শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

বরেন্দ্র অঞ্চলে বৈরী আবহাওয়া ফল ও ফসল আবাদ হুমকিতে

অনাবৃষ্টিতে নেমে গেছে ভূগর্ভস্ত পানির স্তর

রেজাউল করিম রাজু, রাজশাহী থেকে | প্রকাশের সময় : ৭ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০০ এএম

বরেন্দ্র অঞ্চলে বিরাজ করছে বৈরী আবহাওয়া। চৈত্রের শুরু থেকেই গরমের দাপট। বৃষ্টির দেখা নেই প্রায় চার মাস। পানির একমাত্র উৎস্য ভূগর্ভের পানির স্তরও নামছে আশঙ্কাজনকভাবে। এদিকে ফসল বাঁচানো ছাড়াও নিত্যদিনের ব্যবহারের পানি নিচ থেকে উঠানো হচ্ছে। কোথাও কোথাও গভীর নলকূপেও পানি উঠছেনা।
বর্তমানে মাঠভরা বোরো ধানের চারা। খরা থেকে বাঁচাতে সেচের পরিমাণ বেড়েছে। ফলে বেড়েছে আবাদের খরচ। বরেন্দ্র অঞ্চলের আরেকটি অন্যতম ফল আম। প্রচন্ড খরতাপে আমের গুটি ঝরে পড়ছে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোরজুড়ে রয়েছে আমের বাগান। এবার শুরুতে গাছে গাছে ভাল মুকুল এলেও বৈরী আবহাওয়ায় কাঙ্খিত গুটি মেলেনি। যা এসেছে তা খরতাপ সহ্য করতে না পেরে ঝরে পড়ছে। গুটি বাঁচাতে আম বাগানেও সেচ দিতে হচ্ছে।

চলতি বোরো মৌসুমে রাজশাহী অঞ্চলের চার জেলায় সাড়ে তিন লাখ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। অন্যাদিকে আমের জমির পরিমাণও বেড়েছে। বিশেষ করে ধান উৎপাদনকারী এলাকা হিসাবে খ্যাত নওগাঁয়। এ অঞ্চলে আমের আবাদ হচ্ছে ৮৫ হাজার হেক্টর জমিতে। আম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনিতে এবার ৪০ শতাংশ গুটি এসেছে। টানা বৃষ্টিহীনতায় গুটি ঝরে যাচ্ছে।
আবহাওয়া বিভাগের মতে, প্রায় চার মাস ধরে রাজশাহীতে বৃষ্টি নেই। বৃষ্টি ও ঝড় হয়েছিল গত বছরের নভেম্বরে। এরপর বৃষ্টি হয়েছিল গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মাত্র চার মিলিমিটার। গত মাসের পুরোটাই গেছে বৃষ্টিহীন। এবার ফাল্গুন থেকেই আবহাওয়ায় আগুন ঝরতে শুরু করেছে। এ অঞ্চলের প্রকৃৃতি আরো রুক্ষ হয়ে উঠেছে।
এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা আর্শীবাদ হলেও ফারাক্কার কারণে মরে যাওয়ায় অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পদ্মা মরে যাবার সাথে সাথে শাখা নদী খাল বিল দিঘীও মরে গেছে। ফলে পানির জন্য হাহাকার চলে বছরের সিংহভাগ সময়জুড়ে। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় আবহাওয়া রুক্ষ হচ্ছেই। নিচ থেকে পানি তোলা হলেও তা পূরণ হচ্ছে খুব কম। প্রতিবছর পানির স্তর নামছে। বৃষ্টিপাতে ভূগর্ভস্ত পানির গড় পূণঃভরনের হার দেশে পঁচিশ শতাংশ হলেও বরেন্দ্র অঞ্চলে এ হার মাত্র আট শতাংশ। বরেন্দ্রের উঁচু এলাকায় পানির সঙ্কট প্রকট।

নথিপত্রে দেখা যায় ১৯৮০ সালে বরেন্দ্রে অঞ্চলে পানির স্তর ছিল ৪০ ফুট নিচে। আর ২০১৬ সালে ১১৮ ফুট নিচে নেমে যায়। এখন কোথাও কোথাও ১৬০ থেকে ১৭০ ফুট নিচে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানি সঙ্কটে আগে বরেন্দ্র অঞ্চলে আবাদ বলতে ছিল বৃষ্টি নির্ভর ফসল। বি¯ৃÍর্ণ এলাকা ছিল অনাবাদী।

১৯৮৫-৮৬ সালে অনাবাদি এসব জমিকে সবুজে ভরিয়ে তোলার জন্য গভীর নলকূপ বসানো শুরু হয়। অনাবাদী রুক্ষ জমি সবুজে ভরে ওঠে। তিন চার ফসল উপহার দিতে থাকে। কৃষকের কাছে আর্শীবাদ হয়ে দেখা দেয়। শুরুতে ২৫ থানা নিয়ে কার্যক্রম শুরু হলেও এর সুফল দেখে পুরো উত্তরাঞ্চল চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে পঞ্চগড় পর্যন্ত ১৬ জেলা নিয়ে শুরু হয় বিশাল কর্মকাণ্ড। দেশের খাদ্য ভাণ্ডারে যোগ হয় বিপুল পরিমান নানামুখি ফসল।

বিশেষ করে ধান আবাদের প্রয়োজনে প্রকল্প বিস্তার লাভ করে উত্তরের ১৬ জেলায়। শুধু সেচ নয় অন্যান্য কর্মকাণ্ড যুক্ত হয় প্রকল্পে। ঠাঁ ঠাঁ বরেন্দ্রেকে সবুজীকরণ, খাদ্য উৎপাদন, চলাচলের রাস্তা নির্মাণ, খাবার পানি সরবরাহসহ নানা প্রকল্প নিয়ে সমন্বিত বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রকল্প কাজ শুরু হয়। উত্তরের জেলাগুলোয় আঠারো হাজারের মত গভীর নলকূপ দিয়ে সেচ ব্যবহার গড়ে ওঠে। শুধু বরেন্দ্র প্রকল্প নয়, ব্যক্তি মালিকানায় পাম্প বসিয়ে শুরু হয় পানি তোলা। এমনকি সাবমার্সিবল পাম্প বসিয়ে চলে নীচ থেকে পানি তোলা। ক্রমাগত পানি তোলা আর পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাবে রিচার্জ না হওয়ায় পানির স্তর ক্রমশ: নামতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ২০১২ সালের জুন মাস থেকে বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বরেন্দ্র অঞ্চলে নতুন করে গভীরনলকুপ বসানো বন্ধ করে দেয়। তারপরও এখনো প্রকল্প এলাকায় পনের হাজার গভীর নলকূপ দিয়ে সেচ ব্যবস্থপনা চলছে। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশীদের কথা হলো, আবাদ করতে হলে সেচ ব্যবস্থাপনা লাগবে। নিচ থেকে পানি উঠাতে হবে। বৃষ্টির অভাবে রিচার্জ হচ্ছে কম। ফলে স্তর নামছে। আমরা সেচ কম লাগে এমন ফসল আবাদের জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করছি। বরেন্দ্রের কিছু এলাকায় পানি না পাওয়ার চিত্রটি পুরো বরেন্দ্র এলাকার নয়। তাছাড়া বরেন্দ্র প্রকল্প ছাড়াও ব্যক্তি মালিকানায় পাম্প বসিয়ে পানি তুলে নানা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনি বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সরওয়ার জাহান সজল বলেন, এ অঞ্চলে যেভাবে পানি তোলা হচ্ছে তা উদ্বেগজনক। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় যে হারে পানি তোলা হচ্ছে তার খুব সামান্য রিচার্জ হচ্ছে। নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি অ্যাড. এনামুল হক বলেন, ভারতের ফারাক্কা বাঁধ প্রধান নদী পদ্মাকে মেরে ফেলেছে। যার ফলে দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে। সর্বত্র বিরূপ প্রভাব বিরাজ করছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন