কবি নজরুল আমাদের জাতীয় কবি। তিনি যেমন আমাদের দ্রোহের কবি, ঠিক তেমনি প্রেমের কবি। মানব প্রেমে আকৃষ্ট হয়ে নজরুল যেমন লিখেছেন বিদ্রোহী কবিতা ঠিক তেমনি নারী প্রেমে আকৃষ্ট হয়ে লিখেছেন অসংখ্য প্রেমের কবিতা।
তার প্রমাণ মিলে জীবনের শেষ ভাষণে কবি বলেছেন: ‘আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম।’
কবি নজরুলের জীবনে নার্গিস, প্রমীলা, ফজিলাতুুন্নেছাসহ অনেক নারী এসেছেন। সেই প্রেম তাঁকে আবেগে ভাসিয়েছে বারবার নিদারুণভাবে। কবির জীবনে প্রথম নারী প্রেমের সূচনা হয় ১৯২১ সালে কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুর গ্রামের অগ্রজবন্ধুপ্রতিম আলী আকবর খানের বিধবা বোনের কন্যা সৈয়দা খাতুনের সাথে। সময় মার্চ অথবা এপ্রিল নজরুল বিয়ের অনুষ্ঠানে হারমোনিয়াম বাজিয়ে সবাইকে গান শুনিয়েছিলেন। নজরুলের গানের সুর মাতিয়ে দিল সৈয়দা খাতুনকে। আর সৈয়দা খাতুনের রূপ মুগ্ধ করে ফেলল নজরুলকে। প্রথম দর্শনেই কবি প্রেমে পড়ে গেলেন । যদিও বিয়ের প্রথম রাতেই বিছিন্ন হয়ে যায় দু’জনের বন্ধন। কোনো এক অজ্ঞাত শর্তে সবকিছুর আনুষ্ঠানিকতা থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ নজরুল বেঁকে বসলেন। নজরুল গবেষক অনেকের মতে বিবাহকার্য শেষ হয়েছিলো, কারো মতে হয়নি। বিয়ের আসর থেকেই অভিমানি নজরুল উঠে গিয়েছিলেন। বিয়ে হলো অথচ বাসর হলোনা। এরপর কবি নার্গিসের ভালোবাসা উপক্ষো করে চলে এসেছিলেন কুমিল্লায়। নজরুলের জীবনে দ্বিতীয় প্রেমের আবির্ভাব ঘটে ১৯২২ সালের মার্চ মাসে। ওই বছর কলকাতার মোসলেম পাবলিকেশন্স হাউজ থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’। এই বইটির উৎসর্গপত্রে কবি লিখেলেন: ‘মানসী আমার/ মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে/ ক্ষমা করনি/ তাই বুকের কাঁটা দিয়ে/ প্রায়শ্চিত্ত করলুম।’
প্রশ্ন হচ্ছে, কে সেই মানসী? জানা যায় আসানসোলের দারোগার মেয়ে স্বর্ণলতা গঙ্গোপাধ্যায়। অবশ্য এই স্বর্ণলতা সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য উপাত্তের সন্ধান মেলেনি।
১৯২৮ সালে দ্বিতীয়বার ‘মুসলিম সহিত্য সমাজ’ এর দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে কবি ঢাকায় এলেন। কবির সঙ্গে পরিচয় হয় নজরুলের জীবনের মহীয়সী নারী ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে। মাধ্যম ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেনের।
ফজিলাতুন্নেসা মোতাহার হোসেনকে শ্রদ্ধা করতেন বড় ভাইয়ের মতো। কাজী মোতাহার বন্ধুর হয়ে ফজিলাতুন্নেসাকে পৌঁছে দিতেন কবির প্রেমময় চিঠিগুলো। সরাসরি কেন চিঠি পাঠাতেন না, তার কারণও উল্লেখ করেছেন কবি, ‘ঐ এক চিঠি পেয়েই যত দূর বুঝেছি আমায় তিনি দ্বিতীয় চিঠি দিয়ে দয়া করবেন না।’
কবির আকুলতা ও ব্যকুলতার মাধ্যমে প্রেমের প্রকাশ ঘটলেও কঠিন হৃদয়ের নারী ফজিলাতুন্নেছার পক্ষ থেকে কখনও সাড়া মেলেনি । আবেগপ্রবণ কবি নজরুল ফজিলাতুন্নেছাকে নিয়ে একাধিক গান ও কবিতাও লিখেছেন ।
নজরুল গবেষকদের মতে কবি তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলন ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন ফজিলাতুন্নেছাকে। কিন্তু তাতে ফজিলাতুন্নেছা রাজি রাজি ছিলেন না।
১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড পাড়ি জমান ফজিলাতুন্নেছা। সেখানেই শামসুজ্জোহা নামের এক উচ্চশিক্ষিত যুবকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে এবং পরবর্তীতে বিয়ে করেন তাকে। কবি নজরুল আর ফজিলাতুন্নেছা›র প্রেম এক বিরহ কাব্যগাথার রূপ নেয়। কারণ তাদের প্রেম ছিলো একতরফা অর্থাৎ শুধু নজরুল কেন্দ্রিক।
প্রমীলার সঙ্গে নজরুলের প্রথম পরিচয় ঘটেছিল অবশ্য ১৯২১ সালে। ১৯২৪ সালের ২৪ এপ্রিল কবি প্রমীলার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। নার্গিসের বাড়ি থেকে চলে এসে কবি উঠলেন কান্দিপাড়ে একটি হিন্দু বাড়িতে। নতুন করে প্রেমে পড়লেন দুলির সঙ্গে। এই দুলিই হলো দোলনচাঁপা। দোলনচাঁপার প্রেমে পড়ে আড়াল হলো সদ্য নার্গিসের সাথে বিচ্ছেদের বেদনা । দোলনচাঁপাকে নিয়ে কবি লিখলেন:
‘হে মোর রাণী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে
আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণ তলে এসে।’
কবি দোলনচাঁপাকে ভালোবেসে নাম দিলেন প্রমীলা। অবশ্য এই অসম প্রেম সেন গুপ্ত পরিবার মানতে চায়নি। প্রমীলাদেবির মা বিধবা গিরিবালা সেন গুপ্ত পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন কলকাতায়। সেখানে গিয়ে বিয়ে দিলেন নজরুলের সঙ্গে। অবশ্য বিয়েতে বাধা ছিল একটাই, ধর্ম। বিবাহ-আইনের নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে তাঁদের বিয়েটা হয়েছিল স্ব-স্ব ধর্মপরিচয় মেনেই। তখন প্রমীলার বয়স ছিল ১৪ আর নজরুলের ২৩।
কবি নজরুলকে ঘিরে আরো কিছু নারীর সাথে প্রেমের গুঞ্জন শোনা যায়, যাদের মধ্যে অন্যতম রানু সোম, উমা মৈত্র এবং কানন দেবী অন্যতম।
প্রেম নাকি কবিমানসের প্রধান প্রেরণা। প্রেমিক কবি নজরুলের মন তো প্রেমময় হবেই। আর তাই প্রেম নজরুলের জীবনে এসেছিল বারবার—কখনো ঝড়ের মতো, কখনো নিভৃতে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন