নয়ন তোমারে পায়না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে
হৃদয় তোমারে পায়না জানিতে
হৃদয়ে রয়েছ গোপনে
রবীন্দ্রনাথের জীবনে কে এই নারী? যাকে উদ্দেশ্য করে বিশ্বকবি এই চরণগুলো সৃষ্টি করেছিলেন? তিনি কি একজন না কি বহুজন? রবীন্দ্র জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রেমিক কবি রবীন্দ্রনাথের জীবনে বিভিন্ন পর্যায়ে অন্তত: পাঁচজন নারীর প্রচন্ড প্রভাব বিদ্যমান। এই নারীরা একাধারে দীর্ঘসময় কবির সাহচর্যে না থাকলেও তারা তাঁকে সিক্ত করেছেন প্রেমরসে এবং তাঁর জীবনকে করে তুলেছেন রংগীন, প্রেমময় এবং সমৃদ্ধ। এই পঞ্চরমণীরা হলেন কাদম্বরী বৌঠান, মারাঠী কন্যা আন্না তড়খড়, আর্জেন্টিনার সুন্দরী ষোড়শী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, রবীন্দ্র কাব্যের গুণমুগ্ধ পাঠিকা হেমন্তবালা দেবী এবং রানু অধিকারী। সতের থেকে তেষট্টি এই দীর্ঘ পরিক্রমায় এরা ছাড়াও রবীন্দ্র হৃদয়ে অনেকেই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে প্রেমের ছোঁয়া এঁকে তাঁকে করেছেন উজ্জীবিত, সৃষ্টিশীল এবং উন্মন। তবে কবি জীবনে সবচেয়ে প্রেম জাগ্রতকারী হিসাবে এই পাঁচজনকেই উল্লেখ করা যায়। কিশোর রবীদ্রনাথের জীবনে প্রথম প্রেমিক রমণী হিসেবে আবির্ভূত হন কাদম্বরী দেবী। দাদা জ্যোতিন্দ্রনাথ এর কিশোরী স্ত্রী কাদম্বরী রবীন্দ্রবৃক্ষে প্রথম প্রেমের কলি ফোটাতে সক্ষম হন। রবীন্দ্রকাব্যের প্রথম প্রেরণাদাত্রী হিসেবে কাদম্বরী’র নাম চিরস্বরণীয় হয়ে থাকবে।
কাদম্বরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সমবয়সী। ব্যক্তিজীবনে স্বামীর ব্যস্ততায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া এই কিশোরী বধু সংগত কারণেই আকৃষ্ট হয়ে পড়েন সমবয়সী দেবরটি’র প্রতি। তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মে কাদম্বরী’র উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা তাঁকে ক্রমশঃ এগিয়ে নিতে থাকে পরিণতির দিকে। রবীন্দ্রনাথের চারুলতা যেন কাদম্বরী’র-ই প্রতিচ্ছবি।
রবিঠাকুরের বয়স তখন সতের। সতের বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের জীবনে আসে মারাঠী তরুণী আন্না তড়খড়। যাকে রবীন্দ্রনাথ আখ্যায়িত করলেন ‘ণলিনী’ নামে। বয়সে বড় হলেও বিদুষী, বুদ্ধিমতী, অপরূপ সুন্দরী বিলেত ফেরৎ আন্না কবিকে খুব সহজেই আকর্ষিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইংরেজী ভাষা শেখাবার পাশাপাশি তিনি কবির সাথে তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিলেন একটি অপূর্ব প্রণয়ের সম্পর্ক। মুলতঃ প্রণয় বলতে যা বোঝায় সেই বৃক্ষটির ডালপালা, ফুলফল গজাতে পরিপূর্ণভাবে সক্ষম হয়েছিলেন আন্না। আন্না’র সাথে সরাসরি মাসাধিক কালের সম্পর্ক থাকলেও তাদের মধ্যে পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ ছিলো দীর্ঘদিন। আঠার বছর বয়সে বিলেত প্রবাসী রবীন্দ্রনাথের সাথে স্কট কন্যা লুসি’র সম্পর্ক তৈরীর কথা শোনা যায়। তবে তা খুব একটা আলোড়ন তোলেনি। যদিও লুসি’র জন্য কবির একটি দীর্ঘশ্বাস ভেসে বেড়িয়েছিল দীর্ঘদিন। তাঁরই একটি রচনায় কবি এমনটিই উল্লেখ করেছিলেন-
‘কিন্তু আহা, দুদিনের তরে হেথা এনু
একটি কোমল প্রাণ ভেঙ্গে রেখে গেনু’।
রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ঊনত্রিশ বছরের ছোট ভিক্টেরিয়া ওকাম্পোর সাথে কবির প্রেম সত্যিই যেন একটি মিথ। প্লাতা নদীর তীরে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সত্যিকার অর্থেই প্রেম নামক অমৃত রসের সন্ধান লাভ করেছিলেন ওকাম্পো’র নীল চোখে।
রবীন্দ্রনাথের জীবনে হেমন্তবালা রায় চৌধুরীর প্রভাবও কম নয়। হেমন্তবালা’র সাথে কবির প্রণয়ের কথা অনেকটাই স্পষ্ট করেন কবির জীবনীকারগন। হেমন্তবালা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের একজন গুণমুগ্ধ পাঠিকা। কবিকে তিনি ডাকতেন ‘কবিদাদা’ হিসেবে। যদিও কবির সাথে হেমন্তবালার যোগাযোগ ঘটতো পত্রে। তবুও মাঝে মাঝে তিনি এসে হাজির হতেন জোড়াসাঁকোর বাড়ীতে। হেমন্তবালার একটি পত্রে রবিঠাকুরকে উল্লেখ করা একটি লাইন ছিল এরকমইÑ
“আপনি আমার দেবতা। আমার কল্পলোকের রাজা। আমার দূর্ভাগ্য যে আমার পূর্ণপুজা আপনার চরণে দিতে পারছিনা। আপনি কি আমার মন বুঝতে পারছেন না?”
রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য প্রিয়জনের মৃত্যুর যন্ত্রনা বুকে ধারণ করেও সৃষ্টিশীলতায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পেরেছেন শুধুমাত্র এই সমস্ত নারী এবং তাদের পূর্ণপ্রেমের নিবিড় ছোঁয়ায়।
রবীন্দ্রজীবনের সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য প্রেম রানু। এই রানু অধিকারী রবীন্দ্রনাথের সব গল্প পাঠের পর কবিকে পত্র মারফত অনুযোগ করেন তিনি সাম্প্রতিক সময়ে এত কম গল্প লিখেছেন কেন? রবীন্দ্র সান্নিধ্য লাভের জন্য তিনি ছুটে আসেন কলকাতায়। রবীন্দ্র গবেষকদের ধারণা এই রানুই কবির জীবনের অন্তিম প্রেম।
প্রেম শাশ্বত। প্রেম সুন্দর। প্রেম অবিনাশী। সৃষ্টিশীলতার জন্য প্রেমের অবদান অনস্বীকার্য। এ লেখায় যাদের কথা উল্লেখ করা হলো তারা কোনো না কোনো সময়ে রবীন্দ্রনাথকে প্রেমের ছোঁয়া দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন আর সমৃদ্ধ করেছেন তার সৃষ্টিশীল জগৎ। এরা ছাড়াও আরো অনেকের কথা যাদের নাম ইতিহাসে অন্তর্ভূক্ত হয়নি। তারাও সংগতভাবেই রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীলতার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে আছেন। আর একজনের কথা উল্লেখ না করলেই নয়, তিনি তাঁর স্ত্রী মৃণালিণী দেবী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন