মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

দুঃখী রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর রসবোধ

হোসেইন আহমদ চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৩ মে, ২০২২, ১২:০১ এএম

কবিরা দুঃখ পোষেন। কেউ কেউ প্রচ্ছন্ন রসিকতা দিয়ে তাদের দুঃখকে আড়াল করার চেষ্টা করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তেমনি এক মহান কবি। তিনি শ্রেষ্ঠতম এক বাঙ্গালি, যিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বসভায় অধিষ্ঠিত করেছেন। ইয়েটস বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ হলেন দ্বিতীয় যীশু আর গীতাঞ্জলি দ্বিতীয় বাইবেল।

কবির যখন ৪১ বছর বয়স, তখন তাঁর স্ত্রী মারা যান। রবীন্দ্রনাথ ও শমীন্দ্রনাথ নামে কবির দুই ছেলে এবং বেলা, রানী ও অতশী নামে তিন মেয়ে ছিলেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে মারা গেলেন রানী, মারা গেলেন শমীন্দ্র। বড়ো মেয়ের জামাই ও দ্বিতীয় মেয়ের জামাই দুজনকে পাঠিয়েছিলেন বিলেতে। একজনকে ডাক্তারি পড়তে এবং একজনকে ব্যারিস্টারি পড়তে। উভয়েই ফিরে এলেন লেখাপড়া শেষ না করেই। ছোট মেয়ের জামাইকে পাঠিয়েছিলেন আমেরিকায় কৃষিবিদ্যার উপর পড়াশোনা করতে। এই লোক টাকাপয়সা চেয়ে কবিকে বিরক্ত করতো বারবার।

বড়ো মেয়ের জামাই বিলেত থেকে আসার পর কবির সাথে চরম বেয়াদবি শুরু করে। কবির সামনে টেবিলের উপর পা তুলে বসে সিগারেট পর্যন্ত খেতো। এর পরেও কবি তাঁর অসুস্থ বড়ো মেয়েকে দেখতে যেতেন। একদিন যাওয়ার পথে শুনতে পান তাঁর বড়ো মেয়ে মারা গেছেন। সেদিন কবি আর মেয়ের লাশ দেখতে যাননি, মাঝপথ থেকে ফিরে আসেন। গভীর শোকে কবি লিখলেন-
“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।”

রবীন্দ্র গবেষক ড. শফি উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “রবীন্দ্রনাথ এমনই এক মহৎ কবি, যার লেখার উপর কিছু বলতে গেলে বরং এর সৌন্দর্যকেই নষ্ট করা হয়”। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি সম্পর্কে কোনো কিছু লিখে সৌন্দর্য নষ্ট করার মতো ধৃষ্টতা আমি দেখাবো না। এ দুঃসাহস আমার নেই। এটি রথী মহারথী গবেষকদের কাজ। আমি শুধু রবীন্দ্রনাথের প্রচ্ছন্ন রসিকতার কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করছি।

একবার একলোক কবিগুরুর কাছ থেকে দশ টাকা ধার নিয়েছিল। সে সময় দশ টাকা অনেক বড় অঙ্কের টাকা ছিলো। লোকটি কবিগুরুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে বলেছিল, আমি আপনার কাছে চির ঋণী হয়ে রইলাম। এ সম্পর্কে গল্প করতে গিয়ে কবি বলেছিলেন, “লোকটি আসলে সত্যবাদী ছিলো”। কি রকম সত্যবাদী ছিলো, এ প্রশ্ন করলে কবিগুরু বলেন, “সে টাকাটা আর ফেরত দেয়নি, চিরঋণীই রয়ে গেলো”।

শান্তিনিকেতনের কনিষ্ঠতম অধ্যাপক ছিলেন নিত্যানন্দ বিনোদ গোস্বামী। তিনি ছিলেন স্থূলকায়। তাঁর এই বিরাট শরীরের জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আপনি বলে সম্বোধন করতেন। কবিগুরুকে নির্জনে পেয়ে একদিন গোঁসাইজী বললেন, “গুরুদেব, আপনি আমাকে আপনি সম্বোধন করেন কেনো?” একথা শুনে কবিগুরু স্মিত হেসে বললেন, “সে আর আমার কী দোষ বলো, তোমার যে বিশাল দেহ অন্তত তার মর্যাদা তো দিতে হবে”।

সাহিত্যিক বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল) এক সভায় বক্তৃতা করছিলেন। রবীন্দ্রনাথও সে সভায় উপস্থিত। বলাই বাবুর বক্তৃতা শুনে সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সবার মুখে প্রশংসা শুনে কবিগুরু হেসে বললেন, “বলাই তো ভালো বক্তৃতা দেবেই, ওর নামই তো বলাই। বলা-ই হচ্ছে ওর কাজ”।

একবার কবিগুরু বোলপুর যাচ্ছেন। ট্রেন বর্ধমান স্টেশনে থেমেছে মাত্র। এমন সময় একগাদা লাগেজপত্র নিয়ে সিগারেট মুখে এক কৃষ্ণকায় সাহেব কবির কামরায় ঢুকে পড়লেন। রিজার্ভড কামরা কিন্তু সাহেবের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এহেন কান্ড দেখে কবির সঙ্গীরা হা-হা করে উঠলেন। সাহেব হিন্দি-ইংরেজি মিলিয়ে যা বললেন তার অর্থ দাঁড়ায় -- অন্যান্য কামরায় তিল ধারনের জায়গা নেই, তাই বলে কি উনি যাবেননা? এবার কবি নিজেই মুখ খুললেন, জানতে চাইলেন- মহাশয়ের পরিচয় কী? সাহেবের দুরন্ত জবাব- কেনো, মানুষ! একথা শোনার পর কবির মুখে হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়লো, বললেন- যাক, সন্দেহ ভঞ্জন হলো।

রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে ঠাকুর পরিবারের কয়েকজন বসে গল্প করছিলেন। এমন সময় সৌমেন্দ্রনাথ বললেন, “দাদু, আমরা কিন্তু আপনার জন্ম শতবার্ষিকী পালন করবো”। একথা শুনে কবি বাঁকা হেসে বললেন, “ভারী তো তোমাদের জন্ম শতবার্ষিকীর মূল্য মাত্র পঁচিশ টাকা”। সবাই অবাক, রবীন্দ্রনাথ এসব কী বলছেন, বিশ্বকবির জন্ম শতবার্ষিকীর মূল্য পঁচিশ টাকা। এর মানে কী? সকলের মুখোভাব লক্ষ্য করে কবিগুরু হেসে বললেন-- বুঝলেনা “শতবার সিকি” মানে তো পঁচিশ টাকাই দাড়ায়।

আরেকটি ঘটনা, এক গানের আসরে প্রখ্যাত গায়ক গোপেশ্বর বাড়ুজ্জে গান গাইছেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথ শ্রুতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। গোপেশ্বর বাবুর গান শেষ হলে কবির ভক্তরা তাঁকে গান শোনানোর জন্য ধরলো। কবিগুরু কোনো রকম ‹কিন্তু‹তে না গিয়ে কৃত্রিম গাম্ভীর্যের সাথে বললেন- “গান গাওয়াটা তো বড় কথা নয় হে, আসল কথা হলো, গোপেশ্বরের পরে কি আর দাঁড়িশ্বর মানাবে?”

সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের সফল পদচারণা ঘটেনি। তাঁর মস্তিষ্ক সবসময় থাকতো সৃষ্টিশীল চিন্তায় ব্যস্ত। সেই রবীন্দ্রনাথও ব্যক্তি জীবনে ছিলেন একজন দুঃখী মানুষ। দুঃখকে আড়াল করতেন প্রচ্ছন্ন রসিকতা দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের এসকল রসিকতা কোনো পরিহাস স্বরূপ ছিলো না, ছিলো নিরেট রসিকতা মাত্র।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন