শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

পিএস পদে এত মধু!

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০২২, ১২:০১ এএম

পেশায় একজন ক্যান্সারের ডাক্তার ও শিক্ষক; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) জেনারেল সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (সার্জিক্যাল অনকোলজি)। প্রতিদিন হাজার রোগী বিএসএমএমইউতে আসেন ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে। সার্জিক্যাল অনকোলজি বিভাগে শিক্ষক সঙ্কটও প্রকট। প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে আসা ক্যান্সারের এসব রোগী চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বিভিন্ন সময়ে এই বিভাগে শিক্ষক সঙ্কটের কথা বলা হয়েছে। অথচ একজন ডাক্তার হয়েও নিজ পেশা বাদ দিয়ে একজন ভিসি’র ব্যক্তিগত সহকারী পদে বসেছেন। যার কথা বলা হলো তিনি হলেনÑ বিএসএমএমইউ’র ভিসি প্রফেসর ডা. মো. সারফুদ্দিন আহমেদের বর্তমান ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস-১) ডা. মো. রাসেল। মানুষকে সেবা দেয়ার ব্রত নিয়ে চিকিৎসা পেশায় আসলেও তিনি লোভের বশবর্তী হয়ে চিকিৎসা পেশা বাদ দিয়ে একজন সিনিয়র সহকর্মীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। বিষয়টি নিয়ে বিএসএমএমইউ’সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভসহ বিরুপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ ডা. মো. রাসেলকে শিক্ষকদের জন্য লজ্জাজনক হিসেবে অবিহিত করেছেন। আবার কেউ এমন ডাক্তারকে ‘শিক্ষক সমাজের ক্যান্সার’ বলছেন।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, একজন ডাক্তার তৈরি করতে রাষ্ট্রের লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। ওই সব টাকা আসে জনগণের ট্যাক্স থেকে। সেই ডাক্তারি পাস করে রোগীর চিকিৎসাসেবা দেয়া ও শিক্ষকতার বদলে ভিসি’র পিএস হয়ে এই পেশাকে অসম্মান করেছেন ডা. মো. রাসেল। ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতেই ডা. রাসেল এ পদে বসেছেন। একই সঙ্গে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকদের মধ্যে ভিসি নিয়োগ দেয় সরকার। একজন শিক্ষক আরেকজন শিক্ষকের সহকর্মী। আর সেই সিনিয়র শিক্ষকের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে আরেকজন শিক্ষক এটা শিক্ষক সমাজের জন্য মর্যাদাহানি ও লজ্জাকর।
সূত্র মতে, বিএসএমএমইউ’র বর্তমান ভিসি প্রফেসর ডা. মো. সারফুদ্দিন আহমেদ ২০২১ সালের ২৯ মার্চ নিয়োগ পান। এরপরই ভিসি’র ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিয়োগ পান দু’জন। পিএস-১ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জিক্যাল অনকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. রাসেল (১) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার দেবাশীষ বৈরাগী।
ভিসি’র পিএস হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগের শিক্ষকের কাজ করাকে অস্বাভাবিক বলছেন অন্যান্য শিক্ষকরা। যদিও ডা. মো. রাসেল পিএস হওয়ার সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে একক আধিপত্য বিস্তার করেছেন। ইতোমধ্যে সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছেন। এক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয় জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে। পদোন্নতি সংক্রান্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সাধারণত দেশের বহুল প্রচারিত পত্রিকায় দেয়া হয়। কিন্তু ডা. রাসেলের পদোন্নতির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি স্বল্প প্রচারিত পত্রিকায় দেয়া হয়। আবেদনের সময়সীমা ৪ থেকে ৮ সপ্তাহের পরিবর্তে যাতে করে অন্য কেউ আবেদন না করতে পারে সে জন্য মাত্র ১ সপ্তাহের সময় দেয়া হয়। গত বছরের ৮ জুলাই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয় এবং আবেদনের সময় সীমা দেয়া হয় ১৮ জুলাই পর্যন্ত। শুধু নিজের পদোন্নতিই নয়; ডা. মো. রাসেল সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৭০ জন নার্স নিয়োগ এবং ৯০০ কর্মচারীর চাকরি নিয়মিতকরণে বড় অঙ্কের বাণিজ্য করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএসএমএমইউ হাসপাতালের পথ্য বিভাগ (ডায়েট শাখা) থেকে ডা. মো. রাসেল প্রতি মাসে বড় অঙ্কের অর্থ নিয়ে থাকেন। নিয়ম অনুযায়ী, টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পথ্য বিভাগের কাজ প্রদান করার কথা থাকলেও ডা. মো. রাসেল নিজ ক্ষমতায়ই কাজ দিয়ে থাকেন।
ক্ষুদ্ধ বিএসএমএমইউ’র একাধিক শিক্ষক জানান, মূলত অনৈতিকভাবে অর্থ আয়ের জন্যই ডা. রাসেল পিএস হয়েছেন। শিক্ষকতা পেশাকে তিনি অসম্মান করেছেন। এক শিক্ষক বলেছেন, তাকে ১০ লাখ টাকা বেতন দিলেও শিক্ষক হয়ে তিনি পিএস এর দায়িত্ব নিবেন না।
বিএসএমএমইউ’র শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. জিল্লুর রহমান ভূঁইয়া ইনকিলাবকে বলেন, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি’র পিএস হওয়া নিয়ে নিয়ম-নীতি থাকতে পারে। বিএসএমএমইউ’র ক্ষেত্রে সেটি নেই। তাই ভিসি তার কাজের ক্ষেত্রে যাকে বিশ্বস্ত মনে করবেন তাকে পিএস হিসেবে নিতে পারেন। তিনি বলেন, ডা. মো. রাসেল খুবই দক্ষ। পেশার কাজেও যেভাবে মনযোগী আবার পিএস হিসেবেও সফলতার সঙ্গে কাজ করছেন। তবে সার্বিকভাবে দেখলে হয়তো একজন সহযোগী অধ্যাপক পিএস হিসেবে অলঙ্কারিক পদ নয়।
এ বিষয়ে ডা. মো. রাসেল ইনকিলাবকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কনফার্ম হওয়ার পর প্রফেসর ডা. মো. সারফুদ্দিন আহমেদ স্যার আমাকে বললেন, আমি আমার পাশে একজন সৎ ও ভালো ছেলে চাই। তুমি থাকবে কি না? আমি শিক্ষক হওয়ায় বিষয়টিতে অপারগতা প্রকাশ করি। তখন ভিসি স্যার আমাকে বললেন, মন্ত্রী ও সচিবের পিএস সাধারণত ৫ম গ্রেডেরই কর্মকর্তা হন। তাই এক্ষেত্রে সমস্যা নেই। বরং পিএস হিসেবে একজন চিকিৎসক থাকলে আমাদের কাজ যেহেতু চিকিৎসা পেশা নিয়ে তাই ভালো হবে। আর এই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ বছরের ইতিহাসে প্রথম একজন ডাক্তারকে ভিসি হওয়ার পরের দিনই পিএস হিসেবে নিয়োগ দেন। তবে আমি ভিসি স্যারের অনুমতি নিয়ে এই কাজের পাশাপাশি চিকিৎসা পেশার স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে আমি প্রতি সপ্তাহে আমার নিজ এলাকা ভোলায় চিকিৎসাসেবা প্রদান করি।’
ডা. মো. রাসেল বলেন, ‘ডাক্তার পিএস হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে অনেক গতি এসেছে। আবার যারা অনৈতিক কাজ করতে চাচ্ছেন বা করেছেন ভিসি স্যার সেগুলো চিহ্নিত করছেন। তাই অনেকেই স্বার্থ হাসিল করতে পারছেন না বলে আমাকে চক্ষুশূল ভাবছেন। আমার বিরুদ্ধে লেগেছেন।’ নার্স নিয়োগে বাণিজ্যের বিষয়ে ডা. মো. রাসেল বলেন, মেধা তালিকা থেকেই নার্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এখানে কারো সুপারিশ গ্রহণ করা হয়নি বলেই অনেকে বিরুদ্ধাচারণ করছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন