পর্যটনশিল্প খাতকে বিশ্বের প্রধান একক বৃহত্তম অর্থনৈতিক খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বৈশ্বিক করোনা মহামারীতে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে এই খাতের। বিশ্বের বহুদেশের জিডিপি’র প্রধান খাত পর্যটন। করোনাকালে সে সব দেশের অর্থনীতি অপুরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তবে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প আশানুরূপ বিকাশ লাভ করতে পারেনি। এ খাতে বিনিয়োগ এবং সামগ্রিক সম্ভাবনা যখন একটি আশাব্যঞ্জক অবস্থান গ্রহণ করতে শুরু করেছিল ঠিক তখনি করোনার লকডাউন এ খাতের উপর বড় ধরণের আঘাত হয়ে দেখা দিয়েছিল। প্রতিবছর ঈদের মওসুমে কক্সবাজার-কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতসহ দেশের দর্শনীয় স্থানগুলোতে হাজার হাজার মানুষের সমাগম আভ্যন্তরীণ পর্যটন খাতে বড় ধরণের কর্মচাঞ্চল্য নিয়ে আসে। ২০২১ সালের ঈদ মওসুমে করোনা লকডাউন না থাকলেও ২০২০ সালের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া এক বছরে সম্ভব নয়। গত বছর দেশের প্রধান পর্যটন আর্কষণ কক্সবাজারে বেশ কিছু মুনাফাবাজি ও নিরাপত্তামূলক ঘটনা এ খাতের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে একটি কলঙ্কজনক ইমেজ সংকটের আশঙ্কা তৈরী করেছিল। পর্যটকদের কাছে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে হোটেল বুকিং, খাবারের মূল্য আদায় এবং স্থানীয় বখাটে-সন্ত্রাসীদের দ্বারা নারী ও শিশু অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনায় সারাদেশে ব্যাপক সামাজিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল।
অনেক আশঙ্কা ও জল্পনার পর এবারের ঈদে দেশের প্রায় সব পর্যটন এলাকায় বিপুল জনসমাগমের আলামত ঈদের আগেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তবে কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতসহ পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে গতবারের চেয়ে বেশি পর্যটকের সমাবেশ ঘটলেও তেমন কোনো অঘটন বা নেতিবাচক সংবাদ শিরোনাম আসেনি। ধারণা করা যায়, গতবারের অভীজ্ঞতার আলোকে পর্যটনকেন্দ্রের হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট, গণপরিবহন, ট্যুর অপারেটিং কোম্পানি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের আগাম সতর্কতামূলক ও দায়িত্বশীল ভ’মিকার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। ঈদের আগে প্রকাশিত রিপোর্টে কক্সবাজার, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট-মৌলভিবাজারের হোটেল-মোটেল ও কটেজ মালিকরা বিপুল সংখ্যক কক্ষ অগ্রিম বুকিংয়ের খবর জানিয়েছিল। শুধুমাত্র এই চার জেলার পর্যটনশিল্প সংশ্লিষ্টরা এই ঈদে অন্তত ৬৫০ কোটি টাকার ব্যবসা হবে বলে জানিয়েছিল। আমাদের পর্যটন শিল্পের জন্য এটি অবশ্যই আশাব্যঞ্জক সংবাদ। পর্যটন শিল্পকে আকর্ষনীয়, সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে এ খাতকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নেতিবাচক সংবাদ সৃষ্টিকারী মুনাফাবাজ ও উচ্ছৃঙ্খল-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে কার্যকর ও আইনগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পর্যটনশিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা আশা প্রকাশ করেছিলেন, এবারের ঈদে সম্ভাব্য বিপুল জনসমাগম গত দুইবছরের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সহায়ক হতে পারে। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে বিপুল জনসমাগমের পাশাপাশি কোনো অঘটন বা নেতিবাচক সংবাদ না থাকা এ খাতে ইতিবাচক পরিবর্তনকেই নির্দেশ করছে।
প্রতিবছর ঈদযাত্রায় ব্যাপক জনভোগান্তি, যানবাহনের সংকট এবং মহাসড়কে বিশ-ত্রিশ কিলোমিটার লম্বা যানজটে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে থাকার সংবাদ অনেকটা সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ালেও এবার এই চিত্র ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম। করোনাকালের বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে বিপুল সংখ্যক ঘরমুখো মানুষ অনেকটা নির্বিঘেœই ঘরে ফিরতে সক্ষম হয়েছে। কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম বাদ দিলে, যানজটের কারণে ঈদের দিন পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষকে পথে-ফেরিঘাটে আটকে থাকতে হয়নি। একইভাবে কক্সবাজার বা কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁয় গলাকাটা মুনাফাবাজির ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায়নি। ঈদযাত্রায় বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য পর্যাপ্ত গণপরিবহন তথা, বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও এভিয়েশন সার্ভিসের সাথে সংশ্লিষ্টরা সবকিছু যথেষ্ট সাফল্যের সাথে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্থানীয় প্রশাসন, পর্যটন, সড়ক-সেতু ও যোগাযোগের সাথে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আমরা অভিনন্দন ও সাধুবাদ জানাই। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, একই সৈকতে দাঁড়িয়ে সুর্যাস্ত ও সুর্যোদয় দেখার ব্যতিক্রমী সৈকত কুয়াকাটা, চা বাগান ও ওলি-আওলিয়াদের পূণ্যভ’মি সিলেট-চট্টগ্রামের বিপুল সম্ভাবনাময় পর্যটনশিল্পের হাত ধরে এ দেশের অর্থনীতিতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হতে পারে। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ব্যাপক সংস্কার ও উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দর্শনীয় স্থানগুলোকে নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব এবং সুশৃঙ্খল করে তুলতে নিতে হবে কার্যকর সমন্বিত উদ্যোগ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন