জাকের উল্লাহ চকোরী, কক্সবাজার : চকরিয়া সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকার পানি প্রবাহমান ছোট-বড় প্রায় ডজন খানেক খাল বা শাখা নদীতে বাঁধ দিয়ে প্রভাবশালীরা চিংড়ী প্রকল্প তৈরি করে গত ৪ বছর ধরে মাছ চাষ করায় হাজার হাজার প্রকৃত মৎস্য চাষীরা চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। জোরপূর্বক অবৈধভাবে শাখা নদী দখল করে চিংড়ী চাষ করায় সরকার ফি বাবদ বছরে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। উপজেলার চিরিংগা ও বদরখালী ইউনিয়নের চরনদ্বীপ, রামপুর, রিংভং ও বদরখালীসহ বিভিন্ন মৌজার হাজার হাজার একর বিশিষ্ট ডজন খানেক প্রবাহমান শাখা নদী রয়েছে। দখলবাজরা সিন্ডিকেট করে খালের উভয় পাশে বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে অবৈধভাবে চিংড়ী চাষাবাদের মাধ্যমে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা আয় করলেও তার কানাকড়িও সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে না।
চিংড়ী চাষীদের অভিযোগ, এলাকার প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা জড়ো হয়ে পানি চলমান খাল বা শাখা নদী দখল করে মাছ চাষ করায় তাদের চিংড়ী ঘেরে পানি প্রবেশ করাতে পাচ্ছেনা। ফলে হাজার হাজার চিংড়ী চাষীদেরকে চরম ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে। চিংড়ী ঘেরে জোয়ার-ভাটার সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি প্রবেশ করাতে না পারায় অক্সিজেনসহ মাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য স্বল্পতার কারণে মাছে মড়কসহ বিভিন্ন প্রকারের পানিবাহিত রোগ সৃষ্টি হয়ে লাখ লাখ টাকার মাছ মারা যাচ্ছে। দীর্ঘ কয়েক শতক ধরে নদী বা খালের উভয় পাশে সৃষ্ট বনের সুন্দরী গাছসহ শতশত একর প্যারাবন নষ্ট করে চিংড়ী প্রকল্প তৈরি করায় উপকূলীয় এলাকার পরিবেশ ধ্বংসের পাশাপাশি ফ্রি বছরে নেমে আসছে প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও মহাবিপর্যয়। অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি চাষের কারণে চকরিয়ার উপকূলীয় এলাকার পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একই সাথে হ্রাস পেয়েছে চিংড়িসহ মৎস্য উৎপাদন কার্যক্রম। অপরদিকে এলাকার ভূমিদস্যু ও প্রভাবশালীরা শাখা নদী বা খালগুলো দখলে রাখায় এখানকার হতদরিদ্র জেলেদের জীবন-জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে প্রকৃত মৎস্যজীবী জেলে পরিবার গুলোতে চলছে চরম অভাব ও হাহাকার। গত ৩ বছর ধরে শাখা নদী গুলো প্রভাবশালী মহলের নিয়ন্ত্রণে থাকায় জেলে পরিবারগুলো মাছ ধরতে না পারায় তাদের বাপ-দাদার মাছ ধরা পেশা ছেড়ে জলদস্যুতা, চুরি, ডাকাতি ও ভিক্ষাবৃত্তিসহ বিভিন্ন অপকর্মের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
প্রাপ্ত অভিযোগে জানা গেছে, বিগত এক দশকে চকরিয়া সুন্দরবনের প্রায় ৩০/৩৫ হাজার একর প্যরাবন উজার হয়েছে অপরিকল্পিত ও অবৈধ চিংড়ি চাষের কারণে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নাম ব্যবহার করে এক শ্রেণীর ভূমিদস্যু ও প্রভাবশালী নেতা ও তাদের অনুগত ক্যাডার বাহিনী উপজেলার ৪/৫টি মৌজার ডজন খানেক ছোট-বড় শাখা নদী বা খাল দখলে নিয়ে অঘোষিত ভাবে মৎস্য চাষের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। প্রভাবশালীরা প্রথমদিকে প্রশাসনসহ একাধিক এজেন্সিকে দখল বেদখলে নানাভাবে সম্পৃক্ত করলেও পরের বছর থেকে তারা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এককভাবে লুটপাট চালাচ্ছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছে। প্রভাবশালী মহলের দখলে থাকা বহুল আলোচিত মাছকাটা খাল, পানখালী খাল, চারালিয়া খাল, ইছারফাড়ি খাল, টাক্ক্যারফাড়ি খাল, ছোয়ারফাড়ি খাল, খুইজ্যাখালী খাল, রিংভং খাল, ভরাফাড়ি খাল, পরানতরানীর খাল ও বাটামনি খালসহ ডজন খানেক খাল প্রভাবশালী মহলের দখলে চলে যাওয়ায় সরকার প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। ভুমিদস্যুরা এসব খাল দীর্ঘদিন ধরে দখলে রাখায় বর্তমানে উপজেলার চিংড়ি জোন খ্যাত এলাকায় জোয়ার-ভাটার পানি প্রবাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। চিংড়ী জোনে সরকারিভাবে বরাদ্ধপ্রাপ্ত চিংড়ি চাষিরা জানান, উপজেলার চিংড়ি জোনের ১০,১১ ও ৩০ একর বিশিষ্ট চিংড়ী ঘের এলাকায় প্রায় ৮ হাজার একর আয়তনের ৫৮৭টি মৎস্য প্রকল্প রয়েছে। প্রভাবশালীরা ওই এলাকার এসব খাল দখলে নিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়ায় বর্তমানে মৎস্য চাষ হুমকির মুখে পড়েছে। সাগরে জোয়ার-ভাটার সময় ওই সব শাখা নদী দিয়ে লবনাক্ত পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় মারা যাচ্ছে সৃজিত ও প্রাকৃতিক সৃষ্ট হাজার হাজার একর প্যারাবন। নদী বা খাল দিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ থাকায় আগামী বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে চকরিয়া উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নসহ ১টি পৌরসভায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হতে পারে বলে আঙ্ককা প্রকাশ করছে এলাকার সচেতন মহল। আগামী বর্ষা মৌসুমে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে এলাকার বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থাপনার ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জহিরুল হক বলেন, দীর্ঘদিন শাখা নদী বা খাল গুলোর দখল করে দু পাশে বাঁধ দিয়ে মৎস্য চাষ করায় ওই এলাকায় পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন। চিংড়ী জোন এলাকায় সিংহভাগ খাল বা শাখা নদী গুলো দখল করে নেয়ায় প্রতিনিয়ত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা ও বৃহত্তর চিংড়িজোনে মৎস্য চাষাবাদ নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই খালগুলো উদ্ধার পূর্বক খনন করে লবনাক্ত পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। এলাকার হাজার হাজার চিংড়ী চাষীদের কথা বিবেচনা করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী কালো সোনা খ্যাত চিংড়ী চাষীদের বাঁচানোর লক্ষ্যে অবিলম্বে খাল বা শাখা নদী গুলো উদ্ধারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের হ¯তক্ষেপ কামনা করেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন