দেশে পর্যটন একটি সম্ভাবনাময় বড় খাত। দীর্ঘদিন ধরে এই খাতে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ তেমন ভালভাবে হতে পারেনি। সরকার বড় বড় যে প্রকল্পগুলো হাতে নিয়েছে, তা চলমান। যদিও করোনাকালে খাতটির অগ্রগতি দারুনভাবে বাঁধাগ্রস্থ হয়েছে। বর্তমানে বিদেশি বিনিয়োগ নেই বললে চলে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের উচিৎ এই খাতে অধিক গুরুত্ব দেওয়া।
পদ্মাসেতু চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশে পর্যটনের সম্ভাবনা বেড়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনও পর্যটন স্থানগুলোতে পর্যটকদের জন্য তেমন সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি। দেশের অধিকাংশ পর্যটন স্থানগুলোতে যোগাযোগ ব্যবস্থা, নিরাপত্তা, মানসম্মত আবাসিক হোটেল ও স্বাস্থ্যসম্মত রেস্তোরাঁর অভাব রয়েছে। অনেক স্থানে যোগাযোগের অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো কাঁচা রয়ে গেছে। যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহন করা জরুরি।
দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় সমুদ্রসৈকত পটুয়াখালীর কলাপাড়ার কুয়াকাটা। সমুদ্রসৈকতটি লম্বায় ১৮ কিলোমিটার ও প্রস্থে আধা কিলোমিটার। এ সৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখা যায়। পদ্মসেতু হওয়ায় আগের তুলনায় এখানে পর্যটকের উপস্থিতি বাড়ছে। কুয়াকাটার হোটেল-মোটেল মালিকগণ বলেছেন, পদ্মাসেতু চালু হওয়ার আগে এখানে বছরে ১২-১৫ লাখ পর্যটকের আগমন ঘটত। পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পর গত এক মাসে প্রায় দেড় লাখ পর্যটক কুয়াকাটায় এসেছেন। যদিও এই সময়ে কুয়াকাটায় তেমন একটা পর্যটক থাকে না। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে গত এক মাসের চিত্র খুবই সন্তোষজনক। কুয়াকাটার সঙ্গে ঢাকার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। এখন বছরে কুয়াকাটায় ২২-২৫ লাখ পর্যটক ভ্রমণ করবেন বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। তবে কুয়াকাটা পৌরসভার অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো কাঁচা রয়ে গেছে, যা পর্যটকদের ভোগান্তিতে ফেলছে। স¤প্রতি ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় বেড়াতে আসা অনেকের অভিযোগ দীর্ঘ সড়কপথ পাড়ি দিয়ে যখন কুয়াকাটায় আসে, তখন হতাশ হতে হয়। কুয়াকাটার প্রধান সমস্যা হচ্ছে সৈকতের চরম দুরবস্থা। সৈকতটি সাগরের ঢেউয়ে ভেঙে ক্রমে ছোট হয়ে গেছে। যখন জোয়ার হয়, তখন সৈকতে হাঁটার জায়গা থাকে না। তাছাড়া নোংরা-আবর্জনায় যত্রতত্র সৈকতের পরিবেশ বিঘিœত হচ্ছে। এই অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি। ২০১০ সালে কুয়াকাটা পৌরসভায় উন্নীত হয়। এটি তৃতীয় শ্রেণীর পৌরসভা। সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র হলেও এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সুযোগ-সুবিধা অপ্রতুল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাগর-প্রকৃতি, জেলেদের জীবনযাপনসহ কুয়াকাটার সবকিছুই পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয়। অথচ কুয়াকাটার অভ্যন্তরীণ সড়ক ব্যবস্থাপনা সেভাবে গড়ে না ওঠায় পর্যটন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানো ও ভ্রমণের পরিবেশ নেই।
দেশের পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করতে হলে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টসহ অবকাঠামো উন্নয়নে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমানে কুয়াকাটায় পর্যটকদের থাকার জন্য ১৫০টির বেশি হোটেল-মোটেল রয়েছে। এর মধ্যে তিন তারকা হোটেল আছে মাত্র দুটি। প্রথম শ্রেণীর হোটেল রয়েছে ১০-১৫টির মতো। এসব হোটেল বহু আগে গড়ে তোলা হয়েছে। দু:খজনক হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, এসব হোটেল-মোটেলে আধুনিক কোন সুযোগ-সুবিধাসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, যা পর্যটকদের এই স্থানে ভ্রমনের বিষয়কে নিরুৎসাহিত করছে।
অবশ্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন অনেকে হোটেল-মোটেল তৈরি করার উদ্যোগ নিচ্ছেন। হোটেল ব্যবস্থাপনায় বৈচিত্র্য ফুটিয়ে তুলছেন, যা ইতিবাচক। পাশাপাশি পুরোনো হোটেলগুলোর মালিকরাও কেউ কেউ হোটেলের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জায় পরিবর্তন আনার চিন্তা করছেন। এখন যদি রাস্তাঘাটের মানন্নোয়নসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় তবে আগামীতে এই পর্যটন শিল্পে সুফল পাওয়া যাবে।
বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া পর্যটন খাতকে কোনোক্রমেই বিদেশিদের মাঝে আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভব হবে না। সিঙ্গাপুর, হংকং, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে শুধুমাত্র বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে জমজমাট ব্যবসা চলেছে। আমাদেরকেও অনুরূপ চিন্তা ভাবনা করতে হবে।
বিশ্বে বাংলাদেশের পর্যটনের রাজধানী হিসেবে ইতোমধ্যেই কক্সবাজার ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। এখানে বিশেষ করে ছুটির দিনে এত বেশি পর্যটকের আগমন ঘটে যে, হোটেল-মোটেলগুলোতে ঠাঁই হয় না। এ কারণে এখানে অবকাঠামোগত ব্যবস্থার আরও উন্নয়নের সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ নেয়া জরুরী। দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের জন্য কক্সবাজার ও এর আশপাশের এলাকাকে আরও আকর্ষণীয় হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। তথ্য মতে, বর্তমানে কক্সবাজারে পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণে ২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এগুলোতে প্রায় প্রত্যক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। পরোক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ১ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে, কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন, আধুনিক হোটেল-মোটল নির্মাণ, মহেশখালীতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, সোনাদিয়াকে বিশেষ পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা, ইনানি সৈকতের উন্নয়ন, টেকনাফের সাবরায়েং ইকো ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণ, শ্যমলাপুর সৈকতের উন্নয়ন, ঝিলংঝা সৈকতের উন্নয়ন, চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, কুতুবদিয়ায় বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পের স¤প্রসারণ, চকোরিয়ায় মিনি সুন্দরবনে পর্যটকদের গমনের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ডুলাহাজরা সাফারি পার্কের আধুনিকায়ন। এছাড়া আরও চারটি নতুন প্রকল্প নিতে যাচ্ছে সরকার। এসব বাস্তবায়িত হলে আগামীতে দেশের পর্যটন খাত আরও চাঙা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত ও পিপিপির মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হবে। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কক্সবাজারে যাতায়াত করার জন্য রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে, যা ইতিবাচক। এই শিল্পের সার্বিক অগ্রগতির জন্য পর্যটন শিল্পকে বড় শিল্পখাত হিসেবে দাঁড় করাতে হবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। উন্নতমানের আকর্ষণীয় ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারলে বিদেশি পর্যটক আমাদের দেশে প্রচুর আসবে। পর্যটকরা কেন সিঙ্গাপুর, হংকং, মালয়েশিয়া যাচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা বেশি প্রয়োজন।
বিনোদনের জন্য আধুনিক ও নতুন আইটেম সংযোজন করা দরকার। পর্যটনের জন্য অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। পর্যাপ্ত রাস্তা, হোটেল, মটেল ও বিমানবন্দর সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। যানজটের অবস্থার উন্নতির জন্য সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশবান্ধব আকর্ষণীয় প্রকল্প গ্রহণ এবং সেগুলোর দ্রæত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দিতে হবে।
পর্যটন শিল্প দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দেশের মানুষও দেশকে দেখতে চায়, বেড়াতে চায়, অবসরে বিভিন্ন জেলায় বেড়ানোর অভ্যাস গড়ে উঠেছে। এজন্য বিভিন্ন জেলায় বিনোদন ও থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা থাকলে পর্যটন শিল্প প্রসার লাভ করবে। বিদেশি পর্যটকদের জন্য দরকার নিরাপদ সড়ক, মানসম্মত থাকা-খাওয়ার হোটেল-মোটেল এবং কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহন করবে বলে আশা করি।
লেখক- কলামিস্ট ও সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, বিইউএফটি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন