গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত ও বসন্ত, বর্ষা এবং হেমন্ত ঋতু এখানে আলাদাভাবে না থাকলেও শীতের বেশীরভাগ সময়টাতে বর্ষা হতে দেখা যায় এবং শীতের আগ মুহূর্তে হেমন্তের কিছু বার্তাও প্রকৃতিতে লক্ষ করা যায়। গ্রীষ্মের বিদায় আর শীতের আগমনের মাঝ দিয়ে শরতের উপস্থিতি প্রকৃতির মাঝে যে পরিবর্তন ঘটায় সেটা সত্যিই খুবই উপভোগ্য। শরতের ভোরে ঘাসের উপর জমে থাকা শিশির বিন্দুতে আবছা সূর্যের আলোর নয়ানিভিরাম দৃশ্য অনেক মনোমুগ্ধকর। এরপর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর সূর্যের আলোর অপ্রতুলতায় জনজীবনে নেমে আসে হিমশীতল ঠাণ্ডা। হরেক রকমের ফুলের ডালি সাজিয়ে প্রকৃতি তখন আবির্ভূত হয় তার নিজস্ব রূপে। বসন্ত এবং গ্রীষ্মের উপস্থিতির বার্তা ভালোভাবে বুঝতে পারা গেলেও প্রকৃতিতে এরা খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী নয় বলেই মনে হয়।
ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে চীনারা উদযাপন করে ভিন্ন ভিন্ন উৎসব। পরিবারের সবার সাথে উৎসবকে আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে পালন করতে চীনা প্রশাসন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শীত, গ্রীষ্মের ছুটিসহ অন্যান্য ছুটি একসাথে ব্যবস্থা করে থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লম্বা ছুটির সাথে তাল মিলিয়ে অন্যান্য সব অফিসে ও বেশ কিছুদিন (কোন কোন ক্ষেত্রে ৮-১০ দিন) একসাথে ছুটির ব্যবস্থা আছে। এক সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ছুটির ব্যবস্থা করার জন্য প্রশাসনের নির্দেশে আগের এবং পরের সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে পুরোদমে অফিস চলে। যাতে করে জনগণ অনেক সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে, যেমনঃ পরিবারের সবাই একসাথে দীর্ঘ সময় ধরে আনন্দঘন সময় কাটাতে পারে সেজন্য ছুটিটাও অনেক উপভোগ্য হয়, সর্বোপরি জনগণের গন্তব্যে পৌঁছাতে পরিবহন সংকটের কোন আশঙ্কা থাকে না। সকল ধর্মীয় উৎসব প্রকাশ্যে পালন নিষিদ্ধ থাকায় ধর্মীয় উৎসবে কোন ছুটিও এখানে নেই। তবে চীনাদের জাতীয় অনুষ্ঠান যেমন: নববর্ষ, লণ্ঠন উৎসব, চিং মিং উৎসব, ড্রাগন বোট উৎসব, মিড অটাম উৎসব, প্রজাতন্ত্র দিবসের মত বিশেষ দিনগুলোকে আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে পালন করার জন্য বেশ কিছুদিন করে ছুটির ব্যবস্থা আছে। এজন্য উক্ত অনুষ্ঠান গুলো খুবই ধুমধাম করে পালন করে চীনারা। পরিবহন টিকিট নিয়ে কোন কালোবাজারি বা জালিয়াতির সুযোগ না থাকায় ছুটির সময়ে সবাই নির্বিঘ্নে তাদের গন্তব্যে যাতায়াত করতে পারে। উপরন্তু জনগণের সুবিধার্থে ছুটির সময়ে ভ্রমণ সংস্থা, পরিবহন কোম্পানি এবং বিমান কোম্পানিগুলো টিকিটের সাধারন মূল্যের উপর বিশেষ ছাড় দিয়ে থাকে। সেজন্য উৎসবের দিনগুলোতে পরিবারের সবার সাথে ছুটি কাটাতে বা দূরে কোথাও ভ্রমণ করতে সব চীনাই অধীর আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করে।
চীনাদের নববর্ষ, লণ্ঠন উৎসব, চিং মিং উৎসব, ড্রাগন বোট উৎসব, মিড অটাম উৎসব, প্রজাতন্ত্র দিবস পালনে আছে অনেক নতুনত্ব, আছে ঐতিহ্যবাহী খাবারের রীতি এবং সর্বোপরি অনুষ্ঠানগুলোর উৎপত্তি নিয়েও নানান তথ্য, যেগুলো অনেকের কাছে অজানা। আজকের আয়োজন চীনাদের তেমনই কিছু উৎসবকে ঘিরে।
চীনা নববর্ষ
শীতের বিদায় এবং বসন্তের শুরুতে চীনাদের নতুন বর্ষ গননা শুরু হয় সেজন্য চীনাদের কাছে এই উৎসবটি Spring Festival বা ‘বসন্ত উৎসব’ নামেও পরিচিত। চন্দ্রমাসের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় দিনটি প্রতিবছর সামান্য এদিক সেদিক হয়ে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পালিত হয়। চীনাদের ঐতিহ্যবাহী বর্ষপঞ্জিতে আকাশে নতুন চাঁদ দেখার মধ্য দিয়ে নববর্ষের শুভ সূচনা হয়। লাল রঙ চীনাদের সৌভাগ্যের প্রতীক বলে প্রতীয়মান। এজন্য চীনাদের যেকোন অনুষ্ঠানের সময় সর্বত্র লাল রঙের আধিক্য দেখা যায়। চীনাদের জাতীয় পতাকার রং থেকে শুরু করে সব ধরনের শুভ কাজ যেমন: বর কনে উভয়েই লাল রঙের পোশাক পরে বিয়ের সাজ সাজে; যেকোন জাতীয় দিবসে লাল রঙের পতাকা, ব্যানার-ফেস্টুনে সমস্ত জায়গা সজ্জিত করা হয়। একমাত্র মৃত ব্যক্তিদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ছাড়া অন্য যেকোন ধরনের অনুষ্ঠানে লাল রঙের উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়। এমনকি চীনাদের যেকোন অফিসিয়াল স্ট্যাম্পসহ সিল-ছপ্পরের কালি ও লাল রঙের হয়ে থাকে। সেজন্য চীনা নববর্ষেও লাল রঙের আধিক্য দেখা যায়। নতুন বছরের প্রথম দিনে সকল অশুভ শক্তিকে দূরে ফেলে শান্তি ও সমৃদ্ধির আশায় র্যালির আয়োজন করে চীনারা। নববর্ষে অনেক বড় বড় ড্রাগন এবং লাল রঙের অনেক কারুকার্য বানিয়ে সেগুলোকে নিয়ে নতুন বছরের শুরুতে আনন্দ র্যালি বের করতে দেখা যায় চীনাদের। আমাদের দেশের মুসলিমদের ঈদের সালামি এবং হিন্দুদের দুর্গা পূজায় প্রনামী দেওয়ার মত চীনা নববর্ষে ও ঠিক তেমনই একটা রীতির প্রচলন আছে। এই দিনে লাল রঙের খামে বা প্যাকেটে করে প্রিয়জন, নিজেদের ছেলেমেয়েসহ পরিবারের অনেকেই অর্থ সহ অন্যান্য উপহার দেওয়া হয়। বাদ যায়না শিক্ষকদের নিকট থেকে ছাত্রছাত্রীদের প্রাপ্তিও।
নববর্ষের আগের দিনের সন্ধ্যায় সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হচ্ছে বার্ষিক পুনর্মিলনী নৈশভোজ। হরেক রকমের ঐতিহ্যবাহী খাবারের মেন্যুর উপস্থিতির মধ্যে নৈশভোজের উল্লেখযোগ্য মেন্যু থাকে নুডুলস, ফল, ডাম্পলিং, স্প্রিংরোল, এবং ‘থাংগুয়ান’ (Tangyuan) নামে হালকা মিষ্টি স্বাদ যুক্ত চালের গুড়ো (আঠালো চাল) দিয়ে তৈরি বল। ‘থাংগুয়ান’ গুলো তৈরির পরে জলে সিদ্ধ করে জলের ভিতর রেখেই পরিবেশন করা হয় যেগুলোকে আমরা বাঙালীরা প্রায়শই রসোগোল্লা ভেবে ভুল করি। চীনা জনগণ বিশ্বাস করে গোলাকৃতি বল জাতীয় খাবার পারিবারিক সম্প্রীতির প্রতীক আর সেজন্যই নতুন বছর বা অন্যান্য উৎসবে তাঁদের পারিবারিক সম্প্রীতি, সুখ এবং সৌভাগ্য বয়ে আনবে এটা ভেবে ‘থাঙ্গুয়ান’ খেয়ে থাকে।
আধুনিকতার সাথে তাল মেলাতে নববর্ষের আগের রাত্রে অনেক পরিবার পার্টির আয়োজন করে এবং নতুন বছরের কাউন্টডাউন শুরু করে, আতশবাজি পুড়িয়ে নতুন বছর কে স্বাগত জানায়। যেকোন অশুভ শক্তিকে ভয় দেখানো এবং মনে আনন্দের খোরাক জোগাতে চীনারা প্রতিটি অনুষ্ঠানে প্রচুর আতশবাজি পুড়িয়ে থাকে। পরিবারের কারো মৃত্যুর সংবাদের সাথে সাথে সে স্থানকে অশুভ শক্তির হাতছানি থেকে রক্ষা পেতে এবং পুরো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া জুড়ে থাকে পটকা, আতশবাজির মুহুর্মুহু আওয়াজ। আতশবাজি যে শুধুমাত্র রাতের অন্ধকারে পোড়াতে হয় এমনটা এরা মনে করেনা সেজন্য ভরা সূর্যের আলোর উপস্থিতিতেও আতশবাজির অবিরাম মহড়া চলে। তাই নববর্ষের শুরুর আগ থেকে প্রায় মাস খানিক সময় জুড়ে চলে এই আতশ বাজির উৎসব।
নৈশভোজের পরে কিছু কিছু চীনাকে নতুন বছর শুরু হওয়ার আগে স্থানীয় বৌদ্ধ মন্দিরে বছরের প্রথম প্রহরে ধূপ (আগর বাতি) প্রজ্বলিত করে সুখি-সমৃদ্ধ নতুন বছরের জন্য প্রার্থনা করতে দেখা যায়। কিছু কিছু অঞ্চলে পারিবারিক ঐতিহ্যগতভাবে পালন করা হয় নানা রকমের নিয়ম নীতি যেমন: সন্ধ্যার শুরুতেই বাড়ীর প্রধান ফটক বন্ধ করে দেয়া হয় এবং সকাল হওয়ার আগ পর্যন্ত সেটাকে আর খোলা হয়না। নতুন বছরের সকালের শুরুতেই অনেক জাঁকজমকভাবে আতশবাজি পুড়িয়ে তবে সেই দরজা খোলা হয় যেটাকে তাঁরা মনে করে এই দরজা খোলার ভিতর দিয়ে তাঁদের ভাগ্যের দরজা খোলা হচ্ছে।
চীনা নববর্ষের উৎপত্তি সম্পর্কে জনগণের যে ধারনাটি প্রধান সেটা হলো: হাজার হাজার বছর আগে ‘নিয়ান’ (চীনা ভাষায় ‘নিয়ান’ অর্থ বছর) নামের একটি দৈত্য প্রতি বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে গ্রামবাসীদের উপর হামলা করত। উচ্চ শব্দ, উজ্জ্বল আলো, লাল রঙ দেখে দৈত্যটি ভয় পেত এবং গ্রামবাসী ঐ জিনিসগুলো ব্যবহার করে দৈত্যটিকে তাড়া করে আবার জঙ্গলে দিয়ে আসত। একরকম সেখান থেকেই পুরাতন বছরের সুখ-দুঃখকে বিদায় জানাতে এবং নতুন বর্ষে সবার জন্য সুখ এবং সমৃদ্ধি বয়ে আনবে এই প্রত্যশায় আতশবাজি পুড়িয়ে এবং লাল রঙের সাজসজ্জা ব্যবহার করে ধুমধাম করে নববর্ষ উদযাপন করা হয়।
জ্যোতিষশাস্ত্রের রাশি নির্ধারণের মত চীনাদের প্রতিটা বর্ষকে ১২টি প্রাণীর নামে নামকরণ করা হয়। ক্রমানুসারে প্রাণীগুলো (ইঁদুর, ষাঁড়, বাঘ, খরগোশ, ড্রাগন, সাপ, ঘোড়া, ছাগল, বানর, মোরগ, কুকুর, এবং শূকর) প্রতিটি বছরের জন্য একের পর চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে। ধারণা করা হয়, বহুকাল আগে জেড সম্রাট তাঁর প্রহরীর জন্য উক্ত ১২ টি প্রাণী নির্বাচন করেছিল। পৃথিবী থেকে যে প্রাণীগুলো যত দ্রুত মানুষের বার্তাকে স্বর্গের দরজায় নিতে পারবে সেই প্রাণীগুলোকেই তিনি বাছাই করে নির্দিষ্ট পদমর্যাদায় ভূষিত করেছিলেন। সম্রাটের ঘোষণার পরে অনেক প্রাণী স্বর্গীয় ফটকের দিকে রওনা হয়। এদের মধ্যে ইঁদুর খুব ভোরে উঠে স্বর্গীয় দরজার দিকে যাওয়ার পথে একটি নদীর মুখোমুখি হয়। অনেক চেষ্টার পরেও নদীতে তীব্র স্রোতের কারণে ইঁদুর নদী পার হতে পারিনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর ইঁদুর লক্ষ করল ষাঁড় নদী পার হতে যাচ্ছে এবং তখনই সে দ্রুত লাফিয়ে গিয়ে ষাঁড়ের কানের উপর চড়ে নদী পার হল। পরিশ্রমী ষাঁড় বুঝতে পেরেও কিছু মনে করল না। নদী পার হওয়ার পর ষাঁড় জেড সম্রাটের প্রাসাদের দিকে গেলে হঠাৎ চালাক ইঁদুর ষাঁড়ের কানের উপর থেকে লাফ দিয়ে সম্রাটের পায়ে গিয়ে পড়লো। সম্রাট ইঁদুরের প্রখর বুদ্ধি দেখে ইঁদুরকে প্রথম এবং ষাঁড়কে দ্বিতীয় ঘোষণা করেন। এরপর এক এক করে পৌছাল বাঘ, খরগোশ, ড্রাগন, সাপ, ঘোড়া, ছাগল, বানর, মোরগ, কুকুর এবং শূকর। চীনাদের জন্ম রাশিও এই প্রাণীগুলোর উপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয়। সে অনুযায়ী এক একজন ব্যক্তির জন্মের ১২, ২৪, ৩৬, ৩৮ ... বছর পরপর তাঁদের শুভ বছরগুলো ফিরে আসে এবং নিজেদের রাশির সাথে ওই বছরের রাশি মিলে যায় বলে ওই বছরকে তাঁদের ভাগ্যবান বছর হিসেবে মনে করে।
লণ্ঠন উৎসব
Lantern festival বা লণ্ঠন উৎসব বা বসন্ত উৎসব নববর্ষের ঠিক ১৫ দিনের মাথায় পালিত হয় অর্থাৎ চীনা ক্যালেন্ডারে প্রথম মাসের পঞ্চদশ দিনে উদযাপিত হয়। সাধারণত ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই অনুষ্ঠান হতে দেখা যায়। এই অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে ঐতিহ্যবাহী চীনা নববর্ষ উদযাপনের আনন্দঘন পরিবেশের সকল আয়োজন শেষ হয়। প্রাচীনকালে শুধুমাত্র লণ্ঠন প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে এই উৎসবের আয়োজন সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে আধুনিকতার ছোয়ায় লণ্ঠনগুলো সব সুন্দর সুন্দর নকশার সাথে নজরকাড়া বিভিন্ন প্রাণীর আকার বা ভাস্কর্যের আকারে অলংকৃত করা হয়। লণ্ঠনগুলো সবই লাল রঙের হয়ে থাকে। অনুষ্ঠানের বেশ আগে থেকেই সমস্ত রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে অলিগলি পর্যন্ত সব জায়গাতে লন্ঠনের কিছু আধুনিক আলোক সজ্জা দেখা যায়। রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্প পোস্ট এবং সুউচ্চ গাছগুলোর ডালপালার ফাঁকে ফাঁকে রাখা হয় বিভিন্ন আলোক সজ্জার আদলে তৈরি বৈদ্যুতিক লন্ঠন। সন্ধ্যার পরে রাস্তা দিয়ে অবিরাম গতিতে ছুটে চলা গণপরিবহন, ব্যক্তিগত গাড়ি বা মটর বাইকে বসে সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য সত্যিই খুবই উপভোগ্য।
লণ্ঠন অনুষ্ঠানের ঐতিহ্যবাহী অন্যান্য খাবারের সাথে প্রায় একই রকমের ‘থাঙ্গুয়ান’ এবং ‘ইউয়ানসিয়াও’ (Yuanxiao) নামে চালের গুড়ো দিয়ে তৈরি স্বাদে অল্প মিষ্টি ছোট ছোট বল জাতীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার খেতে দেখা যায় চীনাদের। বিভিন্ন জাতীয় সবজি, তিল, বাদাম দিয়ে এগুলোর ভিতরে পুর ভরা থাকে।
লণ্ঠন উৎসবের উৎপত্তি সম্পর্কে বেশ কিছু ধারনার প্রবর্তন থাকলেও সর্বজনগৃহীত ধারনাটি এরকম: ২০০০ বছর আগে যখন চীনে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার লাভ করছিল তখন হান সম্রাট মিং লণ্ঠন উৎসবের প্রবর্তন করেছিলেন। সম্রাট মিং বৌদ্ধধর্মের একজন প্রবক্তা ছিলেন এবং তিনি লক্ষ্য করেন যে, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা প্রথম চন্দ্রমাসের পঞ্চদশ দিনে মন্দিরে লণ্ঠন জ্বালান। পরবর্তীতে সম্রাট মিং সকল পরিবার, মন্দির ও রাজপ্রাসাদকে ওইদিনে লণ্ঠন জ্বালানোর আদেশ দেন। সেখান থেকে এটি একটি রীতিতে পরিণত হয়ে বর্তমানে উৎসবে রূপ নিয়েছে। অনেকে মনে করেন শীতের তীব্রতা থেকে উষ্ণতার আগমনকে স্বাগত জানাতে এই লণ্ঠন প্রজ্বলন তথা Lantern festival পালন করা হয়।
চিং মিং উৎসব
Tomb sweeping da তথা চিং মিং উৎসব বা সমাধি দিবস একটি ঐতিহ্যবাহী চীনা উৎসব। সাধারণত এটি ইংরেজি মাসে ৪, ৫ বা ৬ এপ্রিল পালিত হয়। চিং মিং উৎসবের দিনে চীনারা তাঁদের পূর্বপুরুষদের সমাধি পরিদর্শন করেন এবং এ সময়ে তাঁরা সমাধিস্থল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফুল দিয়ে সুসজ্জিত করার পাশাপাশি মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে ঐতিহ্যবাহী খাবার। সমাধিতে আগরবাতি জ্বালিয়ে এবং জজ পেপার (একধরনের কাগজ যেটা ধর্মীয় কাজে পোড়ানো হয়) পুড়িয়ে মৃতব্যক্তির বিদেহী আত্মার জন্য প্রার্থনা করতে দেখা যায়। চীনাদের বেশীরভাগ সমাধিস্থল সুউচ্চ পাহাড়ের উপর অবস্থিত হয়ে থাকে। চিং মিং উৎসবের সময় ছাড়াও সেগুলোকে সর্বদা পরিচর্যা করে দেখভাল করে রাখার জন্য নিয়োজিত আছে বহু মানুষ। যেকেউ যেকোন সময় সেখানে হাজির হয়ে উপভোগ করতে পারে বৌদ্ধদের সুসজ্জিত বিভিন্ন মন্দিরসহ নজর কাড়া সব সৌন্দর্য।
চিংমিং উৎসবের অন্যান্য সব দৈনন্দিন খাবারের সাথে উল্লেখযোগ্য কিছু খাবার হচ্ছে, চালের গুড়ো দিয়ে বানানো সবুজ রঙের সামান্য মিষ্টি স্বাদের রাইচ বল, শামুক, ডিম ইত্যাদি।
এই উৎসবের উৎপত্তি Cold food festival বা হানশি উৎসব থেকে। প্রাচীন জিন রাজ্যের একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি জিয়ে যিথুইকে স্মরণ করে চিং মিং উৎসব পালিত হয়। ধারনা করা হয় ৬৫৫ খ্রিস্টাব্দে জিন রাজ্যের রাজকুমার ছোঙ্গার যখন অনাহারে মারা যাচ্ছিলেন, তখন জিয়ে যিথুই গোপনে তার উরু থেকে মাংস কেটে সেটার স্যুপ রান্না করে রাজকুমারকে খেতে দিয়েছিলেন এবং রাজকুমার সেই স্যুপ খেয়ে প্রাণে বেঁচে যান। পরে রাজকুমার জিয়ে’র কাছে জানতে চান তিনি স্যুপ কোথায় পেয়েছিলেন। জিয়ে যিথুইয়ের কাছে রাজকুমার তাঁর এই ত্যাগের কথা শুনে খুবই বিস্মিত হন এবং জিয়ে যিথুইকে পুরস্কৃত করার প্রতিশ্রুতি দেন। ঊনিশ বছর পর রাজকুমার ছোঙ্গার জিন রাজ্যে ফিরে রাজ্যের প্রধান হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং তাঁর সকল অনুসারীদের পুরস্কৃত ও সম্মানিত করেন কিন্তু জিয়ে যিথুই এর কথা ভুলে যান। অন্যরা যখন রাজকুমারকে জিয়ে যিথুইয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেন তখন তিনি নিজের ভুলের জন্য লজ্জিত হন। এই ঘটনার পরে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে জিয়ে যিথুইয়ের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু জিয়ে যিথুই রাজকুমারের আসার সংবাদ শুনে তাঁর বৃদ্ধ মা-কে নিয়ে কাছাকাছি একটি পাহাড়ে লুকিয়ে পড়েন।
পরে রাজকুমার জিয়েকে উপযুক্ত সম্মানে ভূষিত করার জন্য পাইক পেয়াদা পাঠিয়ে রাজপ্রাসাদে দেখা করতে বলেন। কিন্তু জিয়ে যিথুই সেই সম্মান নিতে রাজি ছিলেন না। কেননা জিয়ে যিথুই নিজেকে খুবই সাধারন ভাবতেন। এরপর জিয়ে যিথুইকে লুকানো পাহাড়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কেউ তাকে খুঁজে পায়নি। জিয়ে যিথুই পাহাড় থেকে বের হয়ে আসবেন তেমনটায় ভেবে রাজকুমারের নির্দেশে পাহাড়ে অগ্নি সংযোগ করা হয়। তিন দিন তিন রাত পরে পাইক পেয়াদারা অনেক খোঁজাখুঁজির পরে পাহাড়ের উপরে উইলো গাছের নিচে একটি গুহায় জিয়ে যিথুই এবং তার মায়ের দুটি মৃতদেহ দেখতে পায়। জিয়ে যিথুই কখনো খ্যাতি বা অর্থের প্রতি লোভ করেননি এজন্য তাঁদের মৃত্যুতে রাজকুমার অনেক শোক করেন। আগুনে পুড়ে জিয়ে যিথুই এবং তাঁর মায়ের মৃত্যু হওয়ায় তাঁদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান দেখাতে রাজকুমার ওইদিন প্রজাদের আগুন না জ্বালিয়ে এবং ঠান্ডা খাবার খেয়ে থাকার জন্য নির্দেশ দেন। পরের বছর একই দিনে রাজকুমার জিয়ে যিথুয়ের এর আত্মত্যাগের স্মরণে তাঁদের সমাধিস্থান (জিয়ে যিথুই এবং তাঁর মায়ের) পরিদর্শনকালে দেখতে পান পুড়ে যাওয়া উইলো গাছ গুলো নতুন ডালপালা আর পাতায় পুনঃজ্জীবিত হয়েছে। রাজ কুমার সগর্বে জিয়ে যিথুইয়ের মহৎ চরিত্রের কথা স্মরণ করেন এবং ওই দিনটাকে Cold food festival ঘোষণা করেন যা পরবর্তীতে চিং মিং উৎসবে রূপ নেয়।
চিং মিং উৎসবের আগের দিন চীনারা ঠান্ডা খাবার খেয়ে Cold food festival পালন করত যেটা কালের বিবর্তনে বর্তমানে চিং মিং উৎসবের অংশ হিসেবে পালন করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এখনো কিছু অঞ্চলে চিং মিং উৎসবে ঠান্ডা খাবার খাওয়ার প্রথা চালু আছে।
ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল
চীনা দিনপঞ্জির পঞ্চম মাসের ৫ তারিখে Dragon Boat Festival উদযাপিত হয়। ড্রাগন কে চীনারা সর্বাপেক্ষা প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে মনে করে। কালের বিবর্তনে প্রকৃত সত্য উদঘাটন কঠিন হলেও চীনারা মনে করে তাঁদের পূর্বপুরুষরা নিজেদের ড্রাগনের বংশধর হিসাবে দেখত। সেজন্য আজও তারা ড্রাগনকে শক্তির উৎস হিসেবে মানে এবং প্রতীকটির সাথে দৃঢ় সংযোগ অনুভব করার পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ড্রাগনের প্রতীক ব্যবহার করে। তারই ধারাবাহিকতায় ড্রাগনের আদলে নৌকা তৈরি করে সেগুলো সুসজ্জিত করে প্রতিযোগিতায় নামানো হয় এই উৎসবে। মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার আগে সুদক্ষ মাঝি মল্লাদের উপস্থিতিতে মাস খানেকের বেশি সময় ধরে চলে প্রতিযোগিতার মহড়া। প্রতিটি নৌকায় একজন দলনেতার ঘন্টার বা ঢোলের ছন্দময় শব্দের তালে অন্যদের বৈঠা ফেলায় তীব্র গতিতে ছুটে চলে ড্রাগন সদৃশ নৌকাগুলো।
এই বিশেষ অনুষ্ঠানের সময় সব চীনারা বাঁশের পাতায় মোড়ানো ত্রিভুজাকৃতি বা আয়তাকার ‘জংজি’ (Zongzi) খেয়ে থাকে যেটা তৈরি করা হয় আঠালো ভাতের ভিতরে বিভিন্ন সবজি, মাংস, পুষ্টিকর বীজ, বাদাম ইত্যাদি ব্যবহার করে। জংজির সাথে ওয়াইন পান করতেও দেখা যায়। চীনারা মনে করে ওয়াইন পান করলে সকল রোগ এবং অশুভ শক্তি দূরে সরে যায়। এই চিন্তাধারা থেকে চীনারা প্রায় প্রতিটা উৎসবে ওয়াইন পান করে।
প্রায় ২০০০ বছরের প্রাচীন হৃদয়বিদারক স্মৃতি বিজড়িত কাহিনী আছে এই উৎসবকে ঘিরে। চীনে সর্বাধিক পরিচিত ঝাউ রাজবংশের চু রাজ্যের কবি ও মন্ত্রী চু ইউয়ানের মৃত্যুকে স্মরণ করে পালিত হয় ড্রাগন বোট উৎসব। মন্ত্রী চু ইউয়ান ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক কবি। যখন ঝাউ রাজা শক্তিশালী সিন রাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন বিরোধিতা করার জন্য চু-কে বহিষ্কার করা হয় এবং এমনকি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে নির্বাসন দেওয়া হয়। নির্বাসনের সময় চু ইউয়ান প্রচুর কবিতা লিখে জনগণের মন জয় করেছিলেন। আঠাশ বছর পরে সিন, চু রাজ্যের রাজধানী ইং দখল করে নেন। তখন হতাশ হয়ে চু ইউয়ান মিলুও নদীতে ডুবে আত্মহত্যা করেন। স্থানীয় লোকজন চু ইউয়ানকে অধিকতর ভালবাসতেন। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর খবরে সাবার মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। তখন সবাই নৌকায় করে তাকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও যখন তার দেহ পাওয়া যায়নি তখন তাঁর ভক্তরা আঠালো ভাতের বল নদীতে ফেলে দেয়, যাতে মাছেরা চু ইউয়ানের শরীরের বদলে সেগুলো খেতে পারে। বলা হয়ে থাকে সেখান থেকেই ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালের উৎপত্তি এবং এই অনুষ্ঠানে চীনারা আঠালো ভাত দিয়ে জংজি বানিয়ে খেতে দেখা যায়।
শরৎকালীন উৎসব
শরতের মাঝামাঝি সময়ে এটি পালিত হওয়ায় এর নাম মিড অটাম (Mid-Autumn) রাখা হয়েছে। এই অনুষ্ঠানটিও তিথি নক্ষত্রের উপর নির্ভরশীল এবং ঐতিহ্যগতভাবে চীনা চন্দ্র ক্যালেন্ডারে অষ্টম মাসের ১৫ তম দিনে পড়ে যা প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে অক্টবরের প্রথম সপ্তাহের ভিতর ভরা পূর্ণিমা রাতে যখন আকাশে গোল থালার মত ঝকঝকে চাঁদ দেখতে পাওয়া যায় সেদিনই মিড অটাম ফেস্টিভ্যালের মূল অনুষ্ঠানটা পালিত হয়। আকাশে ফানুস উড়িয়ে বা জলে কাগজের বক্সে লণ্ঠন সদৃশ আলো ভাসিয়ে দিয়ে মিড অটাম উৎসব উদযাপন করা হয়।
‘মুনকেক’ এই অনুষ্ঠানের জনপ্রিয় খাবার। চাঁদের উপর নির্ভর করেই মিড অটাম ফেস্টিভ্যাল পালিত হওয়ায় লাল শিম বা পদ্মবীজের পেস্টের সাথে মাঝখানে সল্টেড (লবণের ভিতর সিদ্ধকরা) হাঁসের ডিম মিশিয়ে তৈরি করা হয় বিশেষ এই মুনকেক। চীনারা বিশ্বাস করে এই মুনকেক আগামীর দিনগুলোতে তাদের জীবনে অনেক সুখ-সমৃদ্ধি এবং শান্তির বার্তা বয়ে আনবে। সে উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যবসায়িক মহলে বা পরিবার পরিজনদের মধ্যে এই মুনকেক উপহার হিসেবে প্রদান করে।
প্রায় ৩০০০ বছর পূর্বে ঝাউ রাজবংশের সময় চাঁদের উপাসনা থেকে এই অনুষ্ঠানের উৎপত্তি বলে ধারনা করা হয়। প্রাচীন চীনে বেশির ভাগ সম্রাট বাৎসরিকভাবে চাঁদের উপাসনা করতেন এবং পরবর্তীতে এই রীতিটি জনসাধারণের দ্বারা গৃহীত হয়ে কালের বিবর্তনে আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
পহেলা অক্টোবর চীনাদের ‘স্বাধীনতা দিবস’ তথা ‘প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দিবস’ উদযাপিত হয়। সে উপলক্ষে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহটি চীনাদের কাছে এড়ষফবহ বিবশ বা স্বর্ণ সপ্তাহ হিসেবে বিবেচিত হয়। গরফ-ধঁঃঁসহ ঋবংঃরাধষ এর সাথে ‘প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দিবস’ মিলিয়ে আট দিন ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। সেজন্য ছুটিটা ও জাঁকজমক পূর্ণ হয়। স্বাধীনতা দিবসসহ এই অনুষ্ঠান কে ঘিরে প্রতিটা রাস্তা, অলিগলি, কমিউনিটি, পার্ক, সুপারমল সবখানেই লাল রঙের বিশেষ সজ্জায় সজ্জিত হতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা হিন্দুদের হলি উৎসবের মত আবীর সহ বিভিন্ন রঙ নিয়ে তাদের সহপাঠীদের সাথে আনন্দে মেতে ওঠে। এ সময়েও সবাই ব্যাস্ত থাকে ভ্রমণে। তাই ছুটি শুরু হলেই সবাই তাঁদের পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে রওনা হয়।
লেখক: গবেষক, ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি, ফুজিয়ান, চীন।
ajoymondal325@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন