নৌকর মাচায় বসে দুলাল নিভুনিভু চোখে আকাশ দেখে। তারপর জলের বিন্দু গুলো মুখের গহŸরে নিয়ে ঢোক গেলে। বৃষ্টির থুথানি এখনো পড়ছে। করিমন নৌক থেকে শরীরটাকে পানির দিকে একটু ঝুঁকে আরো একটি শাপলা তুলে দুলাল কে বললÑ ‘বাজান! অমন কইরা আসমান থন কী খাও, পানি?’
দুলাল মাথা নেড়ে বলল, ‘হ, মিডা লাগে’
করিমন শাপলার তারা বাঁধতে বাঁধতে বললÑ ‘অইছে, আল্লার শরবত মেলা খইছÑ অহন মাথায় ডুমা দাও! নাইলে জ¦র আইব। ওই মেমান আইলে ত মশকিল! ওষুধ ছাড়া বাড়ি ছাড়েনা। আমরা গরিব মানুষ। ঠিক মত ভাতই পাইনা আবার ওষুধ পামু কৈ!
‘ক্যান শাপলা বেইচা ওষুধ কিনবা’
‘শাপলা আর থাকবই কয়দিন!’
‘তয়লে আমরা খামুকি মা’
করিমন ছেলেকে সান্ত¡নায় বলল, ‘অই যে আসমান দেখতাছ মাথার ওপরে, অইহানে আল্লায় থাকে। আমাগো চিন্তা আল্লার
‘ক্যান মা? আল্লার চিন্তা ক্যান?’ খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো দুলাল।
করিমন কথা বাড়াল না। দাঁড়িয়ে একের পর এক পানিতে লগি ফেলতে লাগল।
প্রতি প্রহরেই শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যায় করতে হয় লগির ওপর। বেলা ওঠার আগেই শাপলা বোঝাই এই ভারী নৌকা বেয়ে নিতে হয় বাজারে। তারপর একেক তাড়া শাপলা কোনো দিন দশ টাকা, কোনো দিন আবার বিশ টাকা দরে বিক্রি হয়। এই পয়সা দিয়ে কাটে মা-ছেলের বর্ষা কালের জীবন।
করিমনের আঁচলে পুটলি করে অল্প কিছু চাল বাঁধা। সাথে একটি কাচের শিশিতে ছটাক খানিক তেল। সেই তেল নৌকর দোলায় দুলছে। বৈঠা এবং জলের সংঘর্ষে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হচ্ছে। দুলছে দুলালও
বাড়ির কাছে এসে করিমন দুলালকে বলল, ‘বাজান পাতিরডা দরো দেহি!
তারপর করিমন জালটা উঁচু করে টেনে দেখল। মটে তিনটি মাছ পড়েছে। খলিশা মাছ। করিমন বিরবির করে বলতে লাগল, আইজ কাইল কারেন জালেও মাছ পড়েনা। এই বর্ষাডা ক্যামনে কাটব কে জানে! চকের শাপলাও ত শ্যাষ দেখতাছি! এইসব ভাবতেই আসন্ন বিপদের দামামা যেন বেজে উঠর তার বুকে। সে ছেলেকে আবার ডেকে বলল, ‘বাজান পাতিলডা লইয়া আগাও!’
‘মা এই মাছ কইলাম আমারে ভাইজা দিবা’ দুলাল এগিয়ে এসে বলল।
‘আইচ্ছা’ আসতে করে বলল করিমন।
‘একটা তোমারেও দিমু, আর দুইটা খামু আমি’
ছেলের কথায় করিমন ¤øান হাসে। তারপর দুলাল আবার বলেÑ ‘মা আমারে একটা লাল জামা কিনা দিবা?’
করিমন জলের ওপর র্দীঘ নিশ^াস ছাড়ে।
এক সকালে ক্ষুদার্ত দুলাল মায়ের পাশে বসে ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছে। সপ্তাহ খানেক হলো করিমনের খুব জ¦র। ঘরে এক দানা চাল নেই। চারদিন হলো হাড়িতে ভাত চড়ে না। ভাতের খিদে কি আর অন্য কিছুতে মেটে?
অন্য কিছু বলতেই বা আর কী! অই ছেড়া জালটিতে দুই-চারটি মাছ। সেই মাছইবা কী করে রাঁন্না করে! তেল নেই, নুন নেই। হয় পানিতে সিদ্ধ, না হয় শুটকি মাছের মতো কাটখোলায় ভাজা। ছেলের কাঁন্নায় সেই মাছ দিয়েই বুঝ দিতে চাইছে রুগ্ন করিমনÑ ‘বাজান আমি না তোমারে কয়ডা মাছ ভাইজা দিলাম, তুমি ওই কয়ডা খাও! আমার জ¦রডা কমলে তোমারে ভাত রাইন্দা দিমুনে।’
‘না আমি ওইগুলি খামনা। ওইগুলি তিতা। ভাত খামু, আমারে ভাত দাও!’
করিমন হঠাৎ করেই চটে গেল। এতো ক্ষলের ঘ্যানঘ্যানানি আর সহ্য হলো না। সে ছেলের গায়ে চর থাপ্পর লাগাতে লাগলোÑ ‘বদমাইশ পোলা দূর হ সামনের থন। জমিদারের বেডা হইছ! মাছ ভাজা তিতা লাগে! দূর হ!... দূর হ!....’
তারপর ওপরের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমার পোলাডায় নাইলে অবুঝ, তুমি ত অবুঝ না। আমাগো দুঃখ বুঝনা তুমি? দুনিয়াডারে কত মাইনষে লুইটাপুইটা খায়, কই দুনিয়া ত শ্যাস হয়না! আর আমি কয়ডা শাকপাতা তুললেই শ্যাষ! ক্যান, আমার বেলায় শ্যাষ ক্যান? গরীব কি তুমার তৈয়ার না?
খানিক পর দুলাল ঘরে এসে আসতে আসতে ওর মায়ের হাত ধরে টানে। মা ছেলেকে বুকে নেয়, আবার কাঁদে। দুলাল বুক আলগা করে। আসতে আসতেই বলেÑ ‘মা বাইরা আহো! আহো না!’
ছুট্ট দুলাল মাকে নাও এর ওপর নিয়ে গেলো। সে আঙ্গুল দিয়ে ইঙ্গিত করল বিস্তৃত বিলের দিকে। অসংখ্য শাপলা ফোটা দেখা যায় অই। ফুলের মধ্যে যেন করিমনের জীবন ফিরে এলো। তার চোখ আনন্দে জ¦ল জ¦ল করছে। বলহীন দেহ নিয়ে হাঁটুগেরে বসল নৌকর মাচায়।
বেলা উঠার পর করিমন ছেলের হাত ধরে এলো এক দোকানে। একাটি লাল টকটকে জামা ছেলের গায়ে ধরে বলল, ‘ তুমার পছন হইছে?’
দুলাল জামা নামিয়ে গম্ভির মুখে বলল, ‘আমি জামা নিমুনা মা! চলো বাড়িতে চলো, ভাত রানবা।।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন