ফারাক্কার বাঁধসহ অন্যান্য নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের নদ-নদীর আজ মরণদশা। পদ্মা, তিস্তা, সুরমা, ব্রহ্মপুত্রসহ দেশের প্রায় সব নদীই এখন পানিহীন। নদীর বুকে ফসলের মাঠ, ধু-ধু বালুচর। অনেক নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নদীর মৃত্যুতে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকাও মারাত্মক হুমকির মুখে। দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। গ্রীষ্ম মৌসুমে পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে যাওয়ায় উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ নলকূপে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। দেখা দেয় তীব্র পানির সঙ্কট। উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের জীবনে অভিশাপ বয়ে এনেছে এই ফারাক্কা বাঁধ। নদীতে পানি কম থাকায় দক্ষিণাঞ্চলে বাড়ছে লবণাক্ততা।
মরণ বাঁধ ফারাক্কার ছোবলে নাব্যতা সঙ্কট ও দখলদারদের কবলে পড়ে রংপুর অঞ্চলের শতাধিক নদ-নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। পানির অভাব, অবৈধ দখলদারদের থাবায় ইতোমধ্যে অনেক নদ-নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। অনেকগুলো ইতোমধ্যে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। অর্ধশতাব্দী আগেও এসব নদীতে ছিল টলটলে পানির প্রবাহ। ছিল খরস্রোত, উত্তাল যৌবন। কিন্তু এখন সেই নদীতে পানি নেই। নদীর বুকে ধু-ধু বালুচর। ভরাট হয়ে অনেক নদীর অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পরিবেশ, কৃষি, নিম্ন আয়ের মানুষের সামাজিক জীবনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
দেশের উত্তর জনপদের প্রাচীনতম জনপদ উত্তরাঞ্চলের রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী জেলায় আছে অসংখ্য নদ-নদী। এর মধ্যে গাইবান্ধায় রয়েছে আলাই, ইছামতি, করতোয়া, কাটাখালি, কালপানি, গাংনাই বা খিয়ারী, ঘাঘট, তিস্তা, নলেয়া, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, মৎস্য, মরা, মরুয়াদহ, মাইলা মানাস, মাশানকুড়া, বাঙালি, লেঙগা, শাখা তিস্তা, হলহলি ইত্যাদি।
কুড়িগ্রামে আছে অন্তাই, কালজানি, কালো, কুরসা, কোটেশ্বর, খলিশাকুড়ি, অর্জুনেরডারা, গঙ্গাধর, গদাধর, গিরাই, গোদ্ধার, বোয়ালমারী, ঘড়িয়ালডাঙা, ঘাগুয়া, চন্ডিমারী, চাকিরপশা, চান্দাখোল, জালশিরা, জিঞ্জিরাম, তিস্তা, তোর্সা, দুধকুমার, দেউল, ধরণী, ধরলা, নওজল, নাগদহ, নীলকুমার, নাগেশ্বরী, পয়রাডাঙা, পাঁচগাছিরছরা, ফুলকুমার, ফুলসাগর, বামনী, বারোমাসি, বুড়িতিস্তা, বুড়া ধরলা, বোয়ালমারী, ব্রহ্মপুত্র, মহিশকুড়ি, রতনাই, শিয়ালদহ, সঙ্কোশ, সোনাভরি, হলহলিয়া, হাওরার বিল, হাড়িয়ার ডারা।
নীলফামারীতে আছে আউলিয়াখান, করতোয়া, কলমদার, কুমলাল, খড়খড়িয়া, খলিসাডিঙি, চারা, চারালকাঠা, চিকলি, চেকাডারা, তিস্তা, দেওনাই, ধাইজান, ধুম, নাউতারা, নেংটিছেঁড়া, বামনডাঙা, বুড়িখোড়া, বুড়িতিস্তা, বুল্লাই, যমুনেশ্বরী, শালকি, স্বরমঙলা।
লালমনিরহাট জেলার নদীর মধ্যে গিদারী, চতরা, ছড়াবিল, তিস্তা, ত্রিমোহনী, ধরলা, ভেটেশ্বর, মরাসতী, মালদাহা, রতনাই, সতী, সাকোয়া, সানিয়াজান, সিঙ্গিমারী, স্বর্ণামতী। রংপুরে আখিরা, আলাইকুড়ি, ইছামতি, করতোয়া, কাঠগড়ি, খাঁড়ুভাঁজ, খোকসাঘাঘট, ঘাঘট, ঘিরনই, টেপরীর বিল, তিস্তা, ধুম, নলশীসা, বুড়াইল, ভেলুয়া, মরা, মানাস, যমুনেশ্বরী, সোনামতি, শাখা চিকলি, শ্যামাসুন্দরী চিকলি, বুল্লাই, নলেয়া, খটখটিয়া, বাইশা ডারা, বুড়াইল, নেংটি ছেড়া ও মাশানকুড়া। এসব নদীর অধিকাংশই এখন পানি শূন্য। এসব নদীর বেশির ভাগই শুকিয়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উল্লেখিত নদীগুলোর মধ্যে মাত্র তিন-চারটি বাদে প্রায় সবক’টি নদীই এখন মৃতপ্রায়। এসব নদীতে এখন নাব্যতা নেই। পানির প্রবাহ না থাকায় ইতোমধ্যে কোনো কোনোটি নিজের অস্তিত্বও হারিয়ে ফেলেছে। ফলে এসব নদীতে জীবিকা নির্বাহকারী অসংখ্য জেলে পরিবার তাদের পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় জীবিকা নির্বাহ করছে। এক সময় এসব নদীর বুকে পাল তোলা নৌকা চলাচল করত। পারাপারেও ব্যবহার হতো ডিঙ্গি নৌকাসহ বড় বড় নৌকা। জেলেরা মাছ ধরত দিন-রাত। পানির অভাবে এখন এসব নদীর অধিকাংশেই মানুষ হেঁটে চলাচল করছে।
সর্বকালের সর্বনিম্ন পানিপ্রবাহ এখন তিস্তায়। একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে বাংলাদেশের ১১২ মাইল দীর্ঘ এই নদী শুকিয়ে এখন মৃতপ্রায়। সামান্য বর্ষার ছোবলেই ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করা করতোয়া নদীও এখন পানির অভাবে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। কোথাও নেই আগের সেই পারাপারের ডিঙ্গি নৌকা কিংবা পালতোলা নৌকা। রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ওপর দিয়ে এক সময় প্রবাহিত আলাইকুড়ি নদী এখন পরিণত হয়েছে মরা খালে। কালের আবর্তনে মরে যাচ্ছে রংপুরের গঙ্গাচড়ার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘাঘট নদী। পানিশূন্য হয়ে পড়ায় নদীটির বুকে আবাদ হচ্ছে বিভিন্ন ফসল। আর কয়েক বছর পর হয়তো মানচিত্র থেকেই হারিয়ে যাবে এই নদী।
নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছেন শত শত মৎস্যজীবী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব নদী খনন করা হলে মৎস্য, চাষাবাদসহ আবাদি জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা যাবে। এতে কৃষকরা উপকৃত হবে।
নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার কুড়িপাড়া গ্রামে তিস্তার শাখা নদী হিসেবে ঘাঘট নদীর উৎপত্তি। ঘাঘট নদী গঙ্গাচড়া উপজেলার পশ্চিম সীমানা দিয়ে নোহালী, আলমবিদিতর ও বেতগাড়ি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে রংপুর সদর হয়ে পীরগাছা উপজেলায় প্রবেশ করেছে। এরপর আলাইকুড়ি নদীর সঙ্গে গাইবান্ধা জেলার সাদুল্ল্যাপুর হয়ে যমুনায় মিলিত হয়েছে। নদীটির আঁকাবাঁকা পথে ১২০ কিলোমিটার শুকিয়ে গেছে। স্থানীয় লোকজন বলছেন, এক সময় এ নদীর ওপর দিয়ে পালতোলা নৌকা চলত। দূর-দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা আসতেন ব্যবসা করার জন্য। কিন্তু সেগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। পানির অভাবে শুকিয়ে যাওয়ায় দখলদারদের কবলে পড়ে এসব নদীর বুকে এখন গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসল চাষ হচ্ছে। নদীর বুক চড়ে বেড়াচ্ছে গরু-ছাগল।
সম্প্রতি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়া ‘মরা তিস্তা’ আর ‘ঘিরনই নদী’ খনন করে এ দু’টি নদীর নুতন জীবন দিয়েছে। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এ দু’টি শাখা নদীর প্রায় ১৭ কিলোমিটার অংশ দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এতে করে প্রায় দুই শ’ বছর পর জেগে উঠেছে মরা তিস্তা নদী। সেই সঙ্গে প্রাণ ফিরেছে ঘিরনই নদীরও। অথচ কিছু দিন আগেও এ নদী দু’টি ছিল অস্তিত্বহীন। এবার শুধু নদী খনন নয়, দুই পাড় সংরক্ষণ ও পরিবেশ উন্নয়নে তীরবর্তী এলাকায় বিভিন্ন ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া মরা তিস্তা নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিকলী ও যমুনেশ্বরী নদীর মূলধারা। এখন মরা তিস্তা নদীর বুকে খেলা করে হাঁস। বেড়েছে বক, পাতি সরালি, মাছরাঙার আনাগোনা। হরেক রকম পাখির দেখা মিলছে মরা তিস্তার বুকে। নদী গবেষক ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, জলের আধার, আমিষের উৎস এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে উদ্ধার হওয়া এ নদীটি। স্থানীয়রা বলছেন, এই নদী খননের কাজ করায় অনেক ভালো হয়েছে। নদীতে পানির প্রবাহ ঠিক থাকলে এ অঞ্চলের মানুষের অনেক সুবিধা হবে। শাখা নদীর পানি ব্যবহারের মাধ্যমে বড় পরিবর্তন আসবে এলাকার কৃষিকাজে। বদলে যাবে এই অঞ্চলের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি।
বরেন্দ্র অঞ্চলে খরার প্রভাব দূর করতে এভাবেই হারিয়ে যাওয়া ছোট নদীগুলোর প্রবাহ নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা। অন্যদিকে নদী গবেষকদের দাবি, নদী তীরবর্তী কৃষি, প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নদী উদ্ধার প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
হারিয়ে যাওয়া নদী উদ্ধারে মরা তিস্তা অনুকরণীয় হতে পারে বলছেন নদী গবেষকরা। রিভারাইন পিপল বাংলাদেশের পরিচালক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেছেন, নদীগুলো এ অঞ্চলের কৃষি, জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশের একটি অভাবনীয় ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে। দেশের প্রত্যেক এলাকার নদ-নদী বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে উত্তরের জীবনরেখা তিস্তা নদীকে ঘিরে প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন