বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইনকিলাব বর্ষ শুরু সংখ্যা

স্বাধীনতা : আমাদের প্রত্যাশা

ড. আবদুল আলীম তালুকদার | প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০২২, ১২:০৩ এএম

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে একটি অনুকরণীয় রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত। পশ্চিমা মোড়লদের দম্ভোক্তি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র অপবাদ ঘুচিয়ে সমৃদ্ধির পথে ধাবমান এ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রটির স্বাধীনতা অর্জন ছিল হাজার বছরের সংগ্রামের ফসল। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ বেনিয়ারা এদেশকে শাসনের নামে শোষণ, নির্যাতন আর বঞ্চনা উপহার দিয়ে প্রায় দু’শো বছর তাদের গোলাম করে রেখেছিল। এদেশের মানুষ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে পদানত করে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে পাকিস্তান। বাংলাদেশ তখন ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে অখণ্ড পাকিস্তানের একটি প্রদেশের মর্যাদা পায়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এদেশকে শোষণ-নির্যাতনের কেন্দ্রস্থল করে দীর্ঘ চব্বিশ বছর তাদের করায়ত্তে রাখে। ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে রয়েছে বিপুল আত্মত্যাগ ও শোষণ নির্যাতনের দীর্ঘ ইতিহাস। সেই ইতিহাসের এক গৌরবময় মাইলফলক মহান ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে বাঙালির ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। অবশেষে ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই পুর্ববাংলার রাজনীতির মোড় ঘুরে যায় স্বাধিকার আন্দোলনের দিকে। পাকিস্তানি শাসকদের হাতে নির্যাতিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৩ সালে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ববাংলার আইন পরিষদের ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন লাভ করে। এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করে পূর্ববাংলায়; শুরু হয় ষড়যন্ত্র। বাঙালি অবাঙালি দাঙ্গা বাঁধিয়ে যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক সরকার বাতিল করা হয়। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ১৯৫৮ সালের ৩০ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের আসন দখল করেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। ১৯৬১ সালের শেষের দিকে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন। ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামী করে আরো ৩৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ এনে পাকিস্তান সরকার ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করে। এর বিরুদ্ধে মাওলানা ভাসানী গণ-আন্দোলনের ডাক দেন। ১৯৬৯ সালে ছাত্র সমাজের ১১ দফা কর্মসূচী ঘোষণার পর গণ-আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ লাভ করে। শেষ পর্যন্ত গণ জোয়ারের চাপে আইয়ুব খান ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ মামলার সকল আসামীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। ১৯৬৯ সালে এক বিশাল জনসমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। আইয়ুব খানের পদত্যাগের পর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে পাক-সরকার গোপনে ষড়যন্ত্র শুরু করলে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসমাবেশে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে তিনি ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ২৫ মার্চ গভীর রাতে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা শুরু হয় বাংলার বুকে। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা কখনোই সহজলভ্য নয়। কেউ কাউকে স্বাধীনতা দেয় না, তাকে ছিনিয়ে নিতে হয়। আমাদের বাঙালিদের জন্যও এই স্বাধীনতা অর্জন ছিল অত্যন্ত কঠিন। ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে শুরু হয় স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় (বর্তমানে মুজিবনগর) গঠিত হয় স্বাধীন বাংলার সরকার। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে জননেতা তাজউদ্দিন আহাম্মদের নেতৃত্বে জেনারেল আতাউল গণি ওসমানির পরিচালনায় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। মেজর জিয়াউর রহমান, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কে এম শফিউল্লাহ্, মেজর আব্দুল জলিল, কর্ণেল আবু তাহের, মেজর রফিকুল ইসলাম, বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীর সামরিক নেতৃত্বে লাখ লাখ বাঙালির দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর লখো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

স্বাধীনতা মানে শুধু রাজনৈতিক পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হওয়া নয়। নতুন মানচিত্র ও জাতীয় পতাকার গৌরবেও সেই স্বাধীনতা সীমিত থাকে না। স্বাধীনতা মানে ইচ্ছার স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, মুক্তমত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অবশ্যই উন্নত ও সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক পরিবেশে শ্রেণি-পেশা-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের নিরাপদে বসবাস করার নিশ্চিত অধিকার। একাত্তরের অশেষ আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছি সত্য, কিন্তু আজও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে সক্ষম হতে পারিনি। স্বাধীনতার অর্ধ-শতাব্দীকাল পর হলেও বাংলাদেশ বর্তমানে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছে। অর্থনীতির সম্ভাবনাও বেড়েছে বিপুলভাবে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ইত্যাদি ক্ষেত্রে দেশের প্রভূত উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু স্বাধীনতার এই ৫১ বছরে এখনো আমাদের মানবিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটেনি। দেশ থেকে এখনো উচ্ছেদ করা যায়নি দুর্নীতি ও সন্ত্রাস। সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়নি। রয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। আমাদের সমাজে নারীরা আজো অবহেলিত, অরক্ষিত, নিষ্পেষিত, নির্যাতিত। রোধ করা যায়নি সমাজের নৈতিক স্খলন। সমাজে আজও শিশু ও নারী নির্যাতন-সম্ভ্রমহানি ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। এ প্রবণতা একটি স্বাধীন সার্বভৌম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে কখনো কাম্য হতে পারে না। স্বাধীনতার এতো বছর পরেও সমাজের নৈতিক স্খলনের কেনো এতো অধঃপতন তার কারণ আগে বের করা এখন সময়ের দাবি। দেশের ভাবমূর্তি-উন্নয়ন-সমৃদ্ধির স্বার্থেই এসব অপকর্ম-অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সরকার তথা সমাজের সর্বস্তরের জাগ্রত মানুষেরই কঠোর অবস্থান নেয়া প্রয়োজন।

স্বাধীনতা এ বিশ্বের প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠীর, সম্প্রদায়ের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। স্বাধীনতা মানে কৃষক, শ্রমিক, মজুর, ছাত্র-জনতা তথা আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা তথা সবার স্বাধীনতা। মনে রাখা প্রয়োজন, স্বাধীনতা লাভ করা যতটা কঠিন, তাকে রক্ষা করা তার চেয়ে কম কঠিন নয়। মানুষের পরিপূর্ণ অর্থনৈতিক মুক্তি ও দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমেই স্বাধীনতা অর্থবহ হতে পারে। স্বাধীনতা দিবস তাই আমাদের অন্ধকার জীবনে আলোর দিশা, দুঃখের অমানিশায় সুখের সূর্যোদয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল বাঙালি জাতির অস্তিত্বের সংগ্রাম। এ সংগ্রাম বাংলাদেশের মানুষকে সীমাহীন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীনতার মর্যাদাকে রক্ষার জন্যে আজ আমাদের সকলকে আত্মত্যাগের মনোভাব নিয়ে দেশ গড়ার সংগ্রামে নিয়োজিত হতে হবে।

লেখক: কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও সহকারী অধ্যাপক, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন