মধুমাস জ্যৈষ্ঠের সবে শুরু। এ সময় তীব্র খরায় প্রকৃতি পুড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে উল্টো বন্যায় ডুবছে দেশ। বর্ষাকাল আসতে এখনো ২৫-২৬ দিন বাকি। তবে এরই মধ্যে ভারত থেকে আসা ঢলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দেখা দিয়েছে ব্যাপক বন্যা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বন্যা বেড়েই চলেছে। গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে ক্রমেই তা দৃশ্যমান হচ্ছে। ২০২০ সালের বন্য দীর্ঘ ৫২ দিন ধরে চলছে। স্থায়িত্বের দিক থেকেও এই বন্যা সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। এবারও দেশে অনেক তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যার আশঙ্কা করছেন বন্যা ও নদী বিশেষজ্ঞরা।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন ভারতীয় অঞ্চলগুলোয় ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে ইতোমধ্যে হাওরাঞ্চলের ছয় জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জে বন্যা দেখা দিয়েছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জে রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকেছে। লাখ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দি। দেশের কথিত ডিজিটাল সিলেট সিটি এখন পানির নিচে। সুরমা নদীর পানি উপচে একাকার এখন সিলেট নগরী। বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। নেত্রকানার কলমাকান্দা, মোহগঞ্জ ও মদন উপজেলায় বোরো ফসলের জমি তলিয়ে গেছে। কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন উপজেলায় বিভিন্ন হাওরে বোরো ধানের জমি তলিয়ে গেছে। তিস্তা পাড়ের কয়েকটি জেলা যেমন কুড়িগ্রাম, গাইবান্দা, লালমনির হাট ও রংপুরের চরাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে যমুনার পানি বৃদ্ধির ফলে সিরাজগঞ্জ, টঙ্গাইল এসব জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নদ-নদীর পরিস্থিতি ও পূর্বাভাস প্রতিবেদনে গতকাল জানিয়েছে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। দেশের উত্তরাঞ্চলের ধরলা, তিস্তা ও দুধকুমার নদীর পানি বৃদ্ধি আগামী ২৪ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে।
গত কয়েক বছরে বন্যার পানি বৃদ্ধির পরিমাণ চারটি রেকর্ড ভেঙেছে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পানি আগের সব রেকর্ড ভেঙে ২০১৬ সালে সবচেয়ে উঁচুতে ওঠে। ২০১৭ ও ২০১৯ সালে তা উপর্যুপরি রেকর্ডভাঙা উচ্চতায় ওঠে। ২০২০ সালে বন্যার পানি তিস্তা অববাহিকায় বিপৎসীমার ৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। এটি এই অববাহিকার জন্য একটি রেকর্ড। এ ছাড়া স্থায়িত্বের দিক থেকেও ২০২০ সালের বন্য দীর্ঘ ৫২ দিন ধরে চলছে। স্থায়িত্বের দিক থেকেও এই বন্যা ১৯৯৮ সালের পর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।
ঋতু পরিক্রমায় বাংলাদেশে সাধারণত বন্যা আসে জুন-জুলাই মাসে। অন্যদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী গত প্রায় দশ বছর ধরে বছরে দুই ধাপে বন্যা আসছে। প্রথমধাপ জুলাই-আগস্টে এবং দ্বিতীয়ধাপে বন্যা আসে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। তবে এবার ঋতুচক্র বা আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণ সব কিছুকে উল্টে দিয়ে মে মাসে আর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ মাসে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে দেশের হাওরাঞ্চল।
এ বিষয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, গত এক যুগে মূলত ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বন্যা বেড়ে যাওয়া আমরা প্রত্যক্ষ করছি। আর বাংলাদেশে যত পানি আসছে, তার বেশির ভাগ ব্রহ্মপুত্র দিয়ে আসছে। ওই পানি মেঘনা দিয়ে পদ্মা হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ছে। ফলে বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে বাড়ছে। এ ছাড়া দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয়, হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও মিজোরাম প্রদেশে ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলও বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে।
বন্যা ও নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বর্ষা মৌসুমে বন্যার পরিধি আরো বাড়বে। এটি আগের বছরের চেয়ে ৪০ শতাংশের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ রকমই পূর্বাভাস দিচ্ছেন জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে এলনিনো অঞ্চলের তাপমাত্রা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় প্রভাব ফেলে। চলতি বছর এলনিনো অঞ্চলের তাপমাত্রার কারণে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বর্ষায় বেশ প্রভাব ফেলবে এবং বন্যার পরিধি বাড়তে পারে। এ ব্যাপারে পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ইনকিলাবকে বলেন, বন্যা ঋতুবৈচিত্রের একটি স্বাভাবিক রূপ। বন্যা আমাদের দেশকে উর্বর করে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অসময়ে যে বন্যা হচ্ছে তা প্রতিকারের জন্য অবশ্যই পূর্ব প্রস্তুতি প্রয়োজন। সে প্রস্তুতি আমাদের কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন। প্রতি বছরই হাওরাঞ্চল পাহাড়ি ঢলে ডুবছে। হাওর রক্ষায় যে বাঁধ নির্মাণ করা হয় সেগুলো অপরিকল্পিত। প্রতি বছরই বাঁধ ভেঙে হাওরের ফসল তলিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও আমাদের নদীগুলো নাব্য হারিয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে বন্যার বিস্তৃতি বাড়ছে। দেশের নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনসহ অন্যান্য সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বন্যা মোকাবিলায় একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সিলেট থেকে ফয়সাল আমীন জানান, বৃষ্টি কমলেও ভারতের ঢলে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে সিলেটের সর্বত্র। নদ নদী ফুলে-ফেঁপে নগর, লোকালয় পানিতে সয়লাব। বাদ নেই দেশের কথিত ডিজিটাল সিলেট সিটি। সুরমা নদীর পানি উপচে একাকার এখন সিলেট নগরী। কয়েকদিন থেকে হঠাৎ করেই সুরমার পানি বাড়ায় বেশ আতঙ্কের মধ্যেই রাত পার করেছেন সিলেট নগরীর কয়েক হাজার মানুষ। যত সময় যাচ্ছে বন্যা পরিস্থিতির ততোই অবনতি হচ্ছে। গতকাল (মঙ্গলবার) সকাল থেকে নগরীতে অপ্রতিরোধ্য গতিতে প্রবেশ করে সুরমার পানি। এরমধ্যে দিয়ে ২২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীতে সিলেট সিটি করপোরেশেনের ড্রেন নির্মাণ প্রকল্পের উপযোগিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠে। ঘটনা এখানে শেষে নেই নগরীর বিভিন্ন স্থানে সুরমা ডাইক পড়েছে ঝুঁকির মধ্যে। এর মধ্যে সিসিকের নব বর্ধিত এলাকা বরইকান্দি ও কুচাই পশ্চিমভাগ আবাসিক এলাকার সুরমা ডাইক নিয়ে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন স্থানীয় অধিবাসীরা। এছাড়া সিলেট-সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকা এখন উজানের ঢলে কুপোকাত। মিনিটে মিনিটে বাড়ছে পানি। জনজীবন বিপর্যস্ত দিশেহারা হয়ে পড়েছে মানুষ। পানিবন্দি পরিবারগুলোর মাঝে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ফলে নগরবাসীর দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে নগরীতে ১৬টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করেছে সিটি কর্পোরেশন। এছাড়াও বন্যা মোকাবিলায় কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন।
গতকাল মঙ্গলবার সুনামগঞ্জ সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। জেলার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা, দোয়ারাবাজার ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলাসহ সকল উপজেলার প্রায় সবকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। একইভাবে প্লাবিত হয়ে পড়েছে ছাতক উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা।
বগুড়া ব্যুরো জানায়, টানা বর্ষণে বগুড়ার নদ-নদীতে বাড়ছে পানি। অসময়ে এই পানি বৃদ্ধিতে বগুড়ার বৃহত্তম যমুনা, বাঙালি ও করতোয়া নদী পাড়ের নিচু জমির ধান ও মৌসুমি ফসল পচে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। উদ্বিগ্ন বোরো চাষিরা রয়েছে গভীর শঙ্কায়। বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ গতকাল জানান, যমুনায় কালিতলা পয়েন্টে পানি ১২.৪৮ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি বলেন, বিপদসীমা ধরা হয় ১৬ দশমিক। সেই হিসেবে আপাতত পানি বিপদ সীমার অনেক নিচে রয়েছে। পরিপূর্ণ বর্ষার আসার আগে পানিবৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে তার অভিমত।
সুনামগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা মো. হাসান চৌধুরী জানান, ভারি বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের সদর দোয়ারাবাজার, ছাতক ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন হাজারো মানুষ। সুনামগঞ্জ শহরের বড়পাড়া, তেঘরিয়া, ওয়েজখালী মল্লিকপুর ও নবীনগরসহ নিম্নাঞ্চলে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ও ছাতকে ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাহাড়ি ঢলে ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার নিচু এলাকার সড়কগুলো ডুবে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রহমান বলেন, ছাতক গোবিন্দগঞ্জ ও আমেরতল সড়কে পানি উঠে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ থেকে সৈয়দ শামীম শিরাজী জানান, যমুনা নদীতে আকস্মিকভাবে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে যমুনা নদী বেষ্টিত নদীকূল এলাকায় ৫টি উপজেলার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের ফসল ডুবে গেছে। এতে কৃষদের যেমন নাভিশ্বাস অবস্থা তেমনি নদী কূলের ভাঙনে ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ৪০ সেমি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে যমুনা নদী ক্রমে ফুলে ফেপে উঠে যৌবন প্রাপ্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে নদী তীরবর্তী কাজীপুর, চৌহালী, শাহজাদপুর, বেলকুচি এলাকায় নদী পাড়ের ভাঙন দেখা দিয়েছে। এদিকে যমুনার পানি বৃদ্ধির কারণে নদী তীরবর্তী সিরাজগঞ্জ সদর, কাজীপুর নাটুয়ারপাড়া, শাহজাদপুরের জামিরতা, চৌহালীর খাসকাওলিয়া, এনায়েতপুর ও বেলকুচির নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের সব ধরণের উঠতি ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
পাবনা জেলা সংবাদদাতা রনি ইমরান জানান, পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্ট গতকাল মঙ্গলবার ৪৭ হাজার ৪৬৮ কিউসেক পানির পরিমাণ করা হয়। তার আগের দিন সোমবার ছিল ৪৭ হাজার ২৮৪ কিউসেক পানি। তবে পানি বৃদ্ধি এই হার তেমন উদ্বেগজনক নয় বলে জানায়, জেলা হাইড্রোলজি বিভাগ। নদ নদীর পানি বৃদ্ধির এই হারে আপতত ফসলের তেমন ক্ষতির প্রভাব পড়বে না বলে জানায় পানি পরিমাপ বিভাগ পাবনা জেলা অফিস।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন