শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

উপেক্ষিত ব্রহ্মপুত্র পাড়ের বালিকাবধূরা

আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঝলমলে সাফল্য

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৯ মার্চ, ২০২২, ১২:০৯ এএম

আন্তর্জাতিক নারী দিবস গতকাল ঘটা করে পালিত হয়েছে। নারীর উন্নয়ন, নারীর অধিকার নিয়ে প্রচারণা হয়েছে ব্যপক। অনেক স্তুতিগাঁথা সাফল্যের ফিরিস্তি নিয়ে গণমাধ্যমগুলো ছিল সরব। অথচ গ্রামের বঞ্ছিত অবহেলিত নারীদের খোঁজ কেউ রাখেন না। শহরে নারীর সাফল্য নিয়ে মিডিয়ায় একের পর এক অনুষ্ঠান হলেও গ্রামের নারীর চিত্র কেউ তুলে ধরেনি। চরাঞ্চলের নারীদের অবর্ননীয় দুর্ভোগ এখনো বিদ্যামান। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র পাড়ের বালিকা বধূদের দূর্দশা নারী নেত্রীদের স্পর্শ করেনি।

গত কয়েক বছর পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রসহ অসংখ্য নদনদী পাড়ের চরাঞ্চলে ঘুরেছি। দেখেছি নারীদের কত বঞ্চনা, যৌতুকের অভাবে নিয়ে না হওয়া এবং বাল্য বিয়ের চিত্র দেখেছি। এখানে ব্রহ্মপুত্রপাড়ের চিত্র তুলে ধরা হলো।
ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী দ্বীপচর ‘রলাকাটার চর’। গ্রামটিতে যাতায়াতের একমাত্র বাহন নৌযান। নৌ ও সড়কপথ মিলে জেলা শহরে যাতায়াত করতে সময় লাগে দুই ঘণ্টারও বেশি। এই চরে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও নেই কোনও মাধ্যমিক বিদ্যালয় কিংবা কলেজ। ফলে প্রাথমিকের গন্ডি পেরোতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে সংসারে প্রবেশ করে কিশোরীরা। বাল্যবিয়ে এখানে স্বাভাবিক নিয়ম; কিশোরীদের ‘অনিবার্য নিয়তি’। এর ব্যতিক্রম হলেই ঘটে স্বামী বিড়ম্বনা। বয়স একটু ‘বেড়ে’ গেলে কিশোরীদের পুরুষের দ্বিতীয় বিয়ের শিকার হতে হয়।

এই গ্রামেরই মেয়ে সামসুন্নাহার (ছদ্মনাম)। করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকার সময় ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয় তার। কথা হয় এই কিশোরী গৃহবধ‚র মায়ের সঙ্গে। তার কথায়, ‘গরিবের মেয়ে বড় হইলে মাথার বোঝা হয়া যায়। একটু বয়স হইলে মানুষ নানা কথা কয় (বলে)। মানসম্মানের ভয়ে, সমাজের চাপে বিয়া দিতে বাধ্য হই।’
মেয়েদের যে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে হওয়া উচিত না, এই যুগে এসে অজানা থাকার কথা নয়। জানে ভুক্তভোগী কিশোরী গৃহবধ‚ও, কিন্তু ‘অনিবার্য নিয়তি’র কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে। একই গ্রামে বিয়ে হয়েছে তার, স্বামীর বাড়ির আঙিনাতেই কথা হয়। সে বলে, ‘বিয়ের দিনও জানতাম না বিয়ে হচ্ছে। নিজের ইচ্ছায় নয়, বাবা-মায়ের ইচ্ছাতেই এই বিয়ে। আমার পড়াশোনা করার ইচ্ছা ছিল।’

বাল্য বিয়ের মতো এমন নিষ্ঠুরতার শিকার ওই চরের আরেক কিশোরীর ভাবি জানান, তার ননদ পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলে আর পড়ানো সম্ভব হয়নি। গ্রামে কোনও মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় ৩ বছর বাড়িতেই ছিল। বিয়ের জন্য ভালো ঘরও মিলছিল না। এদিকে বয়সও ‘বেড়ে’ যাচ্ছে। শেষে ১৫ বছর বয়সে লালমনিরহাটে তার ননদের বিয়ে হয়। বরের প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন, ঘরে দুই সন্তান রয়েছে। এই গৃহবধ‚র (কিশোরীর ভাবি) ভাষ্য, ‘একটু বয়স হইলে মানুষ নানা কথা বলে। চরের নিয়ম খারাপ, একটু বড় হইলেই বিয়া দিতে হয়। স্কুল না থাকায় আরও তাড়াতাড়ি বিয়া হয়।’
রলাকাটার চরের ইউপি সদস্য আব্দুল করিম জানান, পূর্ব পুরুষ থেকে চলে আসা নিয়মে চরাঞ্চলে বাল্যবিয়ের প্রবণতা এখনও চলমান। হাইস্কুল না থাকায় এ সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাল্যবিয়ে ঠেকাতে গেলে অভিভাবকরা বলেন, বয়স বেশি হইলে মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চায় না। আমরা বোঝানোর চেষ্টা করি, কিন্তু গোপনে বিয়ে দিয়ে দেয়। চরে হাইস্কুল থাকলে মেয়েরা পড়াশোনা করতে পারতো। তাদের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি অভিভাবকরাও ভাবতেন, মেয়ে পড়াশোনা করছে, করুক।

শুধু রলাকাটার চরই নয়, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা নদীবেষ্টিত কুড়িগ্রামের প্রায় সব চরের চিত্র একই। স্থানীয়রা বলছেন, চরাঞ্চলে ভঙ্গুর যোগাযোগ ব্যবস্থা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা এবং দরিদ্রতার কারণে হরহামেশাই বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে। কুড়িগ্রামের প্রায় সব উপজেলাতেই এই প্রবণতা চলমান।
উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চররসুলপুর গ্রামের গৃহবধ‚ সেলিনা আক্তার বলেন, ‘এই এলাকা হতদরিদ্র। অভিভাবকরা মেয়েদের বাড়তি বোঝা মনে করে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেয়। বয়স বেশি হলে যৌতুকের পরিমাণ বাড়ে। কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ে দিলে তেমন যৌতুক দিতে হয় না।’

কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী জেলায় গত দেড় বছরে ৪ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। জেলার ৯ উপজেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ২ হাজার ৯২৭ জন এবং মাদ্রাসার প্রায় ১ হাজার ২৯০ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে, যা মোট শিক্ষার্থীর ২ দশমিক ৩৪ ভাগ।
শিক্ষা অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জেলায় সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হয়েছে (স্কুল ও মাদ্রাসা মিলে) সীমান্তবর্তী উপজেলা ভ‚রুঙ্গামারীতে, ৭৭৭টি। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ফুলবাড়ী, ৭০১টি এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নাগেশ্বরী উপজেলা, ৬৩৩টি। তবে এসব তথ্য শুধু স্কুলভিত্তিক। প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে যারা মাধ্যমিকে ভর্তি হতে পারছে না তাদের বাল্যবিয়ের তথ্যের কোনও পরিসংখ্যান নেই, সরকারি ভলিউমে সেগুলোর নিবন্ধনও হচ্ছে না। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিইও) শামসুল আলম বলেন, করোনাকালে জেলায় ৪ হাজারের মতো শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এত বেশি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে গতকাল টেলিভিশনগুলোতে নারীর সাফল্যের চিত্র তুলে ধরা হলো। নারী সংগঠনগুলো নারীর সমঅধিকারের দাবিতে সোচ্চার বক্তব্য শোনালেন। অসংখ্য নারীর সাফলের চিত্র তুলে ধরে কাউকে কাউকে পুরস্কৃত করা হয়। অথচ গ্রামের বিশেষ করে চরাঞ্চলে নারীদের যে দুর্দশা সে চিত্র নারী নেত্রীদের মুখে শোনা গেল না। এমনকি চরাঞ্চলে বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধেও আগামীর কোনো পরিকল্পনার কথা জানা গেল না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন