শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ব্যবসা বাণিজ্য

মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স কমেছে ২২.১৬ শতাংশ

অর্থ বছরের প্রথম ৯ মাস

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৪ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০১ এএম

হ মালয়েশিয়া থেকে কমেছে অর্ধেক
হ বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও জার্মানি থেকে
হ অবৈধ পথে টাকা আসা বাড়ছে
করোনা মহামারির শুরু থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে মধ্যপ্রাচ্যের সউদী আরব, ইউএই, কুয়েত, কাতার, ওমান ও বাহরাইন থেকে সামগ্রিক আয় কমেছে ২ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের তুলনায় যেটুকু রেমিট্যান্স কমেছে তার ৬৫ শতাংশ কমেছে এই দেশগুলো থেকে। জুলাই-মার্চে শুধুমাত্র মালয়েশিয়া থেকে রেমিট্যান্স কমেছে অর্ধেক। তবে একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও জার্মানির মতো দেশগুলো থেকে বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রা আসার পরিমাণ। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে মালেয়শিয়া থেকে রেমিট্যান্স আসা কমেছে ৫১ শতাংশের বেশি। তবে একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও জার্মানির মতো দেশগুলো থেকে বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রা আসার পরিমাণ। জুলাই-মার্চের মধ্যে সামগ্রিক রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রায় কমেছে ১৮ শতাংশ। মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ সবচেয়ে কমেছে, ওমান থেকে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ৪২ শতাংশ। তবে আশার খবরও আছে। সব দেশ থেকে যে রেমিট্যান্স কমছে, এমনও নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে হারের এমন অবস্থা জানা যায়।
করোনার সময়ে প্রবাসী শ্রমিকদের অনেকেই হাতে থাকা জমানো টাকা বৈধ চ্যানেলে দেশে পাঠানোর কারণে গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স বেড়েছিল। তবে অনেকের চাকরি চলে যাওয়াতে দেশে ফেরত চলে আসতে হয়েছিল। সেইসঙ্গে নতুন শ্রমিকদের বাইরে যাওয়াও প্রায় বন্ধই ছিল। সবকিছু মিলিয়ে প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিতে। বর্তমানে শ্রমিকদের বাইরে যাওয়ার হার স্বাভাবিক হয়ে আসলেও তাদের আয় যুক্ত হয়ে রেমিট্যান্সে প্রভাব পড়তে আরো কিছুটা সময় লাগবে বলে মত অর্থনীতিবিদদের।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেছেন, করোনা মহামারির মধ্যে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ছিল চমকপ্রদ। ওই সময়ের রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে অনেকে বিস্মিতও হয়েছিলেন। এর কারণ হিসেবে আমার মনে হয়েছে, ওই সময়ে সব ধরনের অর্থ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে আসছিল। যাতায়াতের বিধিনিষেধ ও বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি কার্যত বন্ধ থাকার কারণে হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছিল না। করোনার বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলো আবার চালু হয়েছে। এদিকে করোনার মধ্যে আমাদের যত মানুষের বিদেশে কাজের জন্য যাওয়ার কথা ছিল, ততজন তো যেতে পারেনি। ফলে এর একটা প্রভাব তো পড়বে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে কমেছে ২২.১৬% : রেমিট্যান্স আয়ের অন্যতম উৎস দেশ মধ্যপ্রাচ্যের সউদী আরব, ইউএই, কুয়েত, কাতার, ওমান ও বাহরাইন। এসব দেশ থেকে সামগ্রিক আয় কমেছে ২ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের তুলনায় যেটুকু রেমিট্যান্স কমেছে তার ৬৫ শতাংশ কমেছে এই দেশগুলো থেকে। বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানো দেশগুলোর তালিকায় প্রথম অবস্থানে থাকা সউদী আরব থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৩ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ৪ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। শুধুমাত্র এই একটি দেশ থেকেই ঘাটতির পরিমাণ শূণ্য দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার।
মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ আরব আমিরাত থেকে আগের অর্থবছরের প্রথম নয় মাসের তুলনায় আয় কমেছে ৩২ দশমিক ৭৬ শতাংশ। আগের অর্থবছরে যেখানে আয় এসেছিল ১ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার, সেখানে একই সময়ে চলতি অর্থবছরে এসেছে ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। ওমান থেকে রেমিটেন্স কমেছে ৪১ দশমিক ৭৮ শতাংশ, কুয়েত, বাহরাইন ও কাতার থেকে থেকে যথাক্রমে ১২ দশমিক ৬১, ৩ দশমিক ৫৯ ও শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশ হারে রেমিটেন্স কম এসেছে।
মালয়েশিয়া থেকে কমার হার সর্বাধিক
২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে মালয়েশিয়া থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ১ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। তবে চলতি বছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র শূন্য দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, আগের অর্থবছরের তুলনায় রেমিট্যান্স কমার হার ৫১ দশমিক ৫১ শতাংশ।
সামগ্রিকভাবে রেমিট্যান্স কমলেও, কমার হার ৫ শতাংশের নিচে থাকায় তালিকায় পঞ্চম থেকে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে যুক্তরাজ্য। আগের অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত প্রবাসীরা দেশটি থেকে ১ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিল। চলতি অর্থবছরে একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার।
সিঙ্গাপুর থেকে রেমিট্যান্স কমেছে ৩৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে যেখানে প্রবাসীরা শূন্য দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন, সেখানে চলতি অর্থবছরের তা শূন্য দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া থেকে রেমিট্যান্সে ৪৬ দশমিক ০৬ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
আয় বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও জার্মানি থেকে
সব দেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সে যখন নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি, তখন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও জার্মানি থেকে আয় বেড়েছে। রেমিট্যান্স পাঠানো দেশের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে গত অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার এসেছিল। চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। দেশটি থেকে আসা আয়ে প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৮৫ শতাংশ।
ইতালি থেকে গত অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছিল শূন্য দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরে গত মাস পর্যন্ত ইউরোপের দেশটি থেকে এসেছে শূন্য দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, আয় বেড়েছে ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ।
রেমিট্যান্স পাঠানো দেশের তালিকায় নিচের দিকে থাকা জার্মানি থেকেও আয় কিছুটা বেড়েছে। আগের অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের এই সময়ে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালির মতো দেশগুলোর অর্থনীতি করোনা পরবর্তী সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর কারণে রেমিট্যান্স বেড়েছে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এই দেশগুলোতে যারা গেছেন তারা করোনাকালীন সময়ে দেশে ফেরত আসেন নি। তাদের আয় কমলেও দেশে টাকা পাঠানো বন্ধ হয়নি। এসব কারণে দেশগুলো থেকে ইতিবাচক ধারায় রেমিট্যান্স আসছে।
মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে আয় কমা নিয়ে তিনি বলেন, এসব দেশগুলো থেকে অনেক শ্রমিককে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারা আর ওসব দেশে ফিরতে পারেননি। এছাড়া নতুনদের যাওয়াও সেভাবে শুরু হয়নি। এ কারণে এই দেশগুলো থেকে উল্লেখযোগ্য হারে আয় আসা কমেছে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে আয় আবার বাড়বে মন্তব্য করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, এই অঞ্চলের দেশগুলোতে আবার শ্রমিক যাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। তাই বছরখানেকের মধ্যে সেসব দেশের আয় আবার বেড়ে যাবে।
বাড়ছে অবৈধ পথে টাকা আসা
করোনাকালে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠানো প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। তবে বর্তমানে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসাতে তা আবারও বেড়েছে বলে ধারণা অর্থনীতিবিদদের। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহে। যদিও সরকার অনেক আগে থেকেই রেমিট্যান্সে ২ দশমিক ৫ শতাংশ, প্রণোদনা দিচ্ছে, তারপরও অবৈধ পথে টাকা পাঠানো কমছে না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, বর্তমানে ডলারের দাম খোলাবাজারে বেশি। ফলে বৈধ চ্যানেলের চেয়ে হুন্ডিতে বিনিময় মূল্য বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এটা রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার একটা কারণ হতে পারে। হুন্ডিকে থামানো না গেলে এই প্রণোদনা কাজে আসবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চলতি অর্থবছর শেষে রেমিট্যান্স আয় ২০ থেকে ২১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ এমন থাকলে বছর শেষে ২০ থেকে ২২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসতে পারে। তিনি বলেন, করোনাকালীন সময়ে আসা রেমিট্যান্সের সঙ্গে এ বছরের তুলনা করাটা ঠিক হবে না। চলতি বছরের গত মার্চ মাসেও ফেব্রুয়ারির তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রেমিট্যান্স বেড়েছে। সামনে ঈদকে কেন্দ্র করে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো বাড়বে বলে আমরা আশাবাদী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন