শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি

আর কে চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৯ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০৭ এএম

স্বজনদের জন্য ঈদ পালনে এ বছর রেকর্ডসংখ্যক মানুষ ঢাকা ছাড়বেন বলে মনে করা হচ্ছে। নাড়ির টানে যারা ঈদ করতে গ্রামের বাড়ি যাবেন তারা বাস-ট্রেন-লঞ্চের টিকিট কেনার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন। ২৩ এপ্রিল ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রির দিনে কমলাপুর রেলস্টেশন ছিল লোকারণ্য। টিকিটের জন্য আগের দিন ইফতার করেই অনেকে জড়ো হন রেলস্টেশনে। অনেকে সাহরি খেয়ে যুক্ত হন ট্রেনের টিকিট নামের সোনার হরিণ পাওয়ার আশায়। ঈদে অনলাইনে ট্রেনের টিকিট বিক্রি বন্ধ থাকায় ক্লান্তিকর লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে তা সংগ্রহ করতে হচ্ছে।

১৫ এপ্রিল শুরু হয়েছিল বাসের অগ্রিম টিকিট বিক্রি। সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন ২৯, ৩০ এপ্রিল ও ১ মের বাসের সব অগ্রিম টিকিট শেষ হয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন বাস কাউন্টারের কর্মীরা। টিকিট না পেয়ে ঈদে কীভাবে বাড়ি যাবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ি ফেরা মানুষের। ঈদযাত্রার বাসের অগ্রিম টিকিট না পেয়ে নগরবাসী ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছেন। পরিবহনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারের ঈদে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ গ্রামে যাবেন। গার্মেন্ট-শিল্প-কারখানা ও সরকারি অফিসে একসঙ্গে ছুটি হওয়ায় শেষ দিকে যাত্রীর চাপও বাড়বে কয়েক গুণ। এ ছাড়া ঈদযাত্রায় মহাসড়কে দুর্ভোগ সহ্য করতে হবে। কারণ, ঢাকা থেকে বের হওয়ার অধিকাংশ সড়কে খানাখন্দ। বিভিন্ন এলাকায় প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলমান থাকায় তীব্র যানজটের আশঙ্কা রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কসহ সিরাজগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কাঁচপুর সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতু, শিমুলিয়া ফেরিঘাটসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোয় ভোগান্তি আরও বাড়তে পারে। নৌপথে যাত্রীদের চাহিদা মেটাতে এবার বাড়তি লঞ্চ ছাড়ার প্রস্তুতি চলছে। স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করা দেশের সাধারণ মানুষের সহজাত প্রত্যাশা। এ প্রত্যাশা পূরণে যাত্রীরা যাতে ভোগান্তির শিকার না হন সেদিকে নজর রাখতে হবে।

ঈদে বাড়ি ফেরা, ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা। ঈদযাত্রা আর ঈদ শেষে ফিরতিযাত্রার ভোগান্তি যেন এক অনিবার্য নিয়তি দেশের মানুষের। গণপরিবহনের সংকট, অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ, স্বাভাবিকের তুলনায় তিন-চার-পাঁচগুণ ভাড়া গুনতে বাধ্য হওয়া এমনকি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াও মানুষকে কষ্টকর এই ঈদযাত্রা থেকে বিরত রাখতে পারে না। এমনকি এই প্রাণঘাতী করোনা মহামারীর কালেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতি বছর ঈদ উৎসবের আগমুহূর্ত থেকেই ঘরমুখী মানুষের মনে নিরানন্দের সুর ধ্বনিত হতে দেখা যায়। টিকিট কালোবাজারি, যানজট, ছিনতাই-ডাকাতি ও চাঁদাবাজি, জাল নোট, সড়ক ও লঞ্চপথে দুর্ঘটনা এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে রাস্তা অবরোধসহ বিভিন্ন ঘটনায় জনদুর্ভোগ চরমে ওঠে। অতীতের ঘটনা থেকে প্রমাণিত- দেশের কোনো পথই ঘরমুখী মানুষের ঈদযাত্রার জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। সড়কপথ, নৌপথ, রেলপথ- ঈদের আগে কোথাও স্বস্তির কোনো চিত্র পরিলক্ষিত হয় না।

নির্ঝঞ্ঝাট ও নিরাপদ ভ্রমণের প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ টিকিটের জন্য বাস, লঞ্চ ও রেলস্টেশনে ভিড় জমায়। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও কাক্সিক্ষত গন্তব্যের টিকিট পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। মূলত অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য অবৈধ পন্থায় টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এ সময় মানুষকে উচ্চমূল্যে টিকিট কিনতে বাধ্য করা হয়। ঈদের আগে এ ধরনের অনিয়ম-অব্যবস্থা মোটেই কাম্য নয়।

সড়ক-মহাসড়কে যান চলাচল নির্বিঘ্ন হবে- এটাই প্রত্যাশিত। দুঃখজনক হলো, এ নিয়ম বাস্তবে দেশের কোথাও পরিলক্ষিত হয় না। রাস্তার ওপর ও ফুটপাতে দোকানপাট, অপরিকল্পিত ট্রাফিক ব্যবস্থা ও ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাজি, খেয়ালখুশি মতো যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, মহাসড়কের ওপর ম্যাক্সি-টেম্পোস্ট্যান্ডসহ রাস্তার মাঝখানে ডাস্টবিন ও হাটবাজার স্থাপন করে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করে রাখা হয়। ফলে ঈদের সময় বাড়তি মানুষের চাপে সড়কপথগুলো স্থবির হয়ে পড়ে।

সড়ক-মহাসড়কগুলো এবারও যাতে একই রূপ ধারণ না করে, সেজন্য আগে থেকেই পদক্ষেপ নেয়া উচিত। ঈদের সময় অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের কারণে নৌপথে দুর্ঘটনা ঘটে। সুষ্ঠু তদারকির অভাব ও কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারসাজিতে বছরের পর বছর ধরে নৌপথে বিদ্যমান এ অনিয়মের দায় শোধ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে, নিজেদের জীবনের বিনিময়ে।

এ অবস্থার অবসান ঘটাতে হলে প্রচলিত নৌপরিবহন আইন যুগোপযোগী করার পাশাপাশি বিদ্যমান অনিয়ম দূর করার পদক্ষেপ নিতে হবে। রেলের যাত্রী হয়রানির কথা সুবিদিত। রেলপথ নিয়ে নানা ধরনের পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণের কথা শোনা গেলেও উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ছে না।

অতীতে দুর্ভোগ ও ঝক্কি-ঝামেলা থেকে নিস্তার মেলেনি রেল যাত্রীদের। অন্তত ঈদের সময় রেলযাত্রীদের এ ভোগান্তি যথাসম্ভব কমিয়ে আনার প্রয়াস নিতে হবে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনে এমনিতেই দুর্ভোগের অন্ত নেই। উৎসব-পার্বণে এ দুর্ভোগ যেন শতগুণ বেড়ে যায়। এর ফলে উৎসবের রঙ ফিকে হয়ে যায়। এবার যেন তেমনটি না হয়, সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবার লক্ষ রাখা প্রয়োজন।

মানুষ যাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে নির্বিঘ্নে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন, এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন