শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ভাঙন নিয়ে শঙ্কিত নদীপাড়ের মানুষ

উত্তরাঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের করুণ অবস্থা

সিরাজগঞ্জ থেকে সৈয়দ শামীম শিরাজী | প্রকাশের সময় : ৮ জুন, ২০২২, ১২:০০ এএম

বন্যার পানির সঙ্গে রীতিমতো লড়াই সংগ্রাম করছে উত্তরাঞ্চলের নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষ। বুকে কাঁপন ধরিয়ে এখন বানের পানি ধীরে ধীরে ফুলে-ফেঁপে উঠছে, ধীরে ধীরে পানি বিপদসীমার দিকে যাচ্ছে নদীর পানি। বন্যার ভীতিকর রূপ শঙ্কার মেঘ জমেছে উত্তরাঞ্চলর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের জেলাগুলোতে। বরাবরই উত্তর জনপদ বন্যাপ্রবণ। তার ওপর অতিবৃষ্টির মধ্যে ভারত হঠাৎ করে খুলে দিচ্ছে ফারাক্কাসহ অন্যান্য বাঁধের সøুইসগেটের দরজা। সম্প্রতি দেশটির গজলডোবা পয়েন্টে বাঁধের সøুইসগেট খুলে দিলে বেড়ে যায় যমুনার পানি। ফলে উত্তরাঞ্চলের প্রান্তরে এখন বন্যার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। পাবনার বেড়াকোলা থেকে রংপুরের কাউনিয়া পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের নাজুক অবস্থা। এটি ভাঙনের ঝুঁকি রয়েছে অনেক স্থানেই।

ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো মাটি ও বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হয়। এতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এক বছর আগে পানিস¤পদ মন্ত্রণালয় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ সংস্কার এবং কোথাও নতুন করে নির্মাণের জন্য মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা দেয়। অভিযোগ রয়েছে, বর্ষা মৌসুম চলে এলেও অনেক জেলায় বাঁধের সংস্কার কাজে হাতই দেওয়া হয়নি। বলাবাহুল্য, বন্যায় বাধ সংস্কারে বরাদ্দ আসে ভরা বর্ষা মৌসমে। পাউবোর সব জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীকে ভাঙনের ঝুঁকি রয়েছেÑ এমন এলাকা চিহ্নিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে এক বছরেও ওই নির্দেশনা অনেক জেলাতেই মানা হয়নি।

তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রায় পাঁচ বছর পরপর বাংলাদেশে প্রলয়ংকরী বন্যা দেখা দেয়। ১৯৮৮ সালের পর ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৭, ২০১৪ ও ২০১৭ সালে দেশে বড় বন্যা হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালও বন্যার জন্য ঝুঁকির বছর।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য বলছে, বন্যায় দেশের ৩৩ জেলা পড়তে পারে বিপদে। কারণ, এই জেলাগুলোতে রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ। ঝুঁকির ওই ফর্দে উত্তরের জেলা আটটি। এসব জেলায় নাজুক বাঁধ রয়েছে কমপক্ষে ১০০ কিলোমিটার। ধারণা করা হচ্ছে, টানা বৃষ্টির পর বন্যা হলে ঝুঁকিপূর্ণ এসব বাঁধ টিকিয়ে রাখা কঠিনই হবে। স্থানীয়রা জানান, প্রতিবছর বন্যার সময় এলে শুধু বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো মাটি ও বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হয়। এতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। এক বছর আগে পানিস¤পদ মন্ত্রণালয় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ সংস্কার এবং কোথাও নতুন করে নির্মাণের জন্য মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা দেয়। অভিযোগ রয়েছে, বর্ষা মৌসুম চলে এলেও অনেক জেলায় বাঁধের সংস্কার কাজে হাতই দেওয়া হয়নি।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিরাজগঞ্জ-পাবনা জেলার উধ্যষিত বৃহত্তর চলনবিল এলাকার পাঁচটি জেলাসহ বন্যায় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ উত্তরাঞ্চলের ৭ জেলা হলোÑ কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর।

পাউবো সিরাজগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, এখানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ কিলোমিটার। পানি বাড়লে এ জেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনার পানি যখন বিপদসীমার (১৩.৩৫ মিটার) ওপরে যায়, তখন ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের তলদেশে ঘূর্ণাবর্ত বাড়ে। যমুনার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভরা বর্ষায় বাঁধ ঝুঁকিতে পড়ে। বর্তমানে কাজিপুরের সিংগড়াবাড়ি এবং সদরের পাঁচঠাকুড়ি, শুভগাছা ও খোকশাবাড়ি এলাকার বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ছাড়া শাহজাদপুরের জালালপুর ইউনিয়নের আরকান্দি, ঘাটাবাড়ি, জালালপুর, পাচিল ও পাকুরতলা এলাকার বাঁধে ব্যাপক ভাঙন রয়েছে। যদিও সেখানে বাঁধের সংস্কারকাজ চলছে।

এলাকাবাসীর মতে, ফি বছর বন্যায় বাঁধ, কালাট, রিং বাঁধ এমনকি শক্ত কাঠামো ১০০ বছরের গ্যারান্টিযুক্ত সিরাজগঞ্জ হার্ডপয়েন্ট ও গ্রোয়েন এ যাবত ১০ থেকে ১৫ বার ভেঙেছে। সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার শক্ত-কাঠামো নদীতীর সংরক্ষণ এলাকা ১৭ বার ভেঙেছে। শক্ত-কাঠামো এর এমন অবস্থা হলে নড়বরে ঝুঁকিপূর্ণ নাজুক বাঁধের কি অবস্থা হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সিরাজগঞ্জের বাঁধভাঙন যেন এখন নিয়মে বা রীতিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছরই বরাদ্দ আসে বর্ষা মৌসুমে। মার্চ-এপ্রিলে বরাদ্দ এলে দেখে শুনে কাজ করা যায়। কিন্তু ভরা বন্যার সময় বরাদ্দ হলে আন্দাজ করে ব্লগ ফেলে নদী ভাঙনরোধ করতে হয়। ফলে, শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েও কাজের কাজ কিছুই হয় না। সমস্যা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরে রয়ে যায়। মাঝপথে বাণিজ্য ঘটে ঠিকাদারদের। উল্লেখ্য, নদী-ভাঙনের টাকা দিয়ে সিরাজগঞ্জ শহরে অনেক তরুণ-যুবক ঠিকাদার, ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি করেছে। কিন্তু নদীভাঙন এলাকার মানুষের দুঃখ ঘোচেনি। কথিত আছে যে, যে পরিমাণ টাকা স্বাধীনতার পর থেকে যমুনা ভাঙনের বরাদ্দ এসেছে, ওই পরিমাণ টাকা খুচরা পয়সা বা কয়েন বানিয়ে বস্তায় পুরে নদীতে ফেলতে পারলে যমুনা নদীই নাকি ভরে যেত।

নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রকিবুল আলম চৌধুরী জানান, এর আগে মন্ত্রণালয় থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা এবং মানুষের নিরাপত্তা ও ঝুঁকি কমাতে পদক্ষেপসহ প্রস্তাবনা চাওয়া হয়। ওই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রস্তাবনাসহ ২ কোটি ২০ লাখ টাকার বরাদ্দ চেয়ে পাঠানো হয় প্রস্তাব। তবে এখনও টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। বর্ষায় নাটোরের চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়া, নলডাঙ্গা, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম ও নাটোর সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় এসব নদীতীরের বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

লালমনিরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, গত ২৪ এপ্রিল তিস্তা ও ধরলা তীরবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের ২৯টি স্থান চিহ্নিত করে বিশেষ প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের ১৮ কিলোমিটার অংশ মেরামতে খরচ ধরা হয়েছে ২৭ কোটি টাকা। লালমনিরহাটের তিস্তা নদীর বাম তীর ও ধরলা নদীর ডান তীর এলাকাসহ সর্বমোট ৩৬ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ধরলার ডান তীর ১৮ কিলোমিটার ও তিস্তার বাম তীরে ১৮ কিলোমিটার।

পাউবোর কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল-মামুন, কুড়িগ্রাম ঘিরে আছে ১৬ নদী। এর মধ্যে যৌথ নদী কমিশন স্বীকৃত আন্তঃসীমান্ত নদী পাঁচটি। এগুলো হচ্ছেÑ ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার ও জিঞ্জিরাম।
এ নদীগুলোর মধ্যে তিস্তার বাম তীর, ধরলার ডান ও বাম তীর, দুধকুমারের ডান তীর ও ব্রহ্মপুত্রের ডান তীরে পাউবোর আওতায় ১৯২ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ৫২ কিলোমিটার বাঁধ সংস্কার ও মেরামত করা হচ্ছে। মেরামত করা অংশে ২৫টি স্থানের ১১ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া বাঁধ নেই তিস্তা নদীর বাম তীরে ১০ কিলোমিটার, দুধকুমার নদের ডান তীরে সাড়ে ৪ কিলোমিটার এবং ধরলার বাম তীরে ১৪ কিলোমিটারসহ মোট সাড়ে ২৮ কিলোমিটার। এখন ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও দুধকুমারের স্থায়ী তীর রক্ষায় ১ হাজার ৩২০ কোটি টাকা খরচায় তিন প্রকল্পের আওতায় ৩০ কিলোমিটার এলাকায় কাজ চলছে। পাশাপাশি তিস্তার বাম তীরের রাজারহাট ও উলিপুরের ঘড়িয়ালডাঙ্গা, বিদ্যানন্দ, নাজিমখান, থেতরাই, দলদলিয়া, গুনাইগাছ ও বজরা ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী প্রতিরক্ষা কাজের সমীক্ষা চলছে।

গাইবান্ধায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দীর্ঘ ৭৮ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ১০০ স্থানে মেরামত কাজ না করায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বাঁধটির ৫০ কিলোমিটারের বেশিরভাগ অংশের অবস্থা বেহাল। এ কারণে আসন্ন বন্যায় বাঁধ ভাঙনের আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। জেলাকে বন্যা থেকে রক্ষা করতে ১৯৬২ সালে সুন্দরগঞ্জের চণ্ডীপুর ইউনিয়ন থেকে শুরু করে সদর ও ফুলছড়ির ওপর দিয়ে দক্ষিণে সাঘাটা উপজেলার জুমারবাড়ী ইউনিয়ন পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়।

দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল ইসলাম জানান, দিনাজপুরে বন্যায় ক্ষতি হতে পারে বাঁধের প্রায় ৬০ কিলোমিটার এলাকা। এর মধ্যে রয়েছে পুনর্ভবা নদীর ১৫ কিলোমিটার, গর্ভেশ্বরী নদীর ১২ কিলোমিটার, ঢেপা নদীর ২০ কিলোমিটার এবং ঘোড়াঘাটের করতোয়া নদীর ৩ কিলোমিটার বাঁধ। আগাম সতর্কতা হিসেবে ঢেপা, পুনর্ভবা ও গর্ভেশ্বরীর বাঁধের সংস্কার চলছে।

নদী ভাঙনে, ব্রহ্মপুত্র বাঁধ রক্ষা করা যেন কঠিন হয়ে পড়েছে। কেননা, এখানে ঠিকাদারদের সিন্ডিকেট বড়ই শক্ত। তাদের শেকড় গভীরে প্রথিত। সিরাজগঞ্জের নদী ভাঙনের কাজ বাইরের কোনো ঠিকাদার পায় না, আর পেলেও তাদের কাজ করতে দেয়া হয় না। ফলে, সিন্ডিকেট নদীভাঙন নিয়ে করে বাণিজ্য। তার প্রমাণ মেলে, প্রতিবছর এ ঠিকাদারগুলো কোটি টাকার বাজেটে বনভোজন করে থাকে। একই অবস্থা অন্যান্য জেলায় বিদ্যমান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন