অবশেষে সমাপ্তি ঘটলো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ইমরান খানের প্রশাসনের। প্রাক্তনদের তালিকায় নাম লেখানো এ প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক পতন দু’টি বাস্তবতার মধ্যে নিহিত। এক. পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে ইমরানের ‘পাকিস্তান তাহরিকে ইনসাফ (পিটিআই)’ জোট মিত্রদের সমর্থন হারিয়েছে এবং ইমরানের মিত্ররা তাকে অনাস্থা ভোটে পরাজিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিতে অস্বীকার করেছে। দুই. পার্লামেন্টের বাইরে, ইমরান পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সমর্থন হারিয়েছেন, যারা সম্প্রতি শীর্ষ সামরিক নিয়োগ এবং নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে ইমরানের সাথে প্রকাশ্য বিবাদে জড়িয়ে পড়ে।
ইমরান খানের সংসদীয় সমর্থন দ্রবীভূত হতে শুরু করে তখন, যখন সামরিক বাহিনী ইঙ্গিত দেয় যে, তারা তাদের তথাকথিত নিরপেক্ষতার নীতি অনুসারে বিরোধীদের বিরুদ্ধে ইমরানের পাশে থাকবে না। তিনি পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীদের দীর্ঘ সারিতে সর্বশেষ সংযোজন, যিনি শীর্ষ নিয়োগ এবং পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে সেনাবাহিনীর রোষানলে পড়েছেন। বিএপির সিনেটর কাকার বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান (মিলিটারি) যখন নিরপেক্ষ হয়ে যায়, তখন মিত্ররা জানে যে, সরকার টিকবে না। একবার যখন এ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়ে গেছে যে, তিনি থাকতে পারবেন না, এটি কেবল সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র।’
অক্টোবরে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়ার মনোনীত প্রার্থীকে প্রত্যাখ্যান করে ইমরান যখন লেফটেন্যান্ট-জেনারেল ফয়েজ হামিদকে সামরিক গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে বহাল রাখার চেষ্টা করেন, তখন বেসামরিক-সামরিক টানাপোড়েনটির প্রকাশ্য বিস্ফোরণ ঘটে। জেনারেল বাজওয়ার মনোনীত লেফটেন্যান্ট-জেনারেল নাদিম আঞ্জুম অবশেষে ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সের নতুন মহাপরিচালক হিসাবে নিযুক্ত হন। যদিও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন এবং সেনাপ্রধান হিসাবে জেনারেল বাজওয়ার দ্বিতীয় মেয়াদ নভেম্বরে শেষ হবে এবং জেনারেল হামিদ তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার যোগ্য একজন সিনিয়র জেনারেল কিন্তু সামরিক বাহনীর মর্জির বাইরে যাওয়ার কারণে এ পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মার্কিন মদদপুষ্ট পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন)-এর মতো দুর্নীতিগ্রস্ত প্রধান বিরোধী দলগুলো ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ইমরানের জোট মিত্ররা বিরোধীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে তার বিরুদ্ধে অসন্তুষ্টি প্রকাশে সোচ্চার হয়ে উঠে। এর মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং দ্বিগুণ মুদ্রাস্ফীতি তার বিরোধীদের ষড়যন্ত্রের গতিবৃদ্ধি করে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লভাটনিক স্কুল অফ গভর্নমেন্টের অর্থনীতিবিদ শাহরুখ ওয়ানি বলেছেন, ‘এর একটি অংশ ছিল পূর্ববর্তী সরকারের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া পরিস্থিতি এবং এর আরেকটি অংশ ছিল অবশ্যই কোভিড।’
ফেব্রুয়ারিতে, ইমরান নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের প্রাক্কালে বাণিজ্য চুক্তির জন্য রাশিয়ায় সফর করেন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী খানের মস্কো সফরকে সমর্থন করলেও তার উচ্চস্তরের অভ্যন্তরীণ চুক্তি নিয়ে তাদের সাথে মতপার্থক্য তীব্র হয়। ইমরান তার রাশিয়া সফর এবং নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির শাস্তি হিসেবে তাকে অপসারণ করার জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন চক্রান্তের অভিযোগ করেছেন। চক্রান্তের প্রমাণ হিসাবে তিনি ২৭ মার্চ ইসলামাবাদে একটি জনসভায় একটি চিঠি প্রদর্শন করেন এবং দাবি করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণের জন্য পাকিস্তানকে একটি কূটনৈতিক সতর্কবার্তা দিয়েছে।
প্রাক্তন সামরিক মুখপাত্র এবং ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ইউক্রেনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত অবসরপ্রাপ্ত মেজর-জেনারেল আতহার আব্বাস বলেন, ‘চিঠিটি একটি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া এবং সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নেয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছে। অনাস্থা ভোটে হস্তক্ষেপ করার জন্য এটি ব্যবহার করা উচিত ছিল কিনা, তা নিয়ে (সেনাবাহিনীতে) মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।’ জেনারেল আব্বাস ইমরান এবং সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে বেশ কিছু বিরোধের কথা উল্লেখ করেছেন।
তবে, ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলেও রাজনৈতিকভাবে তার ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন বিশেষ সহকারী নাদিম আফজাল চান বলেছেন, ‘এক মাস আগেও লোকেরা মুদ্রাস্ফীতির জন্য (খান এবং পিটিআই সরকারকে) গালি দিচ্ছিল। এখন, তারা বলছে যে, তিনি একটি গর্বিত এবং স্বাধীন পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।’ পাকিস্তানের রাজনীতির পুনঃপৌনিক প্রকৃতি এর আগেও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীদের প্রত্যাবর্তন দেখেছে। তাই সময়ই বলে দেবে ইমরানের ভবিষ্যত। সূত্র : দ্য ইকোনোমিস্ট, দ্য নিউইয়র্ক টাইম্স, আল জাজিরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন