ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ব্যবস্থায় অনুন্নত রাষ্ট্রের অধিবাসীরাও কিছু কিছু শ্রেণিকে ‘ধোয়া তুলসী পাতা’ হিসেবে পাওয়ার আশা করেÑ যেমন শিক্ষক শ্রেণি, বুদ্ধিজীবী শ্রেণি, চিকিৎসক শ্রেণি। এ দেশে জাত-পাত, মান-মর্যাদা নির্বিশেষে সব শ্রেণি দূষিত হয়ে পড়েছে। তবে আর ব্যাধিগ্রস্ত রাজনীতিক শ্রেণি ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসক শ্রেণির উপর সমস্ত কলঙ্ক চাপিয়ে বাকিদের অবমুক্তিদানের প্রয়াস কেন?
প্রসঙ্গ অন্যখানে। দেশের বরেণ্য লেখকরাও যখন নির্বিচারে নির্দিষ্ট শ্রেণি বা দলের স্তুতি এবং বিপক্ষ শ্রেণি বা দলের বিরুদ্ধে একগাদা বিষোদোগার উৎপাদন করে কাগজ ভরিয়ে ফেলেন, তখন তাদেরও ‘দূষিত লেখক‘ শ্রেণির মধ্যে অবলীলায় ছুড়ে ফেলে দেয়া যায়। যে লেখক একটি শ্রেণি বা দলের ভালো কাজগুলো এবং অন্য শ্রেণি বা দলের কেবল ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলোকেই চোখ রগড়িয়ে রগড়িয়ে দেখেন, তিনি কখনো লেখকের আর্দশ ও দায়বদ্ধতার অনুসারী নন।
এটা কিভাবে সম্ভব এই আধুনিক যুগে, যখন এদেশের সব শ্রেণি বা দলই কোন না কোনভাবে দূষিত হয়ে পড়ছে; একটি পক্ষের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো গোপন করে অন্যপক্ষের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো ঢোল পিটিয়ে প্রকাশ করা? এই হীন কর্ম কোন ফরমায়েশি লেখক, পেশাদার কলম চালিয়ে করলে বোদ্ধা পাঠক যতটা ঘৃণা উদ্গিরণ করেন, কষ্ট পানÑ একজন দেশবরেণ্য স্বনামধন্য লেখক করলে ততোধিক ঘৃণা উদ্গীরণ করেন, কষ্ট পান। লেখকের কাজ সত্য উদ্ঘাটন করা ও সত্য প্রকাশ করাÑ সত্যের অপলাপ বা সত্যগোপন নয়। কিন্তু আজকের অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখক, কবি-সাহিত্যিকগণ চরম বেহায়ার মতো সত্য গোপন করে, কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে একপেশে বক্তব্য ধারাবাহিকভাবে লিখে চলেছেন। এই সমস্ত লেখক কোন পথে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন অথবা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কোন পথে গিয়েছেনÑ বোদ্ধা পাঠকমাত্রই তা যথেষ্ট বোঝেন এবং তাদের লেখায় কদাচিৎ চোখ বুলালেও একটা গভীর উপহাসের সাথে, তীব্র অবজ্ঞার সাথে চোখ বুলান বৈ শ্রদ্ধার সাথে নয়।
হ্যাঁ, আমি আমার মূল্যবোধের অধীন, আমার রুচি-অভিরুচির অধীন; আমি আমার চিন্তা-চেতনা ও আত্মবিবেকের অধীন। সুতরাং ব্যক্তি হিসেবে জন্মগতভাবেই আমার একটা পক্ষ থাকবে। আমার আদর্শ-মূল্যবোধ, আমার চিন্তা-অভিরুচি অনুযায়ী যে দল বা গোষ্ঠী চিন্তা-ভাবনা করবে, সেই অনুযায়ী কাজ করবেÑ অবশ্যই আমি তাকে সমর্থন করব এবং তার পক্ষাবলম্বন করব। কিন্তু কোন দল বা গোষ্ঠী যদি পথভ্রষ্ট হয়ে এমন কাজ করতে থাকে যা আমার চিন্তা-অভিরুচি সায় দেয় না, যা আমার বিবেককে ব্যথিত করেÑ তখনো কি আমি তাকে সমর্থন করব এবং তার অন্যায় কাজগুলোকে সেভাবে ঢেকে রাখব যেভাবে একটি বেড়াল তার বিষ্ঠা বালু বা আবর্জনা দিয়ে ঢেকে দেয়? আর যখন সেই দল বা গোষ্ঠীর অন্যায়-অপকর্মগুলো জনসম্মুখে উন্মোচিত হয়ে পড়ে তখন কেবল নিরপেক্ষতার মুখোশ পরার উদ্দেশ্যেই সে অন্যায়-অপকর্মগুলোর দায়সারা হালকা সমালোচনা করে চুপসে যাব যেখানে বিপক্ষ দল বা গোষ্ঠীর পান থেকে চুন খসলেই আমি শ্বাপদের মতো হিং¯্র ভাষায় তার সমালোচনায় মেতে উঠি? বিপক্ষ দল বা গোষ্ঠীর যে সমস্ত অন্যায়-অবিচার-অপকর্মের বিরুদ্ধে আমার বিবেক অতন্দ্র প্রহরীর মতো ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করে, নিজের সমর্থিত দল বা গোষ্ঠীর একই রকম অন্যায়-অবিচার-অপকর্মের বিরুদ্ধে আমার বিবেককে পাথর চাপা দিয়ে রাখি কেন, আমার কলমের ধার তখন কমে যায় কেন? তবে কি আমার লেখকসত্তা ছলনায় শঠতায় পূর্ণ নয়? আমার শ্রেয়নীতির আলোকে দল-মত-নির্বিশেষে যা কিছু ভালো; আমার লেখনী তার স্তুতি করবে এবং যা কিছু মন্দ, তার নিন্দা করবেÑ এই তো সহজ হিসাব।
বিশ্বায়নের যুগে শত শত পথ ও শত শত মত, সেগুলোর পারস্পারিক সংশ্লেষণ ও অভিযোজনের ফলে ভালো-মন্দ নির্ধারণ খুবই পরিশ্রমসাধ্য কাজ হয়ে পড়েছে। স্থূলবুদ্ধির সাহায্যে কোন মত, বিষয় বা প্রপঞ্চকে ঢালাওভাবে ভালো-মন্দ সাদা-কালোভুক্ত করার সুযোগ ছিল কয়েক শতাব্দী আগেÑ এখন আর নেই। সেক্ষেত্রে অনেক অনেক রীতিনীতি, বিধিবিধান ও প্রথার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোন দল বা গোষ্ঠীকে কিভাবে, কোন যুক্তিতে ঢালাওভাবে ভালো-মন্দভুক্ত করা যায়? উল্লেখ করা যেতে পারে যে কোন দল বা গোষ্ঠীর মূল আদর্শ যদি লেখকের ব্যক্তি আদর্শকে ইতিবাচকভাবে স্পর্শ করে, তবে সে লেখক সেই দল বা গোষ্ঠীর অনুরাগী হতেই পারেন, অকুণ্ঠ ভূয়সী প্রশংসাও করতে পারেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সে দল বা গোষ্ঠী নিজ আদর্শচ্যুত হয়ে অন্যায় অগ্রহণযোগ্য কাজে লিপ্ত হলে লেখকও তার আদর্শ বিসর্জন দিয়ে তার কঠোর সমালোচনা-ভর্ৎসনা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। সুলেখকের দলভুক্ত হওয়ার দরকার নেই, সংগঠনের প্রয়োজন নেই। তার মূল্যবোধ, নীতিবোধ, জীবনবোধ তথা বিবেকবোধই কোন দলভুক্ত না হওয়ার ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারে। পার্থিব স্বার্থলাভের উদ্দেশ্যে রচিত ফরমায়েশি লেখার সাথে লেখকসত্তার কোন সম্বন্ধ থাকে নাÑ সম্বন্ধ থাকে লেখকের বিকৃত ও শঠসত্তার। ‘নুন খাই যার গুণ গাই তার’ খয়ের খাঁর ধর্ম, লেখকের ধর্ম মোটেই নয়।
‘পোষা বাঘ বাঘ নয়’। পোষা শিল্পী ও সাহিত্যিক সত্যিকারের শিল্পী বা সাহিত্যিক নয়। পোষা বাঘে সার্কাসের খেলা দেখানো চলে। সে তার বিক্রমের পরিচয় নয়। পোষা শিল্পী ও সাহিত্যিকও শব্দ এবং সঙ্গীতের খেলা দেখাতে পারেন কিন্তু তা আন্তরিকতা শূন্য, সে নিষ্প্রাণ শব্দ বা সুর চাতুর্য মানুষের বিবেককে অলোড়িত করতে পারে না।’
এই লেখায় আবুর ফজলের উপরোক্ত কয়েক ছত্র খুব প্রাসঙ্গিক। আজকালকার পোষা শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক, কলামিস্টদের দ্বারা আর যা-ই হোক, এদের দ্বারা দেশের শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য কিংবা জনকল্যাণের আশা দুরাশা মাত্র।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন