়েছে। প্রবন্ধের কলেবর বড় হবে বিধায় সংক্ষেপ করতে হলো। ভবিষ্যতে আবারও লেখার চেষ্টা করবো।

তৈরি পোশাকের বাইরের খাত: এমএস বারানভ যে ১৬ পরিবারের তালিকা শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, বিগত ৫০ বছরে তাদের অনেকে হারিয়ে গিয়েছেন। বিশেষ করে, যারা পাটশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদের অনেকে আর ব্যবসার সঙ্গে নাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাটশিল্প জাতীয়করণ করা হয়। তাই অনেকে এই ব্যবসা ছেড়ে দেন।

আমাদের দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত ট্রান্সকম গ্রুপ। এই গ্রুপের অন্যতম উদ্যোক্তা লতিফুর রহমান ছিলেন খান বাহাদুর মুজিবর রহমানের পুত্র। তিনি পাট ব্যবসা ছেড়ে অন্য ব্যবসায় আসেন। বিদ্যুৎ, ইলেকট্রনিক্সপণ্য, খাদ্য ও অন্যান্য খাতে সফল উদ্যোক্তা। দৈনিক প্রথম আলো, ডেইলী স্টার তারই প্রতিষ্ঠান।

অন্যান্য খাতে উদ্যোক্তা তৈরি: তৈরি পোশাকশিল্প ছাড়াও বাংলাদেশে বহু নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে। দেশকে এই সকল উদ্যোক্তা নানাভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এক সময় ভাগ্যের গুণে একচেটিয়া ব্যবসা ছিল চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের। এখন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় একচেটিয়া আধিপত্য নাই। চট্টগ্রামের সূফি মিজানুর রহমান এক সময় শুধু ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী ছিলেন। তার দুই ভাই তৈয়ব ও মোহাম্মদ আবুল কালামও ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী ছিলেন। এই দুই ভাই টিকে গ্রুপ নামে বড় ব্যবসায়ী। এখন এই তিন জনই ভোগ্যপণ্য ছাড়াও নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তারা দেশের বড় ব্যবসায়ী এখন। তবে ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় এখন বড় অংশ দখল করেছেন সিটি গ্রুপের ফজলুর রহমান ও মেঘনা গ্রুপের মোস্তফা কামাল। এছাড়াও আরও বহু ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী এসেছেন।

বাংলাদেশে এখন তৈরি পোশাক শিল্প, বস্ত্র শিল্প, পাট ও ভোগ্যপণ্য ব্যতীত কৃষি ও খাদ্যপণ্যে প্রচুর বিনিয়োগ এসেছে। এই সকল খাতে সরকারের বড় চাকরি ছেড়ে বড় উদ্যোক্তা হয়েছে এসিআই গ্রুপের আনিস উদ দৌলা এবং কাজী ফার্মের কাজী জায়েদুল হাসান। তার গ্রুপের নাম কাজী গ্রুপ বা কাজি ফার্ম। কাজী জাহিদুল হাসান প্রথমে তৈরি পোশাক নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে এই খাত ছাড়া তিনি কৃষি ও খাদ্যপণ্য ব্যবসায়ে মনোযোগ দেন। বেশ সফলও হয়েছেন। তিনি শিক্ষা ও টিভি খাতেও বিনিয়োগ করেন। দেশের একজন সফল, সৎ ও নিষ্ঠাবান শিল্প উদ্যোক্তা কাজী জাহিদুল হাসান।

কুষ্টিয়ার বিআরবি গ্রুপের মজিবর রহমান একজন সৎ, সফল শিল্প উদ্যোক্তা। শিল্প নিয়ে তার যাত্রা শুরু। কুষ্টিয়া বিসিক অঞ্চলে তার শিল্প। এখন তিনি দেশের বড় শিল্পপতি। স্বাস্থ্যখাতেও তিনি বিনিয়োগ করেছেন। ক্ষুদ্র থেকে আজ বৃহৎ শিল্পগ্রুপ।

চামড়াজাত শিল্পে উদ্যোক্তা সৈয়দ মনজুর এলাহী। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য তৈরিতে তিনি সফল। বিদেশে রপ্তানিও করছেন। দেশে বিদেশে তার পণ্যের সুনাম রয়েছে। তিনি একজন সৎ, যোগ্য সফল শিল্প উদ্যোক্তা।
আবদুল আউয়াল মিন্টুও একজন সফল ব্যবসায়ী। তিনি এফবিসিআই’র সভাপতির দায়িত্ব দুই দুই বার পালন করেন। স্পিনিং মিল থেকে এখন একজন সফল কৃষিপণ্য উদ্যোক্তা। বীজ ও শাকসবজি তৈরিতে দেশে তার অবদান রয়েছে। কৃষিবীজ তৈরি ও বিক্রিতে তিনি সফলতা দেখিয়েছেন। তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। পূর্বে আওয়ামী লীগ করলেও বর্তমানে বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে পূর্ব বাংলায় ব্যবসা বাণিজ্য মূলত অবাঙালিদের হাতে ছিল। যে কয়টি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিল, তাও ছিল অবাঙালিদের বা পাকিস্তানিদের। ১৯৭১ সালের পর তারা সকলে পশ্চিম পাকিস্তান চলে যান। বাংলাদেশ সরকার প্রায় সকল বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ করেন। তাই অবাঙালিদের চলে যাওয়ার পর দেশে শিল্প-বাণিজ্যে বড় রকমের ফাঁক সৃষ্টি হয়। তবে দুইটি পরিবার দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বাংলাদেশে থেকে যাননি। একটি ইস্পাহানি গ্রুপ, অন্যটি আকবর আলী আফ্রিকাওয়ালা পরিবার। চা, ইস্পাত শিল্পসহ নানা ব্যবসায় এই গ্রুপ দুইটি এখনও বাংলাদেশে বড় শিল্প উদ্যোক্তা, সফলতার সঙ্গে এই গ্রুপ দুইটি বাংলাদেশে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

সব সময় সরকারের সরাসরি সহযোগিতায় ব্যবসা-বাণিজ্য আমাদের দেশে হয়ে আসছে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতের উত্থান বলতে গেলে সরকারি সহযোগিতায়। এইখানে সামিট গ্রুপ অগ্রে রয়েছে। সামিট গ্রুপের মুহাম্মদ আজিজ খান বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথ প্রদর্শক। সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ প্রকল্প সামিট গ্রুপের। ইউনাইটেড গ্রুপের হাসান মাহমুদ রাজাও বিদ্যুৎ খাতে ভালো বিনিয়োগ করেছেন। সফলতা উভয়ের রয়েছে। তাছাড়া স্বাস্থ্যখাত ও শিল্পখাতে বিনিয়োগ রয়েছে। ২০০৯ সালে সরকার ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সুযোগ দেন। তখন অনেকে উদ্যোগ নেয়। আমি ও আমার কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ফিরোজ আলম শাহাজীবাজার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেই। ইয়ুথ স্পিনিং মিলস লিমিটেডের মাধ্যমে প্রথমে শাহাজীবাজার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দরপত্রে আমরা নির্বাচিত হই। তাই এই খাতের প্রথম উদ্যোক্তা চেয়ারম্যান হিসেবে আমার স্বীকৃতি রয়েছে। পরবর্তীতে ফিরোজ আলম অন্য উদ্যোক্তা নিয়ে শাহাজীবাজার বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে চলে যায়। নানা কারণে এই কোম্পানির সঙ্গে আমার বিনিয়োগ রইল না। তবে কোম্পানি চলেছে। ব্যবসা বড় হয়েছে। আরও দুই বিদ্যুৎ কোম্পানির অংশীদার ও শাহাজীবাজার বিদ্যুৎ কেন্দ্র হয়েছে। সফলতা এসেছে।

বাংলাদেশ হওয়ার পর ভূমি নিয়ে ব্যবসা বেশ জমে উঠেছে। অনেকে সফল হয়েছেন। তবে অনেকে বিতর্কিতও হয়েছেন। অনেক টিকে আছেন, অনেকে এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। রিয়েল অ্যাস্টেট খাতে ব্যবসা এক সময় তৈরি পোশাকশিল্পের পরই স্থান দখল করে। কয়েক হাজার ভূমি ব্যবসায়ী ও অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাদের সমিতিও বিজিএমইএ’র মতো শক্তিশালী। যেমন শক্তিশালী জনশক্তি রপ্তানিকারক সমিতি।

দেশে প্রথমে এই খাতে অগ্রদূত বলা যায় জহুরুল ইসলামের ইস্টার্ন হাউজিং। বহু ভাল ভাল প্রকল্প ইস্টার্ন হাউজিং বাস্তবায়িত করেছে। আবাসন সমস্যার ভালো সমাধান দিয়েছে। একই সাথে বসুন্ধরা গ্রুপের নাম উল্লেখ করতে হয়। ঢাকায় রাজধানীর বিরাট অংশে আছে বসুন্ধরা আবাসিক প্রকল্প। আকবর সোবহান এই গ্রুপের প্রধান। এই খাতে তিনি সফল। আরও কিছু ভূমি ব্যবসায়ী এই খাতে বিনিয়োগ করেছেন। আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ আরও একটি অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসায়ী বড় প্রতিষ্ঠান। তারাও অনেক ক্ষেত্রে সফল।

আমাদের বিভিন্ন খাতে বহু উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। সরকারের নীতিসহায়তার কারণে বৃহৎ উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি সম্ভব হয়েছে। তবে সব চেয়ে বড় অভিযোগ দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্যের। ঘুষ ছাড়া দেশে যেন কোন কাজই হয় না। দুর্নীতিকে ব্যবসায়ীগণ ব্যবসার একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবে ধরে নিয়েছে। সরকারও বলছে ব্যবসায়ীগণ ট্যাক্স, ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। সব কিছুর মূলে দুর্নীতি, ঘুষ, অনিয়ম ইত্যাদি

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বিগত ৫০ বছরে অনেক প্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় প্রজন্মের উদ্যোক্তাগণ দায়িত্ব নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানে তৃতীয় প্রজন্ম এগিয়ে এসেছে। নতুন প্রজন্মের সকলে কিন্তু ব্যবসাকে এগিয়ে নিতে পারছেন না। অনেকের সামর্থ্য ও যোগ্যতার কমতি রয়েছে। বাংলাদেশের উদ্যোক্তা শ্রেণির নিকট এইটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে আমাদের শিল্প ও বাণিজ্যকে এগিয়ে নিতে হবে। (সমাপ্ত)

লেখক: প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ ,সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন