সড়ক দুর্ঘটনায় মূল্যবান প্রাণহানিকে কেবলই দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার কোনো কারণ নেই। দেশের সড়ক-মহাসড়কে এমন অনেক দুর্ঘটনা ঘটে, যেগুলোকে দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকাণ্ড বলা যায়। কদিন আগে রাজধানীর খিলক্ষেত থানা এলাকার উড়ালসেতু থেকে ৩০০ ফুট সড়কে নামার সময় দুর্ঘটনার শিকার হয় মীম। সে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। স্কুটি চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিল। মীমের মৃত্যুর পর তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক লিখেছেন, ‘...কেন একটা ন্যূনতম নিরাপদ সড়ক বানাতে পারিনি আমরা? নিজেকে এই প্রশ্নগুলো করেন প্লিজ। মনে পড়ছে, ২০১৮ সালে কুড়িলেই যে স্কুলছাত্রীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়কের জন্য ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেই মেয়ের নামও ছিল মিম... এবারও আরেক মীমের মৃত্যু হয়েছে! নিরাপদ সড়ক কি পাব না!’
নিরাপদ সড়কের প্রশ্নটাই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। নানা ব্যবস্থা নেওয়ার পরও সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে দেশজুড়ে। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা, শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনগণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি ইত্যাদি কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করেন সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ চালকের বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। আমাদের দেশে চালকদের বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা। গাড়িচালকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অন্তত এসএসসি নির্ধারণ করার আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। পাঠ্যপুস্তকে ট্রাফিক আইন ও নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে। আদালতের সেই নির্দেশনা কি মানা হচ্ছে? মালিকরাও সাধারণত চালকের দক্ষতা, কল্যাণ ও শৃঙ্খলার প্রতি উদাসীন।
দেশের কোনো না কোনো স্থানে প্রতিদিনই কারও না কারও জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে ‘দুর্ঘটনা’ নামক দানবের হাতে। এক হিসাবে দেখা যায়, গত ১৫ বছরে দেশে প্রায় দেড় লাখেরও বেশি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এতে ৫০ হাজারের বেশি লোক প্রাণ হারায়। আহতের সংখ্যা এর চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে প্রতিবছর দেশের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ শতাংশ। চালকের বেপরোয়া গতিই এই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এছাড়া নাজুক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত সমস্যা, পরিকল্পনা ও নীতির দুর্বলতা, অসচেতনতা ইত্যাদি বিষয় সড়ক দুর্ঘটনা ত্বরান্বিত করছে। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কর্তৃপক্ষকে সেসব সমস্যা দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, এক বছরে প্রায় ২০ হাজার ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ হাজার মানুষ নিহত হয়। আহত হয় এক লাখ। এদের বেশিরভাগই পঙ্গুত্ববরণ করে।
সুষ্ঠু ও নির্বিঘ্ন যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য সমন্বিত ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা জরুরি। দুর্ঘটনা রোধে চালক ও পথচারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যানবাহনের উচ্চগতি দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। জেব্রা ক্রসিং ও ফুটওভার ব্রিজ ছাড়া রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে হবে। যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া যাবে না। ফুটপাথগুলো দখলমুক্ত করে পথচারী চলার উপযোগী করতে হবে। তুলে দিতে হবে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন। রাস্তা চলাচলে আইন অমান্যের জন্য আরও কঠিন শাস্তি ও জরিমানা আদায় করতে হবে। তাছাড়া রাস্তায় যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং, ফুটপাথ দখল করে ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালনা, একই রাস্তায় নছিমন-করিমনসহ বিভিন্ন গতির যানবাহন চলাচল, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি, চালকের মাদকাসক্তি ইত্যাদি কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তির কখনো কোনো শাস্তি পেতে হয় না। এ জন্য বেপরোয়াভাবে চলছে সবকিছু।
সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক মানুষের হতাহতের ঘটনা নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়াও দুষ্কর। প্রথা অনুযায়ী দুর্ঘটনাকবলিতরা অনেক সময় এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ করে না। অনেক সময় অভিযোগ করলেও সেটি চলে যায় গোপনীয়তার স্তরে। তারপরও সড়ক দুর্ঘটনার যে চিত্র প্রকাশ্যে আসছে তা আতঙ্কজনক। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে এমন একটি সংস্থার তথ্যানুযায়ী বিদায়ী ২০২১ সালে সারা দেশে ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৯ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৬ হাজার ২৮৪ জন। আহত হয়েছে ৭ হাজার ৪৬৮ জন। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেলে। যার সংখ্যা ২ হাজার ৭৮। যা মোট দুর্ঘটনার ৩৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এতে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ২১৪ জনের। যা মোট দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ৩৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৫২৩ জন পথচারীর মৃত্যু হয়েছে। যা মোট মৃত্যুর ২৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, সড়কের সাইন-মার্কিং-জেব্রা ক্রসিং চালক এবং পথচারীদের না মানার প্রবণতা, যথাস্থানে সঠিকভাবে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ না করাসহ নানা কারণে পথচারীরা সড়কে মারা যাচ্ছে। রাস্তায় হাঁটা ও পারাপারের সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা ও সড়কের ওপর হাটবাজার গড়ে তোলা ইত্যাদি কারণে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে। উদ্বেগজনক তথ্য হলো করোনাকালেও ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এ সময়ে প্রাণহানি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর গড়ে ৮ হাজার পরিবার অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। হতাহতদের সিংহভাগই পরিবারের একমাত্র আয়ক্ষম ব্যক্তি। এ ট্র্যাজেডির অবসানে যানবাহন চালক, যাত্রী, পথচারী সবাইকে সচেতন হতে হবে।
কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠু ও সমন্বিত পদক্ষেপে দেশ দুর্ঘটনামুক্ত হবে এ প্রত্যাশা সকলের। দেশের মানুষ সড়কে নিরাপত্তা চায়। তারা এ ধরনের করুণ মৃত্যু আর দেখতে চায় না। আমরা সড়কে মৃত্যু দেখতে চাই না। দুর্ঘটনামুক্ত নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন