পহেলা বৈশাখ, বাংলা সনের প্রথম দিন; চৈত্রের রোদ্দুরে ঝাঁজাল খরতাপে বাঙালির প্রাণে এসে নতুন দোলা পহেলা বৈশাখ। পুরনোকে ধুয়েমোছে নতুনের সুর জাগিয়ে বেজে ওঠে বাঁশি, একতারা, ঢোল, খঞ্জনির মনদোলানো সুর। পান্তা-ইলিশের নতুন ঘ্রাণে আমোদিত হয় বাঙালি; পথেঘাটে, বটমূল ঘিরে কিংবা কোনো তীর্থভূমির আঙিনায় বসে মেলা, কুস্তিখেলা, আরো হরেক আনন্দ উৎসব। এই পহেলা বৈশাখ নিয়ে কবিসাহিত্যিক, শিল্পী, চিত্রকরদের মাঝেও আলাদা জগত তৈরি করে; কবিগুরুর সেই অমৃত বাণী- এসো হে বৈশাখ এসো, এসো; তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক...
পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতিসত্তার নিজস্ব সংস্কৃতি, উৎসব; বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্য। এক কথায় বাঙালি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতিই হচ্ছে বৈশাখী সংস্কৃতি ও উৎসব; এ উৎসব বাঙালির, বাঙালি জাতির, এখানে ধর্ম, বর্ণ কিংবা জাতিগত কোনোপ্রকার যোগসূত্রতা নেই।
ঐতিহাসিকভাবে আমাদের জাতিগত প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখই বাঙালির সার্বজনীন উৎসব। উৎসব আনন্দের মধ্যদিয়ে মঙ্গলদ্বীপ জ্বেলে বাঙালি জাতি বরণ করে নেয় নতুন বাংলা সন।
যুগ যুগ ধরে পরিবর্তনের পথ পেরিয়ে বাঙালি জাতির রক্তমাংসে, হৃদয় ও মগজে মিশে আছে বাংলা সন, বৈশাখী উৎসব। কিন্তু এই আনন্দউৎসব এবং বাংলা সন চালু কবে, কীভাবে হয়েছিল? এ নিয়ে বহু মতবাদ প্রচলিত।
বাংলা সনের শেকড় সন্ধান করতে গিয়ে তিনটি মতামত প্রসিদ্ধ বলে ইতিহাসবেত্তাগণ মত প্রদান করেরন; তা হলোÑ শশাঙ্ক, স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্ এবং আকবর। বাংলা সনের উদ্ভব বিষয়ে তিনজন গবেষকÑ উড়িষ্যার ইতিহাসবিদ কাশিপ্রসাদ জয়াসওয়াল, ড. মেঘনাদ সাহা এবং ড. অমর্ত্য সেন এর গবেষণায় দেখা যায় সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তক। সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রথম নামকরণ করেছিলেন ‘ফসলি সন’ নামে।
বাংলার চাষিরা চাষ করত ঋতু দেখে দেখে, ঋতুনির্ভর চাষিগণের কাছ থেকে সম্রাট আকবর খাজনা আদায় করতেন খ্রিষ্ট্রিয় সন দেখে; এতে করে ঘোরতর গোলযোগের সৃষ্টি হয়। মূলত খ্রিষ্ট্রিয় সন সূর্য এবং হিজরী সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল।
ওই সময়ে আকবরের রাজসভার নবরত্নের এক রত্ন ছিলেন আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজী নামের একজন জ্যোতির্বিদ; তার ওপর এই বিপত্তির সমাধানের দায়িত্ব দেন সম্রাট আকবর। ওই সময়ে জোতির্বিদ আমীর ফতেউল্লাহ্ সিরাজীর জমিদারী ছিল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। সম্রাট আকবরের সভাকবি আবুল ফজলের আইন-ই-আকবর গ্রন্থে আমীর ফতেউল্লাহ্ সিরাজীর কথা উল্লেখ রয়েছে।
১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবর ক্ষমতায় আরোহন করেন; ওই সময়টা ছিল হিজরি ৯৬৩ সাল। আমীর ফতেউল্লাহ্ সিরাজী হিজরী ৯৬৩ সালকেই বাংলা ৯৬৩ সাল ধরেন। ১৫৮৫ সাল থেকে বাংলা সন শুরু হয়। ১৫৮৫ সালটি ছিল সম্রাট আকবরের ক্ষমতার ২৯তম বছর; এই বছরেই বাংলা সন চালু করা হয়।
ড. মেঘনাদ সাহা গাণিতিক সূত্র প্রয়োগ করে প্রমাণ করেন যে, বাংলা সনের প্রবর্তক সম্রাট আকবর; তার গাণিতিক সূত্র ছিল- (১৯৫৪+৯৬৩-১৫৫৬= ১৩৬১); অর্থাৎ ১৯৫৪ সালে মেঘনাদ সাহা গবেষণা করেন, সেই বছরটি ১৩৬১ বাংলা সন।
বাংলা মাসের নামের উৎপত্তি বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিভিন্ন নক্ষত্রের নামে বাংলা মাসের নামকরণ করা হয়। যেমন বুৎপত্তি বিশ্লেষণে, বিশাখা- বৈশাখ, জৈষ্ঠা- জৈষ্ঠ, আষাঢ়- আষাঢ়, শ্রাবণা- শ্রাবণ, ভাদ্রপাদ- ভাদ্র, অশ্বিনী- আশ্বিন, কৃত্তিকা- কার্তিক, পূষ্যা- পৌষ, মঘা- মাঘ, ফাল্গুনী- ফাল্গুন, চিত্রা-চৈত্র; কিন্তু অগ্রহায়ণের নামকরণে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে; অগ্রহায়ণ বা অঘ্রান মাসের আরেক নাম মার্গশীর্ষ; মৃগশিরা নামক তারা থেকে মার্গশীর্ষ নামের উৎপত্তি; মৃগশিরা নক্ষত্রের অপর নাম অগ্রহায়ণী; এছাড়াও বর্তমানে অগ্রহায়ণ বাংলা সনের ৮ম এবং শকাব্দের ৯ম মাস হলেও একসময় অগ্রহায়ণই ছিল বাংলা সনের প্রথম মাস; অগ্র শব্দের অর্থ আগে, হায়ণ শব্দের অর্থ বছর; অর্থাৎ বছরের প্রথম মাস।
পহেলা বৈশাখের সাথে বাঙালি নাড়ির ঐতিহ্যগত গভীর সম্পর্ক; সার্বজনীন এক উৎসবে মেতে ওঠে বাঙালি জাতি। সম্রাট আকবরের সময় থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের শুরু হয়। কিন্তু তখনকার পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনটাই ছিল মূলত খাজনা আদায়ের উৎসব। বছরের শেষদিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষদিনের মধ্যেই সকলপ্রকার খাজনা, মাশুল, শুল্ক পরিশোধ করতে হতো; পরের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকগণ নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের নিয়ে উৎসবে মেতে ওঠে আপ্যায়ণ করা হতো। যেমনটা বর্তমানেও ব্যবসায়ী মহলে হালখাতা নামে প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় দেনাপাওনার হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করা হয়; মিষ্টি বিতরণসহ বিভিন্ন আনন্দ-উৎসব করতে দেখা যায়।
ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি- পহেলা বৈশাখ ভোরে মা-চাচিরা আপদমুক্ত থাকার কামনায় বিবিধ গাছ-গাছালি ডালপাতা ঘরের দরজার পাশে কিংবা বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখতেন; শুঁটকীর ভর্তা দিয়ে পান্তাভাত খেতেন; বর্তমানে যা ইলিশ-পান্তায় রূপান্তরিত হয়।
বৈশাখের প্রথম দিনে মেলা বসে, রঙ মেখে সঙ সাজে; বৈশাখী সাজে সেজে কিশোর-কিশোরীরা সার্বজনীন আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে; বাঙালির প্রাণে জাগায় নতুন আনন্দচেতনা।
বাংলাদেশ এবং ভারত ছাড়াও অস্ট্রলিয়া, ইংল্যান্ড, সুইডেনসহ বিশ্বের আরো নানান দেশে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপিত হয়ে থাকে। ইউরোপে অনুষ্ঠিত সর্ববৃহৎ এশীয় উৎসব পহেলা বৈশাখ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন