বইমেলায় একটি স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে মোটামুটি ধরনের সফল একজন প্রকাশকের সাথে গল্প করছিলাম। কথা প্রসঙ্গে বইমেলার লাভ-লস নিয়ে আলাপ করছিলেন। তাঁর ভাষায়, তিন ধরনের লেখকের বই প্রকাশে বিনিয়োগে ঝুঁকি নেই। (১) সুন্দরী লেখিকা, (২) সেলিব্রিটি লেখক, (৩) শিল্পপতি বা ব্যাংকার লেখক।
প্রকাশকের কথার মোটামুটি প্রমাণ পেলাম ওইদিন সন্ধ্যায় তাঁর স্টলে একজন লেখিকার চারপাশে ঘিরে থাকা জটলা দেখে। বিষয়টি আরো কয়েকদিন খেয়াল করেছি। প্রথম প্রকাশিত কবিতার বই নিয়ে ওই লেখিকা-সুন্দরীর উচ্ছ¡াসের কমতি নেই। তিনি না যতটা; তারচেয়ে যেন তার আশেকান-মুরিদানের (!) উচ্ছ¡াসই বেশি। ছুটির দিন উপলক্ষে বিভিন্নস্থান থেকে আসা তাঁর ফেসবুক ভক্তরা বই কিনছেন। লেখিকা অটোগ্রাফ দিচ্ছেন, ফটোগ্রাফ নিচ্ছেন। যাদের মধ্যে নারী পাঠকের সংখ্যা একভাগও হবে বলে মনে হয় না। একফাঁকে তার বইটি হাতে নিয়ে দেখলাম, কবিতার মানের কথা নাই বা বললাম; মনকাড়া হাসি বা নারীসুলভ গুণে কিছু পাঠক তো জুটিয়েছেন, এটাই কম কী! পুরো বইমেলাজুড়ে নারী লেখকদের বেশকিছু বিষয়ের সাথে সবাই কমবেশি পরিচিত। নিজের বইয়ে নিজেই মডেলিং, বাহারী শাড়ি-গহনার প্রদর্শন, সেলফিতে বইমেলা যেন ভিন্নমাত্রা পায়। এসব নিয়ে সমালোচকদের জবাবও দিতে ছাড়েন না কোনো কোনো লেখিকা। ফেসবুকে দেখলাম এক লেখিকা রাগ ঝাড়ছেন এই বলে যে, ‘যাদের বই বিক্রি হয় না, তারাই নাকি জনপ্রিয় লেখিকাদের বই বিক্রি দেখে হিংসায় জ্বলছেন।
এবার আসি প্রকাশক সাহেবের দ্বিতীয় কথা অর্থ্যাৎ সেলিব্রিটি লেখক প্রসঙ্গে। একটি বিষয় লক্ষনীয় হলো, একসময় লেখকরা মেধা বা লেখার কারণে জনপ্রিয় বা সেলিব্রিটি হতেন। যেমন হুমায়ুন আহমেদসহ এরকম অনেকেই আছেন। আর এখন সেলিব্রিটিরা লেখক হচ্ছেন। তাঁরা নিজেরাও জানেন যে, সাহিত্য তাঁদের জন্য নয়। কিন্তু নিতান্তই শখের বসে অভিনেতা, গায়ক, খেলোয়াড়রা বই বের করছেন। এতে পাঠক লেখার চাইতে লেখকের জনপ্রিয়তাকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন, সেলিব্রিটি লেখকের সাথে সেলফিবন্দি হয়ে ফেসবুক ভরছেন; যা পাঠকের জন্য কোনোই কাজের না।
তৃতীয় প্রসঙ্গ অর্থ্যাৎ শিল্পপতি বা ব্যাংকার লেখক সম্পর্কে এবার আসি। একটি স্টলে বসে আছি, এমন সময় দুইজন লোক এসে প্রকাশককে একজনের নাম উচ্চারণ করে বললেন যে, স্যারের গল্পের বই কোনটা? প্রকাশক বইটি দেখানোর পর তাঁরা বললেন যে, কয় কপি আছে? প্রকাশক অনেক খুঁজে বিশটি বই বের করে বললেন যে, বইটি আজই শেষ হলো, মাত্র কয়েকটা আছে, বইটি রিপ্রিন্ট হচ্ছে। ওই লোক দু’জন বললেন, ‘বিশ কপি নিয়ে গেলাম, প্রিন্ট হলে আরো তিনশো কপি লাগবে।’ পরে শুনতে পেলাম, ওই লেখক একটা গার্মেন্টের মালিক, আর বই কিনতে আসা লোক দু’জন ওই গার্মেন্টের কর্মচারী। যেদিন ওই লেখক বইমেলায় আসেন, তখন ভিড় জমে যায়। এবার মূল কথায় আসি। যে গার্মেন্টের শ্রমিকরা কোনোরকম পঞ্চম বা অষ্টম শ্রেণি ডিঙিয়ে চাকরি নিয়েছেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যারা হাড়ভাঙা খাটুনি খাটেন, তাঁরা গল্প-উপন্যাসের কী বুঝবেন বা তাঁরা কখন-ই বা বই পড়বেন! মূলত স্যারের নির্দেশ, বই বেরিয়েছে কিনতে হবে। এরকম কিছু ব্যাংক মালিক বা উচ্চপদস্থ ব্যাংকার রয়েছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-অধ্যাপক রয়েছেন; যাঁদের বই প্রকাশ মানেই হলো প্রকাশকের পোয়াবারো। এরমধ্যে কোনো লেখক পাÐুলিপি কিনে বা টাকার বিনিময়ে ফরমায়েশি সাহিত্য লেখিয়ে বই প্রকাশ করেন। চটকদার বিজ্ঞাপনের স্রোতে রাতারাতি বড় লেখক বনে যান! আর চাকরির ভয় কিংবা বস বা স্যারকে খুশির করার জন্য ওইসব কথিত মানহীন বই অধস্তন কর্মচারী, শ্রমিক বা ব্যবসার সাথে সম্পৃক্তরা বাধ্য হয়ে কিনে থাকেন। অথচ ক্রয়কৃত বইগুলোর পাঁচভাগও পড়া হয় কি-না সন্দেহ।
সাহিত্য-জ্ঞানের সাথে শিক্ষাগত যোগ্যতা বা প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার তুলনা হয় না। সাহিত্য হলো সাধনার বিষয়। লেখকের সম্মান শুধুমাত্র লেখা দিয়েই অর্জন করে নিতে হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন