গোটা বিশ্ব যখন শতাব্দীর ভয়াবহতম মহামারি অতিক্রম করছে; তখন নানা দূষণে দূষিত হয়ে পড়েছে আমাদের গ্রহ; ক্রমেই বাড়ছে ক্যান্সার, হাঁপানি, হৃদরোগের মতো রোগ। এমন পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বর মতো আজ বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ২০২২’। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘আমাদের গ্রহ, আমাদের স্বাস্থ্য’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবীর বসবাসকারী মানুষদের সুস্থ রাখতে প্রয়োজনীয় জরুরি পদক্ষেপগুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। বিশেষ করে পরিবেশ দূষণ কমিয়ে আনতে পারলেই এই গ্রহ গ্রহের মানুষদের সুস্থ রাখা সম্ভব বলে মনে করে সংস্থাটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে ১৩ মিলিয়নেরও বেশি মৃত্যু পরিহারযোগ্য পরিবেশগত কারণে হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে জলবায়ুু সঙ্কট যা মানবতার মুখোমুখি একক বৃহত্তম স্বাস্থ্য হুমকি। জলবায়ু সংকটও একটি স্বাস্থ্য সঙ্কট। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং বাণিজ্যিক সিদ্ধান্তগুলো জলবায়ু এবং স্বাস্থ্য সঙ্কটকে চালিত করছে। জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর ফলে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ অস্বাস্থ্যকর বাতাসে শ্বাস নিতে বাধ্য হচ্ছে। একটি উত্তপ্ত বিশ্ব দেখছে, মশা আগের চেয়ে অনেক বেশি এবং দ্রুত রোগ ছড়াচ্ছে। আবহাওয়ার বিরুপ প্রভাব, ভূমি ক্ষয় এবং পানির অভাব মানুষকে বাস্তুচ্যুত করছে এবং তাদের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করছে। দূষণ এবং প্লাস্টিক গভীরতম মহাসাগরের তলদেশে পাওয়া যায়, সর্বোচ্চ পর্বত এবং আমাদের খাদ্য শৃঙ্খলে তাদের পথ তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের এক তৃতীয়াংশ তৈরি করে ক্যান্সার এবং হৃদরোগ বাড়াচ্ছে।
এছাড়া বিশ্বব্যাপি ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন মানুষ এখনো নিরাপদ পয়ো (স্যানিটেশন) ব্যবস্থার বাইরে রয়েছে। যা সামগ্রীক ভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্যর ওপর নেতিবচক প্রাভাব বিস্তার করছে। এমনকি বিশ্বব্যাপী দুই বিলয়ন মানুষ বিশুদ্ধ পানি পানের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শুধু বিশুদ্ধ পানি এবং পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে বছরে অন্তত ৮ মিলিয়ন মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বন্যা ইত্যাদি কারণে দুই বিলয়ন মানুষ ডেঙ্গু ভাইরাসের ভয়বহ সংক্রমণের ঝুঁকিতে বসবাস করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের দেশে বায়ুদূষণের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ইটভাটা, দীর্ঘমেয়াদি অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ কার্যক্রম, ময়লা-আবর্জনায় আগুন দেয়া, ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির কলো ধোয়া ইত্যাদি। এছাড়া নির্বিচারে বনায়ন ধ্বংস করা, যত্রতত্র গাছ কেটে ফেলা, প্রয়োজনীয় বৃক্ষরোপণ না করা ইত্যাদি পরোক্ষভাবে বায়ুদূষণের কারণ।
বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগের কারণে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় তার অন্যতম কারণ বায়ুদূষণ। এই অতিক্ষুদ্র কণা এতোটাই ক্ষুদ্র যে এটি সহজেই মানুষের চোখ-নাক-মুখ দিয়ে প্রবেশ করে রক্তের সাথে মিশে যায়। যা ফুসফুস, হৃদযন্ত্র, কিডনি লিভারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জটিল অঙ্গকে আক্রান্ত করে থাকে। এমনকি দূষিত বায়ু সেবনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য। গর্ভপাত, জন্মগত ত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বায়ুুদূষণ নেতিবচক প্রভাব রাখছে।
সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার’ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। বিশ্বের ১১৭টি দেশ-অঞ্চলের ৬ হাজার ৪৭৫টি শহরের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রায় ৪০ হাজার শিশুর মৃত্যুর প্রধান কারণ বায়ুদূষণ। ওই বছরে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুর মান সবচেয়ে খারাপ ছিল। বিশ্বের ৫০টি সবচেয়ে দূষিত শহরের মধ্যে ৪৬টিই এই অঞ্চলে অবস্থিত। সবচেয়ে দূষিত শহর হিসাবে এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ঢাকার নাম।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স ডিপার্টমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামান বলেন, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য নির্মল পরিবেশ অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে বায়ুদুষণ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কারণ আছে। বিশেষ করে দেশের শহরগুলো বায়ুদূষণের আঁধার। নগরগুলোতে বায়ুদূষণের প্রধান কারণ পরিবহন জ্বালানি। এছাড়া নগর উন্নয়ন ও এক্ষত্রে করণীয় হলো উন্নয়ন কার্যক্রমনের সময় পরিবর্তন করা, এছাড়া বাতাসে কার্বন কমাতে ট্রাফিক জ্যাম দূর করতে হবে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যহানীর ক্ষেত্রে পনির দূষণ আরেকটি বড় করান। পানি ফুটাতে প্রচুর জ্বালানি ব্যয় করা হয়, যা বাতাসে কার্বনের মাত্রা বাড়াচ্ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। এই দূষণ নিয়ন্ত্রণ আনতে সর্বস্তরে বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করতে হবে।
প্রাভা হেলথের চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. সিমীন মজিদ আখতার বলেন, মানব সৃষ্ট দূষণ পৃথিবীর পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানের জন্য খুবই ক্ষতিকর। বায়ু, পানি, তেজস্ক্রিয় ইত্যাদি দূষণ জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি বিভিন্ন মরণব্যাধির জন্ম দিয়ে মানবস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। অন্যদিকে, অস্বাভাবিক জীবনযাপন ও অস্বাস্থ্যকর খাবার তো আছেই। তিনি বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, আমরা বিপদের সম্মুখীন হওয়ার আগে সচেতন হই না। কিন্তু এই গ্রহের ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে সচেতনতা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশের সুরক্ষা বলয় মজবুত করা, মানুষের দৈনন্দিন লাইফস্টাইল ও খ্যদ্যাভ্যাস স্বাস্থ্যকর করে তোলা, চিকিৎসাখাতে প্রযুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটানো, এই সবই একে অপরের সাথে জড়িত। বিশ্ব ও মানবস্বাস্থ্যকে রক্ষা করতে এসব করতেই হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে, নিজেদের সুস্থ রাখতে পরিবেশের সুস্থতা প্রয়োজন, আর মানবসভ্যতাকে বাঁচাতে হলে আগে বাঁচাতে হবে বিশ্বকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের সামনে বিশ্বের বৈষম্যগুলোও তুলে ধরেছে। মহামারিটি সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রে দুর্বলতা প্রকাশ করেছে এবং পরিবেশগত সীমা লঙ্ঘন না করেই এখন এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ন্যায়সঙ্গত স্বাস্থ্য অর্জনে প্রতিশ্রুতবদ্ধ টেকসই সুস্থ সমাজ গঠনের উপর জোর দিয়েছে। একটি সুস্বাস্থ্যের অর্থনীতির লক্ষ্য হিসাবে মানুষের মঙ্গল, সমতা এবং পরিবেশগত স্থায়িত্ব থাকে। এই লক্ষ্যগুলো দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, কল্যাণ বাজেট, সামাজিক সুরক্ষা এবং আইনি ও আর্থিক কৌশলগুলোতে অনুবাদ করা হয়। গ্রহ এবং মানব স্বাস্থ্যের জন্য ধ্বংসের এই চক্রগুলো ভাঙার জন্য আইনি পদক্ষেপ, কর্পোরেট সংস্কার এবং ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যকর পছন্দ করার জন্য সমর্থন এবং উৎসাহিত করা প্রয়োাজন।
দিবসটি উপলক্ষ্যে আজ সকাল ১১ টায়, ওসমানী মিলনায়তনে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ২০২২’ উপলক্ষে আলোচনা সভায় আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন