বৃদ্ধা শ্যামাদাসী যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল চোত মাসের বেলা তখন খাড়াখাড়ি মাথার ওপর।যেমনি রোদ,তেমনি তার গা জ্বালানো তাপ।এমন একটা অসময়ে কেউ বাড়ি থেকে বেরোতে পারে তা ভাবতেই পারেনি দুখীরাম।দুখীরাম মানে দুখীরাম ঢালি।শ্যামাদাসীর প্রতিবেশী এই ছেলেটা একটু সময় পেলেই বাড়ি বয়ে এসে খোঁজ খবর নিয়ে যায়।তো সেই দুখীরাম বলেছিল,” এইভাবে ভরদুকুরি বাড়ি থ্যিকে বেরোচ্ছো?বেলাডা খানিক পইড়ে এলি বেরোলি হত না?
শ্যামাদাসী বলেছিল,” সে কী আর কম দূরির পথ রে ভাই?অহন না বেরোলি পৌঁছোবো কহন?”
“তবু এট্টাবার ভেব্যে দেকলি পারতে।”
“তুই আমার বাড়ি ডা এট্টু দেহে শুনে রাহিস ভাই।”
“আচ্ছা,রাখবানে।তা ক›দিনির জন্যি যাচ্ছো?”
“কী কইরে কই।কদ্দিন পর যাচ্ছি। দেহি।”
বুড়ি যাচ্ছে নতুনগ্রাম।ওখানে তার নাতনির বিয়ে হয়েছে।আপনজন বলতে এই জগৎ সংসারে ওই এক নাতনিই আছে তার।ছেলে,বৌমাকে কবেই হারিয়েছে বুড়ি।বাপ-মা মরা নাতনিরও এতদিন কাছের বলতে ছিল এই বুড়ি ঠাকুমা।এখন অবশ্য তার সংসার হয়েছে। স্বামী হয়েছে।একটা সন্তানও হয়েছে। তবু বুড়ির জন্যে আলাদা একটা ভালোবাসা রয়েই গেছে তার।এই বুড়ি ঠাকুমাই তো তাকে ছোট থেকে খাইয়ে পরিয়ে বড়ো করেছে।বুকের ওম দিয়ে,হৃদয়ের ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছে।আবার দেখে শুনে বিয়েও দিয়েছে একটা। বরের ঘর।চাষি বাসী সংসার।তবুও একটু সময় পেলেই নাতনি টা আসে।দু›দিন থেকে যায়।আর হাতে কিছু গুঁজেও দিয়ে যায়। সেইসঙ্গে একটা অনুযোগ ও করে, “তুমি আর বোধায় আমারে ভালোবাসো না,তাই নে?”
বুড়ি অবাক হয়, “ক্যান?এমন কথা কস ক্যান?”
নাতনি বলে, “আমার বে র পর সেই এট্টাবার আমার বাড়ি গেছো। কই,আর গেলা না তো?”
বুড়ি বলে, “ভাই রে,আমার কী আর সেই বয়াস আছে? এই শরীল নে› আমি পথে বেরোতি পারি?”
“অত কিছু আমি জানি নে।তুমি কবে যাবা কও।”
“আচ্ছা, ইবার যাবা নে।”
“মনে থায়ে য্যান।”
তাই বেরিয়েছে বুড়ি। কতদিন ধরে কেবল ভাবছিলো যাবে। কিন্তু সময়, সুযোগ কোনওটাই করে উঠতে পারছিলো না ঠিক মতন। একা মানুষের সংসার হলে যা হয়। এই বাড়িঘর কার ভরসায় রেখে বেরোবে? চোরে নেওয়ার মতন যদিও কিছুই নেই তার। তবু ভয় হয়। পেটে দু›বেলা চাট্টি দেওয়ার মত থালা, ঘটি তো আছে। আরও আছে একখানি লেপ, দু›খানি কাঁথা, দু›টো বালিস। কত রকমের চোর আছে দুনিয়ায়। বলা যায় কিছু?
শেষ মেষ দুখীরামের ভরসায় সবকিছু রেখে বেরিয়েছে বুড়ি। হাঁটতে হাঁটতে তিন তিনখানি গ্রাম পেরিয়ে এসেছে এর মধ্যেই। এখন সামনে কেবল ফাঁকা একখানি মাঠ। মাঠের পাশ দিয়ে ঘুরে গেলে আরও দু›খানি গ্রাম তাকে পেরোতে হবে। এতটুকু মাঠ তো আর নয়। আসলে সে বিরাট একখানি বিল। চোত মাসের দিন বলে এতটুকু জল তার তলানিতে পর্যন্ত নেই। এক বুক শূন্যতা নিয়ে সে শুয়ে আছে কেবল। এপার থেকে ওপারের গ্রামটাকে দেখলে মনে হয় এই তো সে কাছেই। কিন্তু আসলে সে অনেকখানি দূরে। একবার হাঁটা শুরু করলে পথ আর ফুরোতে চায় না। ব্যাপারটা যারা জানে তারা জানে।তবে বুড়ি শ্যামাদাসীর সে অভিজ্ঞতা নেই। আর নেই জন্যেই মাঠের কাছটি তে এসে একটিবার থমকে দাঁড়ালো।
এদিকে এতখানি পথ হাঁটার ক্লান্তিতে পা দু›খানি আর চলতে চাইছে না তার। গলাটাও শুকিয়ে এসেছে।সারা শরীরে কেমন এক জড়তার ছোঁয়া। খানিক জল খেলেও বেশ হত। কিন্তু তা খেতে গেলে বেশ খানিক পিছিয়ে যেতে হয়। তার চে’ বরং সামনে এগোনোই ভালো। মাত্র তো একখানি মাঠ। কতটুকুই বা আর সময় লাগবে।
একবার আকাশের দিকে তাকালো শ্যামাদাসী। ভরদুপুরের রোদের সে ঝলমলে ভাবটা আর এখন নেই। বরং কেমন একটা মিইয়ে আসা ভাব। আকাশের রং টাও কেমন ঘোলাটে হয়ে আসছে। সূর্য টা পশ্চিমে হেলে পড়েছে অনেকখানি। চারপাশে বেশ একটা কর্ম চঞ্চলতার ছবি। একঝাঁক শালিক উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে। ঘাড় নামিয়ে ফের একবার সামনের দিকে তাকালো বুড়ি। ওই তো,ওই দেখা যাচ্ছে গ্রাম টা। ওই যে অন্য গাছের মাথা ছাড়িয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে যে গাছ টা, ওর নিচেই তো জবাদের বাড়ি। হ্যাঁ,তার নাতনির নাম জবা। জন্মের পর লাল টুকটুকে দেখতে হয়েছিল বলে আদর করে এই নামটাই রেখেছিল বুড়ি।
জবার মা কালীতারা অবশ্য আপত্তি করেছিল শুনে। বলেছিল, “ইডা আবার এট্টা নাম হল?দুনিয়ায় নামের কী এতই অভাব পড়িছে?”
বুড়ি বলেছিল, “আমার নাতনি। আমার যা ভালো লাগে আমি সেই নাম রাখপো। তাতে কার কী?”
শ্বাশুড়ির মুখে এমন কথা শুনে কালীতারা আর কথা বাড়ানোর সাহস পায়নি।
আজ সে কালীতারাও নেই,আর তার স্বামী শশধরও নেই।জবাকে সেই ছোট থেকে বড়ো করেছে শ্যামাদাসীই।আর দেখে শুনে বিয়েটাও দিয়েছে তার।যদিও একটু দূর গাঁ।অনেকখানি পথ ভেঙে সেই গাঁয়ে পৌঁছোতে হয়।তবু নাতনি যে খেয়ে পরে ভালো আছে এতেই বুড়ি খুশি।বিয়ের সময় একটা খুঁত খুঁতুনি অবশ্য ছিল।আর সেজন্যেই বলেছিল,গ্ধ অতদূরির গাঁ।ইচ্ছে হলিই কী আর যেতি পারবো?এট্টু কাছে হলি হত না?”
দুখীরাম বলেছিল,গ্ধ তুমি না পারলি কী?জবা তো ঠিক আসতি পারবে।অত ভালো ঘর।অত ভালো বর।তাছাড়া জবারে ওরা সাজায়ে পরায়ে নে› যাবে।তুমি আর অমত কইরো না।”
অগত্যা রাজি হয়ে গিয়েছিল শ্যামাদাসী।মা-বাপ মরা নাতনি তার।খেয়ে পরে যদি ভালো থাকে এই তো বুড়ির সুখ।
পেছনের কথাগুলো ভাবতে গিয়ে কখন যেন সামনের কথা ভুলেই গিয়েছিল বুড়ি।যখন খেয়াল হল দেখলো অনেকখানি পথ সে পেরিয়ে এসেছে।যত বড়ো বলে ভেবেছিল মাঠটা যে তার চেয়েও ঢের বড়ো এখন বেশ টের পাচ্ছে তা।সামনের পথ টুকু কখন যে ফুরোবে।বুড়ি যতই হাঁটছে গ্রামটা সামনে থেকে ততই দূরে সরে যাচ্ছে যেন।এদিকে দিনের আলো বুঝি ফুরোতে এলো।গলাতেও কেমন শুকনো আর কেঠো একটা অনুভূতি। বাঁ কাঁধে ঝোলানো পুটুলিতে বিশ মনি ভার। পা দু›টোও বুঝি চলতে চাইছে না। (অসমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন