সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে শুধাই/ বল আমারে তোর কিরে আর কুল কিনারা নাই...। শিল্পী আব্দুল আলীমের গাওয়া সেই গানে প্রমত্তা পদ্মার যে রূপ ফোটে ওঠেছে তা এখন রূপকথার গল্পের মত। পদ্মার ঢেউ দেখে পারাপারে বুক কাঁপতো সেই পদ্মার বুকে এখন পানি নেই ধু ধু বালুচর। জেগে ওঠা বিশাল বালুচরের যেখানে একটু পলি পড়েছে সেখানে হচ্ছে বোরো ধানে আবাদ। ভারতের দেয়া মরণ বাঁধ ফারাক্কা রাজশাহী অঞ্চলের লাইফ লাইন খ্যাত পদ্মা নদীর মরণ ডেকে এনেছে। ভারতের আগ্রাসী পানি নীতির কারণে শুধু পদ্মা নয় এর শাখা প্রশাখাসহ এ অঞ্চলের ৩৬টি নদী কার্যত মরে গেছে। এসব নদীর তলদেশে এখন আবাদ হচ্ছে। আবার বালু খেকোদের থাবায় হচ্ছে ক্ষতবিক্ষত।
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের লাইফ লাইন এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা আজ মৃত নদীর নাম। ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে এ নদীর প্রাণ কেড়ে করে নিয়েছে ছেড়েছে। পদ্মার সাথে সাথে এর শাখা নদীগুলোর এখন অস্তিত্ব সংকটে। পানিহীন মৃত প্রায় নদীগুলো দখলদারদের থাবায় অস্তিত্ব হারাচ্ছে। দখলে রাজশাহীর নারদ, বারাহী, স্বরমংলা, দয়া, হোজা, মির্জা মাহমুদ, মুসাখান, সন্ধ্যা, হ্যালেঞ্জা নামের এ নয়টি নদীর অস্তিত্ব এখন আর নেই। বইয়ের পাতা থেকেও নামগুলো মুছে গেছে। আগামী প্রজন্ম জানবে না যে রাজশাহী অঞ্চলে এসব নদী ছিল।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল বলেন, ভারতের ফারাক্কা বাঁধ চালুসহ অন্যান্য নদ-নদীর উৎসমুখে বাঁধ, স্পার, রেগুলেটর নির্মাণ করে একতরফা পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এতে এদেশের নদ-নদীগুলো শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। ভারতের পানি আগ্রাসন নীতির কারণে বাংলাদেশের নদ নদীগুলোর মরন দশা শুরু হয়। এর সাথে যোগ হয়েছে আমাদের দেশের পরিকল্পনাহীন নদী শাসন, বাঁধ, ব্রীজ নির্মাণ। এর সাথে ভয়ংকর ভাবে যুক্ত হয় নদী খেকোদের দখল আর দুষন। নদী মাতৃক এ দেশ ধীরে ধীরে মরুতে পরিণত হচ্ছে। এ ব্যাপারে এখনই যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে অদূর ভবিষ্যতে এদেশের অনেক নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।
যে নদীতে পানি থৈ থৈ করতো তাতে এখন ধু ধু বালুচর। বিশাল বালুচর জানান দিচ্ছে এতো নদী নয় যেন ফসলের মাঠ। মাইলের পর মাইল জুড়ে জেগে ওঠা চর যেন মরু সাহারা। বিশাল বালুচরের যেখানে কিছু পলি পড়েছে সেখানে চাষে ঝাপিয়ে পড়েছে নদী পাড়ের সব হারানো মানুষ। প্রানান্তকর চেষ্টা মরুদ্যান বানানোর। ধান গম ডাল টমেটো সরিষাসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ করছে। সেচ দেবার জন্য নদীর বুক ফুড়ে বসিয়েছে শ্যালো টিউবওয়েল। নীচ থেকে পানি তুলে সেচ দিচ্ছে। এরাই একদিন ভরা পদ্মায় নৌকা নিয়ে মাছ ধরত, মালামাল ও যাত্রীবহন করত। নদী কেন্দ্রীক মানুষ তাদের পেশা হারিয়ে এখন অন্য কাজ করেছে।
মরণ বাঁধ ফারাক্কার কারণে বিগত প্রায় পাঁচ দশকে পদ্মা ও তার শাখা-প্রশাখাগুলো এখন মৃত। এক সময়ের যৌবনা আর দুরন্ত ছুটে চলা নদীগুলো এখন জীর্ণশীর্ণ খাল। শাখা প্রশাখা নদ নদী বড়াল, মরা বড়াল, মুছাখান, ইছামতি, ধলাই, হুড়াসাগর, চিকনাই, গড়াই, মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, নবগঙ্গা, চিত্রা, বেতা কালিকুমার, হরিহর, কালিগঙ্গা, কাজল, হিসনা, সাগরখালি, চন্দনা, কপোতাক্ষ, বেলাবত এদের অস্তীত্ব প্রায় বিলিন। বর্ষার সময় কিছু পানি থাকলেও সারা বছর থাকে শুকনো। নৌকা নয় এদের বুকে চলে চাষাবাদ। এক সময়ের খর¯্রােতা নদীটি এখন নর্দমার নাম নিয়ে বেঁচে আছে।
ভারতের পানি আগ্রাসী নীতি শুধু এ অঞ্চলের নদ নদীগুলোকে শুকিয়ে মারেনি। যার প্রভাব পড়েছে এসব নদীর সাথে সংযুক্ত খাল বিল। এসব শুকিয়ে গেছে। এ অঞ্চলের বিখ্যাত বিল যার বিস্তৃত জলরাশি দেখে বোঝার উপায় ছিলনা এটা বিল না নদী। চলনবিল, বিল হালতি, বিল হিলনা, মহানগর, বিলভাতিয়া, উথরাইল, খিবির বিল, চাতরা, মান্দার বিল, বিলকুমলী, পাতি খোলা, অঙ্গরা, চাঙ্গা, দিকমী, পারুল, সতী, মালসী, ছোনী, বাঘনদী, পিয়ারুল, মিরাট, রক্তদহ, কুমারীদহ, খুকসী, জবায়ের বিল, বাঁশ বাড়িয়া গ্রামের বিল এসব হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি থেকে। নদ নদী খাল বিলগুলোয় এখন বর্ষা মওসুমে কিছুটা পানি দেখা গেলেও শুকনো মৌসুমের আগেই শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।
নদী খাল বিল মরে যাওয়ায় প্রকৃতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এ অঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। অনাবৃষ্টির ফলে এ অঞ্চলের আমের ফলনে বিঘœ ঘটছে। আমের বাগানে সেচ দিতে হচ্ছে। নদী-নালা, খাল বিল শুকিয়ে যাওয়ায় মাছের পরিমাণ কমে গেছে। ইেিতামধ্যে দেশিয় প্রায় অর্ধশত প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে। মাছ বলতে এখন শুধু পুকুরে বা খামারে চাষ হওয়া মাছ পাওয়া যায়।
নৌ যোগাযোগ আর নেই। নদ নদী আর বিলের বুকে আবাদ হয় ধানসহ বিভিন্ন ফসলের। এতে আবাদী জমি বাড়ার সাময়িক প্রাপ্ত আর ফসল পেলেও সুদুর প্রসারী প্রভাব মারাত্বক হয়ে উঠেছে। চারিদিক থেকে পরিবেশ বিপর্যয় ধেয়ে আসছে। #
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন