শামীম চৌধুরী : বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যানের ব্যাট থেকে ওয়ানডে ক্রিকেটে এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে এক হাজার রান তখন মনে হতো অবিশ্বাস্য। কিন্তু অবিশ্বাস্য সেই কৃতিটাই প্রথম করেছেন বাঁ হাতি টপ অর্ডার শাহরিয়ার নাফিস। ১০ বছর আগের ঘটনা তা। ২০০৬ সালে ২৮ ওয়ানডে ম্যাচে ৩ সেঞ্চুরি ৪ ফিফটিতে ১০৩৩ রানÑহাওয়ায় উড়ছিলেন তখন এই বাঁ হাতি। বছরে শ্রীলঙ্কার উপল থেরাঙ্গার পর দ্বিতীয় সর্বাধিক রান করেছেন ওই বছরে। এমন পারফরমেন্সে আইসিসি’র সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় নাম পর্যন্ত ছিল শাহরিয়ার নাফিসের। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে ওয়ানডেতে একমাত্র হাজার রানে ইতিহাস রচনা করা শাহরিয়ার নাফিস গত ১ দশক ধরে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। টাকার মোহে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লীগ (আইসিএল) এ ঢাকা ওরিয়র্সের হয়ে খেলে যে কতো বড় পাপ করেছেন, সেই প্রায়াশ্চিত্ত করছেন বছরের পর বছর। যে ক্যারিয়ারটা হওয়ার কথা অনেক বড়, থেমে থেমে সেই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ২৪ টেস্ট ৭৫ ওয়ানডের পাশে মাত্র ১টি টি-২০, শাহরিয়ার নাফিসের শুরুর দ্যুতির সঙ্গে যে মানাচ্ছে না। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের অভিষেক টি-২০ ম্যাচটিই তার সংক্ষিপ্ত আন্তর্জাতিক টি-২০, তাও আবার ২০০৬ সালে খুলনায় অনুষ্ঠিত সেই টি-২০ ম্যাচে ১৭ বলে ২৫ রান করেও আর ফেরার সুযোগই পাননি এই ফরমেটের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে !
আইসিএল খেলার পাপ মোচনে লেগেছে মোশারফ রুবেলের সাড়ে ৭ বছর! লম্বা প্রতীক্ষার পর ফিরেছেন এই বাঁ হাতি স্পিনার। তবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত টেস্টকে সামনে যে ২ দিনের অনুশীলন ম্যাচে সফরকারীদের বিপক্ষে ফিফটির ইনিংস উপহার দিয়েও ম্যাচ শেষে ঢাকার ফ্লাইটে উঠতে হয়েছে শাহরিয়ার নাফিসকে! ঘরোয়া ক্রিকেটে ফর্মের ধারাবাহিকতার প্রমাণ দিচ্ছেন, তারপরও খুলছে না কপাল। টেস্টে কালে-ভদ্রে হতেন বিবেচ্য, দীর্ঘ পরিসরের সেই আন্তর্জাতিক ম্যাচেও ৩ বছর দলের বাইরে। নিজেকে চেনানোর মঞ্চ অবশিষ্ট ছিল শুধুই বিপিএল। লংগার ভার্সন ক্রিকেটের মেজাজ থেকে টুয়েন্টি-২০’র মেজাজ ফিরে পাবেন কিভাবে? সে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন শাহরিয়ার নাফিস। বিপিএলে ঢাকা পর্বে মেহেদী মারুফের আবির্ভাব দেখেছে দর্শক, বোলারদের উপর চাবুক চালানো টাঙ্গাইলের এই ছেলেটির স্ট্রাইক রেট ১৫৪.৫৪ বিস্মিত করেছে তার ফ্রাঞ্জাইজি ঢাকা ডায়নামাইটসকেও। বিপিএলে গেইলের সর্বোচ্চ ১১৬ রানের ইনিংস ছাড়িয়ে ১২২ রানের ইনিংসে এই ফরমেটকে নিজের ফরমেটের ক্রিকেট বলে উল্লেখ করতে পেরেছেন সাব্বির রহমান রুম্মান। তবে মারুফ, সাব্বির বিস্ময় ছাপিয়ে ঢাকা পর্বে আলোচনার কেন্দ্রে বরিশাল বুলস টপ অর্ডার শাহরিয়ার নাফিস। ৪ ইনিংসে ৩টি ফিফটি, ১৮৪ রানে সবার উপরে শাহরিয়ার নাফিস। যে ছেলেটির টুয়েন্টি-২০ ক্যারিয়ারে ৩৯টি ম্যাচে সর্বসাকূল্যে সংগ্রহ ৯৩২ রান, গড়টা ৩০.০৬, প্লেয়ার্স ড্রাফটে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে বিক্রি হওয়া ৩১ বছরের সেই ছেলেটিই বিপিএলের চলমান আসরের প্রথম ৪ ইনিংসে ৬১.৩৩ গড়ে রান করেছেন! টুয়েন্টি-২০ ক্যারিয়ারে স্ট্রাইক রেটটা যার ১০৯.০০, সেই শাহরিয়ার নাফিসের এই চার ইনিংসে স্ট্রাইক রেট ১৩৩.৩৩! আগের ৩৫ ম্যাচে যেখানে সর্বসাকূল্যে ছক্কা মেরেছেন ৮টি, সেখানে এই চার ইনিংসে সংখ্যাটি ৭! ভরা যৌবনেও শাহরিয়ার নাফিসের ব্যাট জ্বলেনি এতোটা।
এতোটা বদলে গেলেন কিভাবে ? তার উত্তরটা দিয়েছেন শাহরিয়ার নাফিস নিজেইÑ ‘সব সময় চেষ্টা করি আমার খেলার উন্নতি করার। নিজেকে ফিট রাখার। এখন ক্যারিয়ারের এমন একটা পরিস্থিতিতে আমি দাঁড়িয়ে, যেখানে নিজেকে এভাবে ধরে রাখতে পারলে আমি অনেক ওপরে চলে যাব। আর যদি নিজেকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হই, তাহলে পিছিয়ে যেতে হবে। এর আগে প্রায় ২ মাস জাতীয় দলের সঙ্গে কন্ডিশনিং ক্যাম্প এবং অনুশীলন ক্যাম্পে ছিলাম। বিপিএল শুরুর আগে বিকেএসপিতে সাত দিনের একটা ভালো ক্যাম্প হয়েছে। চেষ্টা করেছি আমার খেলাটার আরেকটু ফাইন টিউন এবং স্কিল একটু ভালো করতে।’
এক সময়ে ছিলেন শাহরিয়ার নাফিসের ওপেনিং পার্টনার। সেই পার্টনার অফ ফর্মে পড়ে হয়েছেন বিচ্ছিন্ন। সেই বিচ্ছিন্ন হওয়া পার্টনারকে এতোটা বদলে যাওয়া ব্যাটিং দেখে তামীম ইকবালও অভিভুতÑ‘আমি উনার শেষ ইনিংসটা মাঠে বসে দেখেছি, প্রথম ইনিংসটাও টিভিতে দেখেছি। এই মুহূর্তে বিপিএলে সবচেয়ে ভালো ব্যাটিং করছেন উনি। আমার কাছে মনে হয়, টি-টোয়েন্টি ফরমেটে রান করার জন্য অনেক কাজ করেছেন, যে শর্টসগুলা আগে সে খেলতো না, এখন সেগুলোও খেলছেন।’
২০১০ সালে কি ধুমকেতুর মতোই না আবির্ভূত হয়েছিলেন শফিউল। সে বছর নিউজিল্যান্ড সফরে নেপিয়ার এবং ডানেডিনে ২টি ওয়ানডে ম্যাচে ৭ উইকেট, সে বছরে ২৩ ওয়ানডে ম্যাচে ৩২ উইকেট! ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১১ সালে অল রাউন্ড পারফরমেন্সে বাংলাদেশ দলকে উপহার দিয়েছেন অবিশ্বাস্য জয়। কিন্তু ইনজুরি বার বার থামকে দিয়েছে পেস বোলার শফিউলের ক্যারিয়ার। সেই পেসার শফিউল এবার বিপিএল টি-২০তে চেনাচ্ছেন নুতনভাবে। ঢাকা পর্বে প্রথম ৪ রাউন্ডে শহীদের সঙ্গে যুগ্মভাবে সর্বাধিক ৮টি উইকেট শিকার করেছেন তিনি। ঢাকা ডায়নামাইটসের বিপক্ষে ম্যাচ উইনিং বোলিং (৪/২৮), তা আবার ক্যারিয়ারের ৫৩টি টুয়েন্টি-২০’র সেরা। আল আমিন, রুবেল হোসেনদের বাদ দিয়ে শফিউলকে নিউজিল্যান্ড সফরের দলে বিবেচনায় যে যুক্তি দেখিয়েছেন প্রধান নির্বাচকÑসে যুক্তির পক্ষেই যে কথা বলছে শফিউলের বোলিং। লাস্ট ওভার থ্রিলারে মাহামুদুল্লাহ ২টি ম্যাচ উইনিং বোলিং ছড়িয়েছে বিস্ময়। তবে খুলনা টাইটান্সের বোলিং সবচেয়ে বড় ট্রাম্প কার্ড যে শফিউল।
ঢাকা ১ম পর্ব শেষে বিপিএল
পয়েন্ট টেবিল
দল ম্যাচ জয় হার টাই/পরি. পয়েন্ট নে.রা.রে
ঢাকা ডায়নামাইটস ৪ ৩ ১ ০ ৬ +১.৬৫৭
বরিশাল বুলস ৪ ৩ ১ ০ ৬ -০.১২৭
খুলনা টাইটান্স ৪ ৩ ১ ০ ৬ -০.৭০৯
রংপুর রাইডার্স ৩ ২ ১ ০ ৪ +০.৪৬০
রাজশাহী কিংস ৩ ১ ২ ০ ২ +০.১৪০
চিটাগাং ভইকিংস ৪ ১ ৩ ০ ২ -০.২৪২
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ৪ ০ ৪ ০ ০ -১.১০০
সেরা ৫
ব্যাটসম্যান ম্যাচ/ইনি রান সর্বোচ্চ গড় স্ট্রাইক ১০০/৫০
শাহরিয়ার (বরিশাল) ৪/৪ ১৮৪ ৬৫ ৬১.৩৩ ১৩৩.৩৩ ০/৩
মুশফিক (বরিশাল) ৪/৪ ১৭৪ ৮১* ১৭৪.০০ ১৫১.৩০ ০/২
মারুফ (ঢাকা) ৪/৪ ১৭০ ৭৫* ৫৬.৬৬ ১৫৪.৫৪ ০/২
সাব্বির (রাজশাহী) ৪/৩ ১৫৭ ১২২ ৫২.৩৩ ১৫০.৯৬ ১/০
তামীম (চিটাগাং) ৪/৪ ১৪৩ ৭৫ ৩৫.৭৫ ১২৮.৮২ ০/২
বোলার ম্যাচ/ইনি. উইকেট সেরা গড় ইকো ৪/৫
শফিউল (খুলনা) ৪/৩ ৮ ৪/২৮ ৯.৫০ ৬.৩৩ ১/০
শহিদ (ঢাকা) ৪/৪ ৮ ৩/২১ ১১.৩৭ ৬.৯১ ০/০
আফ্রিদি (রংপুর) ৩/৩ ৭ ৪/১২ ৬.৫৭ ৪.১৮ ১/০
নবি (চিটাগাং) ৪/৪ ৭ ৪/২৪ ১০.৪২ ৫.২১ ১/০
জুনাইদ (খুলনা) ৪/৪ ৭ ৪/২৩ ১২.৫৭ ৬.২৮ ১/০
এক নজরে
সর্বোচ্চ দলীয়
ঢকা ডায়নামাইটস ১৯৪/৫, প্রতিপক্ষ কুমিল্লা
সর্বাধিক রান
শাহরিয়ার নাফীস, ৪ ম্যাচে ১৮৪
সর্বোচ্চ ব্যাক্তিগত
সাব্বির রুম্মান ১২২, প্রতিপক্ষ বরিশাল
সর্বাধিক ফিফটি
শাহরিয়ার নাফীস ৩টি (বরিশাল)
সবচেয়ে বড় জয়
ঢাকা ৭৮ রানে, প্রতিপক্ষ রংপুর
রংপুর ৯ উইকেটে, প্রতিপক্ষ চিটাগাং/খুলনা
সর্বাধিক ছক্কা
মেহেদী মারুফ ১০টি, ঢাকা)
সেরা পার্টনারশিপ
মালান-শাহরিয়ার (বরিশাল) ১৫০, প্রতিপক্ষ চিটাগাং
সর্বাধিক উইকেট
শফিউল (খুলনা)/শহিদ (ঢাকা), ৪ ম্যাচে ৮টি
সেরা বোলিং
আবুল হাসান (রাজশাহী) ৫/২৮, প্রতিপক্ষ খুলনা
সর্বাধিক ক্যাচ
সৌম্য (রংপুর), ৩ ম্যাচে ৩টি
সর্বাধিক ডিসমিসাল
সাঙ্গাকারা (ঢাকা), ৪ ম্যাচে ৭টি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন