নদী মার্তৃক বাংলাদেশে তিস্তা ও পদ্মা ও নমুনা নদীকে বলা হয় পাগলা নদী। এই তিন নদী আর ব্রক্ষèপুত্র নদ প্রতিবছর ভাঙ্গে। নদী ভাঙ্গনে শত শত গ্রাম বিলীয় হয়ে গেলেও শত শত চর জেগে উঠেছে। এসব চরের বেশির ভাগ এলাকা পলি মাটির চেয়ে বেশি বালু মাটি। বালু মাটিতে ধান-পাট-গম কম হলেও বাদাম ভাল হয়। কিন্তু চরাঞ্চলের কৃষকরা জীবিকার তাগিদে বালু মাটিতেই ভুট্টা চাষ করছে। লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধার তিস্তার চর এবং কুড়িগ্রামের ব্রক্ষèপুত্র নদের চরে ভুট্টা চাষ হচ্ছে। অতীতের বছরগুলোতে চরের জমিতে ভুট্টার ফলন কম হলেও এবার বাম্পর ফলন হয়েছে। বিশেষ করে তিস্তার বিস্তীর্ণ বালুচরে ভুট্টার বাম্পার ফলন হয়েছে। গত বছর কৃষকরা এক একর জমিতে ৯০ থেকে ১১০ মণ ভুট্টা পেয়েছিলেন। এ বছর এক একর জমিতে পাচ্ছেন ১৪০ থেকে ১৭০ মণ ভুট্টা। গত বছরের চেয়ে দামও প্রায় দ্বিগুন হওয়ায় তিস্তার বালুচরে ভুট্টায় বাজিমাত করেছেন কৃষকরা।
রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, গঙ্গাচড়া, কুড়িগ্রামের উলিপুর, ফুলবাড়ি, রাজিবপুর, লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা, পাটগ্রাম উপজেলার চরাঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তারা কয়েক বছর ধরে বাদামের পাশাপাশি ভুট্টা চাষ করছেন। প্রথম দিকে ফলন ভাল না হলেও কয়েক বছর ধরে বেশ ফলন হচ্ছে এবং ধানের চেয়েও বেশি লাভ হচ্ছে। কাউনিয়ার টেপামধুপুর এলাকার কৃষক মো. মকবুল হোসেন জানালেন, ধান চাষে লোকসান। তাই ভুট্টার চাষ করছেন, লাভও পাচ্ছেন।
জানতে চাইলে রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (উদ্যান) শামিমুর রহমান বলেন, তিস্তার চরাঞ্চলে যেমন ভুট্টার চাষাবাদ প্রতি বছর বাড়ছে। এ বছর ফলনও অনেক ভালো হয়েছে। চলতি মৌসুমে জেলায় ১০ হাজার ২৫ হেক্টর জমিতে সব জাতের ভুট্টা চাষ হয়েছে। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ২০৬ মেট্রিক টন। এর মধ্যে পীরগাছা, কাউনিয়া ও গঙ্গাচড়ার তিস্তার চর ও চর বেষ্টিত এলায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে।
রংপুর জেলার কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার একাধিক স্থানীয় সাংবাদিক জানান, তারা গত কয়েকদিন বেশ কয়েকটি চর সরেজমিন ঘুরেছেন। জেলার পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ও তাম্বুলপুর ইউনিয়নের তিস্তার চর ঘুরে দেখেছেন, বালুচরে সবুজ আর সোনালী ফসলে ভরা। ক্ষেতগুলোতে কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত কৃষকরা। কেউ ধান কাটছেন, কেউ ভুট্টা উত্তোলনে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এছাড়াও বালুচরে রয়েছে বাদাম, ডাল, মরিচ, বেগুন, শিম, কপি, পেঁয়াজ, রসুনসহ নানা ফসলের সফল।
পীরগাছা উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে চলতি মৌসুমে প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। যার মধ্যে খরিপ-১ মৌসুমে ১ হাজার ৯৫০ এবং রবি মৌসুমে ২ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ ভুট্টা চাষ করা হয়েছে তিস্তার চরাঞ্চলে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, এবার জেলায় রবি মৌসুমে ১৯ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছিলো। যেখানে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৪৮ হাজার ৪৩৬ মেট্রিক টন। আর চলতি খরিপ মৌসুমে ১০ হাজার ২৫ হেক্টর জমিতে সব জাতের ভুট্টা চাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ২০৬ মেট্রিক টন।
পীরগাছার তিস্তা চরের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিগত বছরে বালুচরে নানা জাতের ভুট্টা চাষ হলেও এ বছর তিস্তা সিড্স কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের নুতন জাত ডালিয়া-৪৪৫৫ ও বাসুধা-১৬৫৫ চাষ বেশি হয়েছে। তিস্তা সিডস কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এই দুই ইউনিয়নে এ প্রায় সাড়ে ৪শ একর জমিতে এ জাতের ভুট্টা চাষ করা হয়েছে।
পীরগাছার কান্দিনার চর গ্রামের ভুট্টা চাষী মো. জামাল মন্ডল, দামুস্বর গ্রামের মো. আব্দুল হক, ময়নুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন জানান, গত বছর স্থানীয় দোকানির কথায় তারা কয়েক জাতের ভুট্টা চাষ করেছিলেন। কিন্তু ফলন ভালো হয়নি। চলতি বছর ডালিয়া-৪৪৫৫ ও বাসুধা-১৬৫৫ জাতের ভুট্টা চাষ করে ভালো ফলন পেয়েছেন। এবার ফলনের সঙ্গে ভালো দাম পেয়ে খুশি তারা।
একই এলাকার কৃষক জিল্লুর রহমান বলেন, গত বছর দেড় একর জমিতে ভুট্টা চাষ করে ৯০ মণ ফলন পেয়েছিলাম। সেই জমিতে এবার ১৪০ মণ ভুট্টার ফলন হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মাড়াই করে আরও ভালো দাম পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর প্রতি মণ (৪০ কেজি) কাঁচা ভুট্টা ৪০০ এবং শুকনা ভুট্টা ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা বিক্রি হয়েছে। সেটি এ বছরে দ্বিগুন দামে বিক্রি হচ্ছে। কাঁচা প্রতি মণ (৪০ কেজি) ৮০০ টাকা এবং শুকনা এক হাজার থেকে ১১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
একই চিত্র কুড়িগ্রাম জেলার থেতরাই, বুড়াবুড়ি, ফাঁসি দেয়া, চিলমারী, লালমনির হাটের তিস্তার চরগুলোতে। পাশের জেলা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ঘগেয়া, তারাপুরের বালুচরেও ব্যপকভাবে ভুট্টার চাষ হচ্ছে। কৃষকরা জানান, ধান চাষে লোকসান দিতে হচ্ছে। অথচ চরের বালু মাটিতে ভুট্টা ও বাদাম চাষ করে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। সরকার ভুট্টার বাজার সৃষ্টি এবং কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ক্রয় করলে চরের কৃষকরা আরো বেশি ভুট্টা চাষে আগ্রহী হবেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন