শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

কবি শামসুর রাহমান ও স্বাধীনতার কবিতা

রেশম লতা | প্রকাশের সময় : ১ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০৯ এএম

“আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?” এই আক্ষেপময় প্রশ্ন বাঙালি জাতি কেবল শামসুর রাহমানের কলমেই দেখতে পেয়েছে। ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য বাঙালি যে কতবার রক্ত ঝরিয়েছে তাঁর সাক্ষী স্বয়ং বাঙালি জাতি নিজেই। শামসুর রাহমান (১৯২৯- ২০০৬) বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে উজ্জ্বল এক নক্ষত্র। নাগরিক কবি বলে খ্যাত এই কবি তাঁর ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতায় স্বাধীনতা অর্জনে বাঙালির সংগ্রামী চেতনা এবং তাঁদের মহান আত্মত্যাগের মহিমা নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন।

তিনি তাঁর কবিতায় আপামর জনসাধারণকে যেভাবে এনেছেন অন্য কোন কবির লেখায় তা পাওয়া দুষ্কর। কবিতায় সকিনা বিবি, হরিদাসী, অবুঝ শিশু, থুত্থুড়ে বুড়ো, হাড্ডিসার অনাথ কিশোরী, সগীর আলী, মতলব, গাজী ও রুস্তমের মতো অসংখ্য নাগরিক চরিত্রের উপস্থিতি তাঁর সৃষ্টি কর্মকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। তাঁর চোখ উদাস দাওয়া থেকে মেঘনা নদী কোন কিছুই এড়ায়নি। কারণ তিনি কল্পনার রঙিন চশমা খুলে স্বচ্ছ খালি চোখে সমস্ত কিছু পরখ করেছেন। স্বাধীনতা কেউ কাউকে দেয় না। স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়। তবে বাঙালি জাতির মত অর্জিত স্বাধীনতা পৃথিবীর বুকে তা স্পর্শিত হয়নি।

কবি শামসুর রাহমান ছিলেন দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ। তিনি নিজেই যেন একটা ইতিহাস। শুধু অস্ত্রহাতে সম্মুখযুদ্ধ করলেই যোদ্ধা নয়, কলম যোদ্ধাও আছে। আর তিনি তাই-ই। স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস থেকে স্বাধীনতাকে রক্ষা ও অর্থবহ করে তুলতে প্রত্যেককে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত হতে আহ্বান জানানো এক কবির নাম শামসুর রাহমান। দেশ যখন উত্তপ্ত, ঢাকায় জারি হয়েছে কাউফিউ। দলে দলে মানুষ ছুটছে শহর থেকে গ্রামে সে সময় কবি শামসুর রাহমান লিখে যান অমর কবিতাগুলি। তিনি বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক যুগশ্রেষ্ঠ কাব্যের রচয়িতা।

পাক-হানাদার বাহিনী এ দেশের উপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। পুড়িয়েছে শহর, বন্দর, গঞ্জ। মায়ের কোল হতে দুধের শিশুটিকে কেড়ে নিয়ে আঁছড়ে মেরেছে। পিতার সামনে মেয়েকে, স্বামী ও সন্তানের সামনে নারীকে করেছে ধর্ষণ। মিলিটারীরা একের পর এক গ্রেনেড হামলায় নিরীহ বাঙালির সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়েছে। লাশের গন্ধে চারিদিক বিষাক্ত। কবি মাছ খাওয়া ছেড়ে দিলেন। কবির মনে হতে থাকে যদি তিনি ইয়াহিয়ার মুখে এক দলা থুথু ছিটিয়ে আসতে পারতেন তাহলে তাঁর মন শান্তি পেত। কিন্তু তিনি কেবল কলম চালাতে পারেন, আশা জাগাতে পারেন নিরস্ত্র বাঙালীদের। তাইতো পাকিস্তানী হানাদাররা বর্বর ধ্বংসলীলা চালিয়েও বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে পারিনি। কেননা বাঙালি আশাহত হয়নি। একদিকে বিসর্জন অন্যদিকে সম্মুখ যুদ্ধের সাহস আর বীরত্ব। ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতার মতোই বহুশ্রেণির বহু মানুষের একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার ফলে অর্জিত হয়েছে এই স্বাধীনতা।

শামসুর রাহমান ছিলেন সমকালীন সমাজ সচেতন কবি। তাঁর কবিতায় প্রেম, বিরহ, নৈস্বর্গিকতা, হাসি-কান্না, নাগরিক জীবনের সুখ-দুঃখ এবং তৎকালীন শাসকদের প্রতি তীব্র ঘৃণা উচ্চারিত হয়েছে। তিনি স্বাধীনতার প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরেছেন। যে কোনো মূল্যে স্বাধীনতাকে চাই-ই চাই। তাঁর লেখায় স্বাধীনতার যে প্রবল আগ্রহ তা স্বাধীনতা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, অভিব্যক্তি এবং স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর কবিতা পড়লেই পাঠক মনে একটা দোলাচল অনুরণিত হয়। চোখে ভাসে একাত্তরের পটভূমি। কবি শামসুর রাহমানের লেখা সকল কবিতাগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে সেগুলির যে সফলতা তাঁর অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও স্বাধীনতা নির্ভর কবিতা।

পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলছে
ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,
নতুন নিশান উড়িয়ে দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়

তোমাকে আসতেই হবে হে স্বাধীনতাগ্ধ।
কবি শামসুর রাহমান জোর গলায় বলেছেন, বাঙালি বুঝে গেছে স্বাধীনতা যে তাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। এইসব আশা-আকাঙ্ক্ষা, শ্রম, ত্যাগ বৃথা যেতে পারে না। বিজয় কেতন উড়িয়ে দামামা বাজিয়ে স্বাধীনতা এখানে প্রবেশ করবেই। বাঙালির রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা হবেই হবে। এবং স্বাধীনতা এসেছেও। হয়েছে দেশ স্বাধীন।

পৃথিবীর বুকে যখন নতুন একটি দেশের নাম ঘোষিত হল তখনই তিনি লিখে ফেললেন
“তুমি ফিরে এসেছ তোমার লাল সূর্য আঁকা পতাকার ভেতরে ফিরে এসেছ তোমার অনাহারী শিশুটির কাছে ফিরে এসেছ তোমার প্লাবন কোমল পলিমাটিতে”।

কবি শামসুর রাহমান কলম থামাননি। বাহিরে বোমার আওয়াজ ফুটছে তাতে তাঁর কোনো কর্ণপাত নেই। লড়ে গেছেন অধিকারের লড়াই। কন্ঠে তার প্রতিবাদী সুর অত্যাচারের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, শোষকদের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতা তুমি, বন্দী শিবির থেকে, তুমি বলেছিলে, তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা ইত্যাদি শামসুর রাহমানের উল্লেখযোগ্য মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কবিতা।

তাঁর কবিতায় নাগরিক জীবনের একঘেয়েমী, ক্লান্তি, নৈরাজ্যতা, নৈরাশ্যবাদ, যান্ত্রিকতা সমস্তকিছুই উঠে এসেছে। যে কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সেই কন্ঠে দেখা গেছে দেশপ্রেমের গান। বাংলা সাহিত্য যতদিন বেঁচে থাকবে কবি শামসুর রাহমান ততদিন বেঁচে থাকবেন, বেঁচে থাকবে স্বাধীন একটা দেশের নাম বাংলাদেশ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন