বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

কথন

শুভ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ৮ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০৭ এএম

দুপুর সোয়া বারোটার নাগাদ আরও এক অংশ মাটি পড়লো। বেশ বড় মাটির অংশ সেটি। একদম নীরবেই তলিয়ে গেলোÑ মনে হলো ঝোলা গুড়ের মাঝে বড় আকারের একটি ভারি লোহার দন্ড বা পাথর ধীর গতিতে তলাতে থাকে। ঠিক অই রূপ ধরেই বড় বড় কিছু গাছ-খুটি আর ক’য়েকটি দোকানঘর তলিয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে কেউ কেউ আহাজারির সুরে বলে উঠলোÑ “আহারে! আহারে!” আর কিছু বাচ্চাছেলের দল আনন্দ মুখে পতন উদযাপন করলো।

এর সবটাই দেখলো মাথিন ঠাই দাঁড়িয়ে। যেনো দেখাটাই তার এখন একমাত্র কাজ। কখনো এ প্রান্তে, কখনো আবার ও প্রান্তে। শুধু নীরস চোখে ফেলফেলিয়ে দেখে সে। কোথায় গেলো সেই সব ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট, ফেরি ঘাট, লঞ্চ ঘাট, টলার ঘাট, টার্মিনাল, মানুষ-জন, শোরগোল, হট্টগোল?

সবই ফুরিয়ে গেছে। প্রকাণ্ড যে গাছটি ছিলো, যাকে ঘাটের চিহ্ন হিসেবে আপছা দেখা যেতো নদীর ওপার থেকে- তাকেও খেয়ে নিলো এই পদ্মা।

এ দৃশ্য দেখে কেউ দোয়া-দরুদ পড়তে লাগলো। একজন বৃদ্ধ রস মুখে বলল- ‘এই মহিলার হইলো বিগার বেশি, ওর ত আর হাঙ্গা হয়নাই, বাকি সাত বইনেরই ভাতার আছে, খালি পদ্মারই নাই- বুঝলানি?’

তার পশে ভীড় করা মানুষ জন তার কথা ধরে এগোল না। শুধু একজন বালক টাইপের মুখ দিয়ে ক্ষীণ আওয়াজ করে বলল, ‘এহহহহহহহহ!’

বৃদ্ধের বালকের আওয়াজে আগ্রহ হলো না। তার আগ্রহ হলো জয়নালের কথায়। জয়নাল অল্প দূরে চায়ের টঙের উঁচু বেঞ্চিতে বসে, কথা টেনে টেনে দোকানিকে বলছে, ‘মরার লিগা অহনও বইয়া রইছনি? এইহান বিকাল তরি টিকবো না। এই ভাঙন সহজে থামনের না, এইবার আমাগো গ্রামও যাইতে পারে’

পাশ থেকে উঠে আর এক জন নরম করে বলল- ‘হ ডুবারুরা ত তাই কইল’
সেদিনের কথা- সকালের পর পলটন সমেত ডুবে গেলো ভাঙনে। সঙ্গে আরো কিছু লোক। যেহেতু পলটন ডুবে না- উল্টে ভেসে উঠলো, কিন্তু লোকগুলো আর উঠলো না।

শোনা গেলো একজন বি আর টি’র কর্মকর্তা নাকি ছিলো। দু’জন হকার, একজন লঞ্চের টিকিট বিক্রেতা, একজন সিবোর্ড চালক।

সঙ্গে সঙ্গে দেখার জন্য যারা ছুটে এলো, তাদের মধ্যে আরও একজন চোখের পলকে নদীর নিচে চলে গেলো। লোকজন সব আশ্চর্য হলো এই দৃশ্য দেখে। তারা আতঙ্কে দাঁড়ানো স্থান থেকে বেশ পিছে সরে এলো। কেউ কেউ গভীর বিষ্ময়ে চেয়ে রইলো কিছু ক্ষণ। তারপর যতক্ষণ খোঁজা হলো লোকজনের মুখে তার নামটিই উচ্চারিত হলো বেশির ভাগ। ছেলেটা সবে বিয়ে করেছে, মাস খানেকও হয়নি। খবর পেয়ে বউটা দিনভর অই পাড়েই বসে রইলো পাথর চোখে, মুখে কোনে শব্দ করলো না।

ডুবারু দু’জন উঠে এলে নতুন কথা শোনা গেলো। তা হয়তো লোকের মুখেই এমন দাঁড়ালো- “এই ঘাট পাড়ের তল থেইকা ওই গ্রামের শ্যাষ অব্দি- তার থেইকাও বেশি হইতে পারে, বুজলানি? পুরাডাই খোল কইরা খাইয়া নিছে, মনে হয় নাকি গ্রামের নিচে আর একটা দ্যাশ। দ্যাশ? হ হ অচিন দ্যাশ, লাশের দ্যাশ। কত লাশ নাকি পইড়া আছে বালিতে। পানির ধোয়ায় লাশের শরীর নাকি দবদব করে, জ¦ল জ¦ল করে নাকি চোখ। একটা লাশও গলে নাই। এত লাশ কই থেইকা আইল? খোদায় জানে মিয়াসাব। এইসব কুদরাতি বিষয়। হ হুনলাম গ্রামের তলের মাঝ বরাবর কী যেন দ্যাখছে তারা। কামেল ধাঁচের দ্যাখতে। হাতে শিকল চিকচিক করে। কও কী তুমি! ক্যান তুমি দ্যাখ নাই ডুবারু গুলির জিবলা ক্যামন বাইর হইয়া আইছিল দম টানতে টানতে। আর চোখ গুলি হইছিল রসগোল্লা?। হ হইছিল ত”

তার শক্তির কথাও বিবৃতি করা হয়। তবে জয়নাল বেঞ্চিতে বসে তার নিজ অভিগতার কথাই বলল। প্রসঙ্গ তেমন কিছু পাল্টায়নি। বলল- ‘আরে ব্যাডা মাপতে ত আমি নিজেই দেখছি। মাস ছয়েক আগের কথা। তহন আমি নাইডে ডিউটি করি। বাপরে বাপ, শিকলের কী ঝনঝনানি!’
একজন প্রশ্নে বলল, ‘তুমি কি সব পষ্ট দ্যাখলা মিয়াভাই?’

‘ধুর ব্যাডা এই জিনিস কী একবারে পষ্ট দ্যাহা যায়! যা দেখছি তা’ই ত ভুলিনা। শিকল নিয়া বুড়ি ক্যামনে দৌড়ায় বেড়াইল! থাকব নারে, কিচ্ছু থাকব না’

পাড় থেকে প্রায় দুইশ মিটার দূরে একটা মসজিদ এখনো তলায়নি, বিচ্ছিন্ন দীপের মতো জেগে আছে। মানুষের এনিয়ে বিষ্ময়ের শেষ নেই। বিষ্মায়ীত হবার মতোই কথা। যেখানে এর চাইতে বড় আরো দুই একটি ইমারত ছিলো, যা টেকেনি। অথচ মসজিদটি এখনো দাঁড়ানো। এ দৃশ্যে মানুষের শক্তি বাড়াটাই স্বাভাবিক। গর্বে বলে, “আল্লার কাছে সব আছে। আল্লায় পারে না এমুন কুনো কাম নাই। আল্লার ঘর আল্লায় রাখব”

ওদের সঙ্গে ‘আছে আছে’ বলে পাগলিটাও চিৎকার করে। কী আছে, মসজিদ নাকি তার লাগোয়া অর্ধ ভাঙা একচালা ঘর?

দুটি বস্তু পাশাপাশি থাকায় পাগলির আঙুল আর চোখের ইশারা নির্দিষ্ট বোঝা গেলো না ঠিকই, কিন্তু মানুষ যে একেবারে বুঝলো না তা বলাও ভুল হবে। অই রাতের পর এঘটনা নিয়েও কানাঘুসা হয়েছিলো কিছু। পাগলিটা ঘরের মধ্যে পড়ে রয়েছিলো নিথর হয়ে। ওর শরীরে কোনো সুতোর চিহ্ন ছিলো না। শুধু মুখ দিয়ে গভীর কোঁকানি বেরুচ্ছিলো। সবাই এভাবেই দেখে যাচ্ছিলো আর কেউ কেউ বলছিলো- ‘আরে কিচ্ছু হইব না। এইডার হইল বিলাইর রুহু, সহজে মরণ নাই। মুখে হাতে পনি ঢাল ঠিক হইয়া যাইব। রাইত ভর রঙ্গ কইরা অহন ভ্যাক ধরছে’
ওদের কথা সত্যি হয়েছে। পাগলি মরেণি। সত্যি হয়তো হয়েছে আরও একজনের কথা। কেউ একজন বলেছিলো-হয়তো বা পথিক ধাঁচের কেউ- “তোদের ওপর খোদার লানত পড়বে। ধ্বংস হয়ে যাবে সব। কিছুই থাকবে না”

সব শেষে ঘাটটির শেষ চিহ্ন মসজিদটির পতন হলো বিকেলের পর।
কেউ আর কথা বলল না, শুধু পাগলিটাই বলে গেলো- ‘আছে আছে পানির নিচে আছে’

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন