কাজী নজরুল ইসলাম। আমাদের জাতীয় কবি। বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি, প্রেমের কবি প্রভৃতি নামেও তাঁর পরিচিতি আকাশ ছোঁয়া। তাঁর ব্যক্তি জীবন ও কবি মানসে নারীর ভূমিকা অসামান্য।
নজরুল ইসলাম তাঁর জীবনে বারবার প্রেমে পড়েছেন। যাঁদের প্রেমে পড়েছিলেন, তাঁদেরকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা, গান ও প্রেমপত্র। যেগুলো আজ আমাদের সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবে পরিগণিত।
১৯২১ সালের কোনো একসময় বন্ধু আলী আকবর খানের নিমন্ত্রনে নজরুল এলেন কুমিল্লার দৌলতপুরে। সেখানে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা হলো রূপবতী সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে। কবি প্রেমে পড়ে গেলেন সৈয়দা খাতুনের। সৈয়দা খাতুনও সাড়া দিলেন। তারপর তাঁদের সময় কাটতে লাগলো গান আর সুর নিয়ে। প্রেমিক কবি সৈয়দা খাতুনের নাম রাখলেন নার্গিস। দৌলতপুরে থাকা অবস্থায়ই নার্গিসকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন নজরুল। বিয়েও হলো কিন্তু বাসর রাতেই কবি রহস্যময় কারনে চলে আসেন দৌলতপুর থেকে।
১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে নজরুল বিয়ে করেন প্রমীলা সেন গুপ্তাকে। প্রমীলাকে কবি দোলন ও দুলি নামে ডাকতেন। তাঁদের এ বিয়েতে বাধা হয়ে দাড়ায় ধর্ম। আইনের বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে শেষে নিজনিজ ধর্মীয় পরিচয় বহাল রেখেই তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয়।
১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। নজরুল এসেছেন ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান করতে। সেখানে পরিচয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকোত্তর মোসলমান ছাত্রী ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে। কবি প্রেম জ্বরে আক্রান্ত হলেন। বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে কবি ফজিলাতুন্নেছাকে অনেকগুলো প্রেমপত্র লিখলেন। কিন্তু কোনো সাড়া পাননি কবি। এ প্রেম ছিলো তাঁর একতরফা।
নজরুলের আরেক প্রেমিকার নাম রানু সোম। তিনি নজরুলের গান শিখতেন সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায়ের কাছে। তাঁর কাছেই নজরুল রানু সোম সম্পর্কে জানতে পান। কবি নিজেই ঠিকানা যোগাড় করে রানু সোমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শুরু হয় গান শেখানো। গান শেখানোর অজুহাতে রানুদের বাসায় ছিলো কবির অবাধ যাতায়াত। কিন্তু পাড়ার ছেলেদের তা সহ্য হয়নি। একদিন বাসা থেকে বের হওয়ার পর তারা কবিকে আক্রমণ করে। কবিও পাল্টা আক্রমণ করেন। বিষয়টি থানাপুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। এই রানু সোম পরে বুদ্ধদেব বসুকে বিয়ে করে প্রতিভা বসু নামে খ্যাতি লাভ করেন।
শিল্পী কানন দেবীকে নজরুল গান শেখাতেন। দেরি হয়ে গেলে অনেকদিন রাতে কবি থেকে যেতেন কানন দেবীর বাড়িতে।
ত্রিশালের স্কুল শিক্ষক খিদির পন্ডিত। তাঁর শ্বশুরবাড়ি দরিরামপুর। সেখানে নজরুল খিদির পন্ডিতের সঙ্গে বেড়াতে যেতেন। পন্ডিতের শালিকা নূরজাহানের রূপে মুগ্ধ হয়ে কবি তাঁরও প্রেমে পড়েন।
নজরুলের ব্যক্তি জীবনের মতো তাঁর কবি মানসেও নারী বিশেষ স্থান দখল করে আছে। নারীর প্রেম, নারীর বিরহ নজরুলকে কবি নজরুল হিসেবে গড়ে উঠতে বিশেষ উপাদানের ভূমিকা পালন করেছে। তাইতো কবিকে বলতে শুনি - নারীর মিলনে নর পেলো কবি প্রাণ/ যত কথা তার হইল কবিতা শব্দ হইল গান ।
নজরুলের কবি জীবনে পূর্ণতা আনতে নারী বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। কবি তাঁর বহু কবিতায় তাঁর প্রিয়ার অবদান স্বীকার করেছেন দ্বিধাহীনভাবে। হে মোর রাণী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে। / আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণ তলে এসে। /... আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত-রথের চূড়ে, / বিজয়িনী! নিলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে। ( বিজয়িনী / ছায়ানট)। কবি তাঁর কবি মানসের নৈবেদ্যগুলো অকুণ্ঠচিত্তে সমর্পণ করেছেন তাঁর প্রিয়ার পদতলে। কবি মনে করতেন তাঁর প্রিয় নারীটি না থাকলে তিনি কবি হতে পারতেন না। তাই তাঁকে বলতে শুনি- ... আমার বাণী জয়মাল্য, রাণী! তোমার সবি। / তুমি আমায় ভালোবাসো, তাইতো আমি কবি। / আমার এ রূপ -- সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি। ( কবি-রাণী / দোলনচাঁপা)।
নজরুলকে বলা হয়ে থাকে - সাম্যের কবি। তাঁর নারীবিষয়ক কবিতাগুলোর মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত কবিতাটি হচ্ছে ‹ নারী ‹। তখনকার রক্ষণশীল পুরুষ সমাজে কবিতাটি বেশ আলোচিত হয়েছিলো। নজরুল তাঁর লেখনীতে নারীকে পুরুষের সমমর্যাদার আসন দিতে দ্বিধাহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন সাম্যের বাণী -- সাম্যের গান গাই / আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই। / বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর / অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।/ বিশ্বে যা কিছু এলো পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি / অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।’ (নারী / সাম্যবাদী)।
নজরুল তাঁর ব্যক্তি জীবনে অনেক নারীর সান্নিধ্য পেয়েছেন। কাউকে মাতৃরূপে, কাউকে প্রিয়া, কাউকে মানস প্রতিমা রূপে। তাঁদের স্নেহ-মমতায়, ভালোবাসায় পূর্ণ হয়েছে কবি হৃদয়। তিনি মাতৃস্নেহের জন্য যেমন ব্যাকুল হয়েছেন তেমনি অসহায়, দুস্থ নারীদের জন্য শোকাভিভূত হয়েছেন। তাই তিনি স্পর্ধিত ভাষায় উচ্চারণ করেছেন -- ভগবান! তুমি চাহিতে পার কি ঐ দুটি নারীর পানে?/ জানি না, তোমায় বাঁচাবে কে যদি ওরা অভিশাপ হানে! (সত্য কবি / ফণি মনসা)।
নজরুলের কবিতায় মাতৃভক্তি ও জীবনদর্শন উল্লেখের দাবি রাখে। কবির অটল বিশ্বাস, ্র সর্বসহা কন্যা মোর! সর্বহারা মাতা!/ শূন্য নাহি রহে কভূ মাতা ও বিধাতা!গ্ধ (মা / সর্বহারা)। ৬৫৩
নজরুল অনৈতিকতার দায় শুধু নারীর উপর চাপানোর বিরোধিতা করেছেন চরমভাবে। তিনি মনে করতেন অসতী মায়ের সন্তান জারজ হলে অসৎ পিতার সন্তানও জারজ। তাঁর দৃঢ় উচ্চারণ, শুন ধর্মের চাঁই / জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোনো প্রবেধ নাই! / অসত্য মাতার পুত্র যদি জারজ পুত্র হয়, / অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়।গ্ধ (বারাঙ্গনা)
নারীর যোগ্যতা, দক্ষতা ও মাতৃশক্তির প্রশংসায় নজরুল যেমন ছিলেন পঞ্চমুখ তেমনি ছলনাময়ী নারীর সরূপ উন্মোচনেও পিছপা হননি। তিনি লিখেছেন, নারী নাহি হতে চায় শুধু একা কারো, / এরা দেবী এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো / ইহাদের অতি লোভী মন / একজনে তৃপ্ত নয়, একে পেয়ে সুখী নয় / যাচে বহুজন। (পূজারিনী)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন