উত্তরবঙ্গের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী উৎসব ‘ভাদর কাটানি’। হাজার হাজার বছর ধরে প্রচলিত লোকাচার এই ‘ভাদর কাটানি’ উৎসব। আমি যখন খুব ছোট তখন থেকেই দেখে আসছি এই উৎসবকে। তবে শহুরে সংস্কৃতির দাপটে এবং আকাশ সংস্কৃতির আগ্র্রাসনে এ উৎসব হারিয়ে যেতে বসেছে। যদিও উত্তরবঙ্গের অনেক গ্রাম এখনো এ সংস্কৃতি ধরে রেখেছে। একসময় হিন্দু-মুসলমান উভয় স¤প্রদায়ে এবং আদিবাসী সমাজে এ ভাদর কাটানি উৎসব পালন হতো অনেকটা ঘটা করে। আমি নিজেই আমার ফুফু-খালাদের ভাদর কাটানি পালনের জন্য নাইওর আনতে গিয়েছি। একবার তো আমার এক দাদির সঙ্গে ভাদর কাটানিতে নাইওর হয়ে নিজেই গিয়েছিলাম। সেইসব এখন কেবলই অতীত। ইদানিং মুসলিম সমাজে দু’এক যায়গা ছাড়া এ উৎসব তেমন একটা চোখে পড়েনা।
ভাদর কাটানি বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই পালিত হতো সমগ্র উত্তরবঙ্গে। সাধারণত পহেলা ভাদ্র থেকে শুরু হওয়া এই উৎসবে নববধ‚রা বাবার বাড়ি নাইওর যাওয়া শুরু করে। আধুনিকতার এই যুগে শহরাঞ্চলে এর প্রভাব না থাকলেও গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে উৎসবটি এখনো অধিক পরিচিত এবং তাৎপর্য প‚র্ণ সাংস্কৃতিক উপাদান হিসেবে বিবেচিত। তাই তো বর্তমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও করোনাকালের এই ঘোর সংকটেও পালন করছে তাদের ঐতিহ্যকে ধারণ ও লালন করে। গ্রামের মানুষ এখনও ভোলেনি যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই উৎসবের কথা।
বাংলা বর্ষের ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকে কমপক্ষে ১৫ দিন পর্যন্ত স্বামীর মঙ্গল কামনায় নতুন বধুরা তার স্বামীর মুখ দর্শন করবেন না এটাই ম‚লত এই উৎসবের প্রাণকথা। তবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই উৎসবের কোনও ব্যাখা বা যুক্তি না থাকলেও বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের মানুষের এটি আদি প্রথা। যা বাপ-দাদারা পালন করতো বলে এখনো পালন করে আসছে। ঠিক কবে থেকে এই উৎসব পালন হয়ে আসছে তার সঠিক ইতিহাস বা দিনক্ষণ জানা না থাকেলেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় ভাদর কাটানি উত্তরবাংলার কৃষি সভ্যতা বা ভাত সভ্যতার স‚চনা লগ্নের আদিকাল থেকেই যে প্রচলিত একথা ফোকলোর গবেষকগণ জোর দিয়েই বলে থাকেন।
বৃহত্তর দিনাজপুরের লোকাচার ও কিংবদন্তি নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি এখনো কিভাবে এ উৎসব পালন করা হচ্ছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। স¤প্রতি নীলফামারিতে জেলা সদরের রামনগর ইউনিয়নের বাহালী পাড়া গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব তসলিম উদ্দিন কে ভাদর কাটানি পালন নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, বিয়ের এক বছরের মাথায় ভাদ্র মাসের শুরুতেই মায়ের নির্দেশে আমার স্ত্রী বাবার বাড়ি চলে যায়। এটা প্রাচীন নিয়ম বলে আমার বলার কিছুই ছিল না। প্রায় ১৫-২০ দিন পর সে বাড়িতে আসে। এছাড়াও গ্রামীণ ঐতিহ্য হিসেবে ভাদ্র মাসে মামির হাতে ভাত খেতে হয়। এখনও ভাগ্নেরা মামার বাড়ি গিয়ে মামির হাতে ভাত খায়। কারণ ভাদ্র মাসে নানা ধরনের অসুখ বিসুখ লেগে থাকে। তাই বড়দের মতে, মামির হাতে ভাত খেলে বাকি ১১ মাস ভালো থাকা যায়। আধুনিক গবেষণায়ও দেখা যায় ভাদ্র মাসের ভেপসা গরম, ঋতু পরিবর্তন এবং আর্দ্রতার অধিক তারতম্যজনিত কারনে অনেক রোগ জীবানুর প্রাদর্ভাপ এ সময়ে অধিক পরিমানে লক্ষ্য করা যায়, যা ভাদর কাটানির মতো প্রাচীন রীতির যথার্থতাকে প্রমান করে এ কথা দ্যর্থহীনভাবেই বলা যায়। আবার একে ঘিরে ভাদ্র মাসের বিশেষ পিঠা-পুলি ও খাবারের আয়োজনও বাংলার গ্রামিণ সংস্কৃতির অন্যতম অনুসঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়, যা আবার গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখে এসেছে সেই আদিকাল থেকেই।
এ প্রসঙ্গে দিনাজপুরের ফুলবাড়ি এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি শশী মোহন রায় (৭৮) জানান, উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও’সহ ভারতের মুর্শিদাবাদ, জলপাইগুড়ি ও শিলিগুড়ি এলাকার বাঙালি সমাজেও এই প্রথা চালু আছে। তিনি বলেন, এই জন্য ভাদ্র মাসে রীতি অনুযায়ী বিয়ের আয়োজন তেমন একটা হয় না বললেই চলে। আমার বিয়ের সময় বিষয়টির সাম্যক গুরুত্ব আমি উপলব্ধি করি, কারন সেসময় আমার এক দাদা বলে বসেন যে, ভাদ্র মাসে বিয়ে দেয়া যাবেনা। যদিও মুসলিম সমাজে ভাদ্র মাসের বিধি-নিষেধ এখন তেমন মানা হয়না।
গ্রামীণ প্রথা অনুযায়ী যুগ যুগ ধরে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে পালিত হয়ে আসছে এই উৎসব। নিয়ম অনুযায়ী মেয়ে পক্ষ শ্রাবণ মাসের সাত দিন বাকি থাকতেই মেয়েকে বাবার বাড়ি নিয়ে আসতে ছেলের বাড়িতে আম, কাঁঠাল, কলা ও তাল’সহ মিষ্টি (জিলাপি), পায়েস (ক্ষির) নিয়ে যায়। সেই অনুষ্ঠানে ছেলে পক্ষও তাদের সাধ্যমত আপ্যায়ন করান।
দিনাজপুর জেলা সদরের রামনগর বাবুপাড়ার বিশিষ্ট সমাজসেবক বাবু ধীরেন্দ্র নাথ রায় (৮৫) জানান, এটি কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। তবে প্রথাটি দীর্ঘদিন ধরে সমাজে চলে আসছে। এক সময় হিন্দু স¤প্রদায়ের লোকেরা এই উৎসব ঘটা করে পালন করতো। আর এই রেওয়াজ বা রীতি বংশানুক্রমে উত্তরাঞ্চলের মানুষকে প্রভাবিত করে। এক পর্যায়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায় ‘ভাদর কাটানি উৎসব’।
এ উৎসবের রীতি অনুযায়ী, কমপক্ষে ভাদ্র মাসের প্রথম দিন হতে দশ দিন পর্যন্ত স্বামীর মঙ্গল কামনায় কোনো নববধ‚ তার স্বামীর মুখ দর্শন করবেন না। এ দর্শন না করানোয় সারা বছর স্বামীর মঙ্গল হবে বলে লোকজ বিশ্বাস। আগেই বলেছি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ‘ভাদর কাটানি’র কোনো ব্যাখ্যা না থাকলেও এ অঞ্চলের আদিপ্রথা অনুযায়ী, ভাদ্র মাসের পহেলা তারিখ থেকে শুরু হয়ে যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে ‘ভাদর কাটানি’ উৎসব। (অসমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন