রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১- ১৯৪১) বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারের উচ্চ সিংহাসনে আসীন করা মহাকবি। তিনি সমগ্রজীবন সাধনা করেছেন শিল্পের। শিল্পের সাধনায় তিনি সিদ্ধি লাভও করেছেন। বাংলা ভাষাকে ঐতিহ্যের আসনে তিনি বিশ্ব দরবারে নিয়ে গেছেন। নোবেল পুরস্কার দেওয়া শুরু হয় ১৯০১ সালে। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের অমৃত্য ভাণ্ডার ‘গীতাঞ্জলি’ (ঝঙঘএ ঙঋঋঊজওঘএঝ -১৯১২ ) এর জন্য নোবেল পুরস্কার পান ১৯১৩ সালে । কত বড় সিদ্ধি পুরুষ না হলে বিশ্বের অন্যান্য ভাষার সাহিত্যকে ডিঙিয়ে তিনি পেলেন নোবেল পুরস্কার। বাংলা সাহিত্য মর্যাদা পেলো। অন্য ভাষার সাহিত্য অনুপ্রাণিত হলো বাংলা কাব্যের সৌন্দর্যে। যদিও অনেকে ‘গীতাঞ্জলি’র পক্ষে বিপক্ষে মুখর। এই অর্জনের মাধ্যমে আমাদের ভাষা আরো বেশি উতকৃষ্ট হলো। কিন্তু আমাদের সৃষ্টি কি? আমরা কি সৃষ্টি করে চলেছি? রবীন্দ্রনাথ একটি বংশে জন্ম গ্রহণ করেন। অনেকে মনে করেন- বংশের ধর্মের জন্য রবি বাবু কাজ করেছেন। তা সম্পূর্ণ রবি ধর্মের বিরোধী। আপনি শিল্পের ধর্মের কাছে যান। তিনি সত্য-সুন্দর-কল্যাণের তথা মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করেছেন। তাহলে বংশ ধর্ম নয় কর্ম ধর্মে রবীন্দ্রনাথের পরিচয়। তার সাহিত্য বিশ্বে কর্মী মানুষের জন্য, কর্মই ধর্ম, যা মানব কল্যাণে পৃথিবীর বয়স অবধি চলতে থাকবে। রবীন্দ্রনাথ সেই কর্মযোগী যিনি তার কর্মের ওপরে ছিলেন সম্পূর্ণ আস্থাশীল। তিনি জানতেন কর্ম ধর্ম কাউকে কখনো বঞ্চিত করে না। কর্ম গুণগাণ করবেই। এই যোগি সিদ্ধি পুরুষ দেহ ত্যাগ করে কর্মের মাধ্যমে মিশে গেছেন বাংলার প্রতিটি গৌরবময় সৌন্দর্যময়, যা কিছু আছে তার সাথে। আজ বাংলা ভাষার প্রতিটি স্তরে আছেন রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রত্যহিক জীবনে সমগ্র কথামালায় যৌবনময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথ মানুষের জন্য কাজ করেছেন। সেহেতু মানুষ যতদিন আছে, ততদিন রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক। তিনি ভালোভাবে জানতেন, শত বছর বা হাজার বছর পরেও মানুষ তার গান তথা কর্মকে মনে রাখবে। তিনি কত উচ্চ মার্গের সিদ্ধি পুরুষ ছিলেন যে, তার কৃতকর্মকে শত বা হাজার বছর পরেও মানুষ স্বরণ করবে- তিনি জানতেন। কর্মের মাধ্যমে তিনি যুগ যুগ ধরে প্রাসঙ্গিক হবে। তার সেই দৃঢ় উচ্চারণ
“ আমার বসন্তগান তোমার বসন্তদিনে/ধ্বনিত হউক ক্ষণ তরে/হৃদয়স্পন্দনে তব ভ্রমরগুঞ্জনে নব/পল্লবমর্মরে/আজি হতে শতবর্ষ পরে।” (১৪০০ সাল)।
একজন মা সন্তানের জন্য সবোর্চ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন। সন্তানের জন্য তার পরিশ্রমের বিকল্প পৃথিবীতে নেই। মাতৃত্বের স্বাদ নিতে গিয়ে তাকে কঠোর পরিশ্রমী কর্মী হতে হয়েছে। মায়ের এই কর্ম সন্তানর জীবনে তাকে অমর করে রাখে। সুতরাং আমাদের কর্মী হতে হবে। কর্মই পারে মৃত্যুকে জয় করে পৃথিবীতে অবস্থান করতে।
‘জানলা থেকে তাকাই দূরে/নীল আকাশের দিকে/মনে হয়, মা আমার পানে/ চাইছে অনিমিখে/কোলের ‘পরে ধরে কবে/দেখত আমায় চেয়ে/সেই চাউনি রেখে গেছে/সারা আকাশ ছেয়ে।” (মাকে আমার পড়ে না মনে)
কর্মীর হাতে লোহা হাতিয়ার হয়েছে। মানুষের সাধনায় অনাবিষ্কৃত অনেক কিছু উন্মোচিত হয়েছে। যা মানব কল্যাণে বিরাট অবদান রাখছে। জগত গতিশীল হয়েছে। গতিশীলতায় প্রাণ। কবিগুরু উচ্চারণ করেছিলেন ‘কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন, ও তার ঘুম/ভাঙাইনু রে।/লক্ষ যুগের অন্ধকারে ছিল সঙ্গোপনে, ওগো, তায় জাগাইনু রে।/পোষ মেনেছে হাতের তলে যা বলাইস সে তেমনি বলে-/দীর্ঘ দিনের মৌন তাহার আজ ভাগাইনু রে।/ অচল ছিল, সচল হয়ে ছুটেছে ওই জগৎ-জয়ে-/নির্ভয়ে আজ দুই হাতে তার রাশ বাগাইনু রে। (কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে)।
জগতজুড়ে কর্মের জয়োগান। কর্মকে মানুষ গ্রহণ করে। যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পেরেছিলেন। তিনি কর্মের মাধ্যমে যৌবন ধরে রেখে বিচরণ করছেন চরাচরে।
‘এতকাল নদীকূলে/ যাহা লয়ে ছিনুভুলে/সকলি দিলাম তুলে/থরে বিথরে’ (সোনার তরী)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন