শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

বাংলা সাহিত্যে প্রেম

এস এম রাকিব | প্রকাশের সময় : ১০ জুন, ২০২২, ১২:০২ এএম

১৫ শতকের দিকে বাংলা ভাষায় যে আড়ষ্ঠতা ও অসংগতি ছিল তা সাবলীল হয়ে উঠতে আরও কয়েকশ বছর পার হয়ে গেল। শব্দের গায়ে লেগে থাকা মেদ ঝাড়তেও সময় পার হলো অনেক। ফলে এই সময় পূথি সাহিত্য বা কবিতার বিকাশ দেখা গেলেও স্বার্থক কোন সাহিত্যকর্ম দেখা যায়না। ১৮৫৮ সালে এই বন্ধ্যা কাটিয়ে টেকচাদ ঠাকুর বা প্যারিচাদ মিত্র ্র আলালের ঘরের দুলালগ্ধ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন যাকে বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের মাইল ফলক বলা হয়ে থাকে। সমাজের টুকরো টুকরো চিত্র এখানে বিধৃত হয়েছে যদিও প্রেম তেমন পাখা মেলেনি। কিন্তু মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে বাংলা সাহিত্য বঙ্কিম চন্দ্র চট্টপাধ্যয় এর কপাল কুন্ডলাগ্ধ দ্বারা সমৃদ্ধ হলো। নবকুমার, মতিবিবি আর কপাল কুন্ডলার ত্রিমাতৃক প্রেম পাঠককে নিয়ে গেল এক অন্য জগতে। উপন্যাসের শেষ ভাগে আমরা দেখি কপাল কুন্ডলার অন্তরালে থাকা পদ্মাবতী বাতাসের তোড়ে ঢেউয়ের ঝাপটায় তীর ভেঙ্গে নদীগর্ভে সমাহিত হলো আর নবকুমারও-

কিছুক্ষণ সাতার দিয়া কপাল কুন্ডলার অন্বেষণ করিতে লাগিলেন, তাহাকে পাইলেননা, তিনিও উঠিলেননা। সেই অনন্ত গঙ্গা প্রবাহ মধ্যে বসন্ত বায়ু বিক্ষিপ্ত বীচিমালায় আন্দোলিত হইতে হইতে কপাল কুন্ডলা ও নবকুমার কোথায় হারিয়ে গেল?
পাঠককে বিরহের মধ্যে ঠেলে দিয়ে বঙ্কিম বাবুও যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিলেন। তার পর আসলো রবীন্দ্রনাথ আর শরৎচন্দ্রের যুগ। বাংলা সাহিত্য এই দুই দিকপাল সাহিত্যিককে পেয়ে যেন তার বহু যুগের তৃষ্ণা মেটালো। আরেক মহিয়ষী নারী মৈত্রেয়ী দেবীগ্ধ। তিনি তার ন হন্যতে” উপন্যাসে প্রেম আর বিরহের যে আখ্যান রচনা করেছেন মুলত তা তার জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। তিনি এখানে আত্মখনন করেছেন। তিনি তার বাবার এক সময়ের ছাত্র মির্চা ইলিয়ডকে ভালোবাসতেন। তাদের ভালোবাসার কথা জানাজানি হয়ে গেলে মির্চাকে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়।এক রকম সন্যাস জীবন কাটানোর মত তিনি বাকী জীবন কাটিয়েছেন। ইলিয়ডের লেখা লা নুই বেঙ্গলীগ্ধ যদি একটি চিঠি হয় তবে ন হন্যতে উক্ত চিঠির প্রত্যুত্তর। বইটির একটি কথা না বললেই নয়, প্রায় ৪০ বছর পর আবার যখন তাদের দেখা হয় - কতদিন তুমি আমাদের বাড়িতে ছিলে- আমার মনে পড়েনা- কতদিন বলতো?
হাজার বছর- (পৃ: ১৭৮)
তবে তুমিওকি জানোনা তুমি কে, আমরা কি? আমিতো সেই তোমাকেই দেখতে এসেছি যাকে weapon cannot pierce, fire cannot burn-k ছেড়েনা অগ্নি দহেনা যারে-......
তবে সেই তুমি যার আদিও নেই অন্তও নেই- (পৃ: ১৭৮,১৭৯) দীর্ঘ বিরহের এক নান্দনিক মোহ সেদিন তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিল।
রবীন্দ্রনাথ আর শরৎ চন্দ্রে আসার আগে আমরা বাংলা সাহিত্যের সেকাল আর একালের কয়েকটি প্রেম আর বিরহের উপন্যাসের নাম অন্তত জানবো যা বহুদিন ধরে বিদগ্ধ পাঠকদের তৃষ্ণা মিটিয়ে যাচ্ছে। প্যারিচাদ মিত্রের পর বঙ্কিম চন্দ্র এবং আরও পরে বঙ্কিম চন্দ্র যেখানে থেমে যান রবীন্দ্রনাথ যেন সেখান থেকেই শুরু করেন। তিনিশেষের কবিতাগ্ধ এবং চোখের বালিগ্ধ দিয়ে সমৃদ্ধ করলেন বাংলাকে। শরৎ চন্দ্রের দেবদাস, পরিণীতা, দত্তা, শ্রীকান্ত ইত্যাদি পাঠকদের বহু রোমাঞ্চের যোগান দিল। আরও পরে নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেবগ্ধ পাঠকদের মনকে নাড়া দিয়েছিল। রম্য লেখক, বহু ভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলীর অনন্য সৃষ্টি শবনমগ্ধ। তারপর বুদ্ধদেব গুহ, তিনি বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের যেন হলুদ বসন্ত দিয়ে অভিবাদন জানালেন।
তারাশংকর বন্দোপাধ্যয়ের কবিগ্ধ সাড়া জাগিয়েছে বেশ।
১৯৩৬ সালে মানিক বন্দোপাধ্যয় এর পুতুল নাচের ইতিকথাগ্ধ যেন পাঠকদের ভিন্ন কিছু দেয়ার অভিপ্রায় করেছিল। এখানে শশী কুসুম এর মধ্যে যে অনাবিল প্রেম গড়ে ওঠে তা সাহিত্য বিচারে অনবদ্য। ১৯৯৭ সালে হুমায়ুন আহমেদ এর মেঘ বলেছে যাব যাব উপন্যাসটি মধ্যবিত্ত ভালোবাসা এবং টানা পোড়েন কে উপজীব্য করে লেখা হয়েছে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যয় এর কাগজের বউগ্ধ ও বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি।
আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হল বাংলা সাহিত্যে প্রেম ও বিরহ। হালে নবীন প্রবীন অনেক লেখক প্রেমকে বিভিন্ন আঙ্গিকে নিয়ে আসছেন।তবে যুগ যুগ ধরে যে উপন্যাসগুলো পাঠকের মনে প্রেম আর বিরহের ইন্দ্রজাল তৈরি করেছে তা নিয়ে দুটি কথা না বললে বড় অন্যায় হয়ে যাবে।
বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিম চন্দ্রের আগমন বা প্রস্থান যাই বলিনা কেন রবীন্দ্রনাথ কিন্তু পরিপূর্ণতা দান করেছেন।জীবন আর সমাজ এবং মন ও মননের যে শৈল্পিক ও নিগূঢ় তত্ত্ব তিনি উদ্ঘাটন করেছেন তা পাঠককে ভাবতে এবং ভাবাতে সাহায্য করে। রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানব চরিত্রের সংস্পর্শ চোখের বালি লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল যেখানে মহেন্দ্র,বিনোদিনী, বিহারী বা আশালতা সবারই যেন জীবনের টুকরো টুকরো আনন্দ, বেদনা এবং ভালোবাসা গুলোকে সমাজের ভয়ে পাশকাটিয়ে যাবার প্রবনতাই বেশি। সমগ্র উপন্যাস জুড়ে পাঠককে ভাবিয়েছে বিনোদিনী। নিজেই নিজেকে চোখের বালি করে রেখেছে। কিন্তু মহেন্দ্রর জন্য তার গচ্ছিত প্রেমটুকু তিনি সযত্নে তুলে রেখেছেন হৃদয়ের একান্তে। এবার আসি শেষের কবিতাগ্ধয়। এ সম্পর্কে দু একটি কথা না বললে হয়ত স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও ক্ষমা করবেননা। মানুষের মন বিশ্লেষণধর্মী এক অসামান্য উপন্যাস শেষের কবিতা›।
শুরুতেই অমিত চরিত্রের পরিচয় তিনি যেভাবে মেলে ধরেছেন তাতে পাঠক হাজার চেষ্টা করেও সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেনা কারণ তাকে টানবে অমিত, তাকে টানবে রবীন্দ্রনাথ। অমিত আর লাবণ্যর প্রেমকে রবীন্দ্রনাথ স্বর্গের মহিমা দিয়ে সুবাসিত করেছেন তা যেন এ নশ্বর জগতে কলঙ্কিত না হয়।
অমিত বলছে,
কেতকীর সাথে আমার সম্পর্ক ভালোবাসারই, কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল- প্রতিদিন তুলবো,প্রতিদিন ব্যবহার করবো। আর লাবণ্যর সঙ্গে আমার যে ভালোবাসা সে রইল দিঘি, সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাতার দেবেগ্ধ ( পরিচ্ছেদ ১৭)
অমিতের কাছে লেখা লাবণ্যর শেষ চিঠিতে তার বিয়ের খবর ছিল আর ছিল একটি দীর্ঘ কবিতা। শেষের কবিতার শেষের কটা লাইন এমনই-/হেথা মোর তীলে তীলে দান
করুন মুহূর্তগুলি গন্ডুষ ভরিয়া করে পান/হৃদয় অঞ্জলি হতে মম/ওগো তুমি নিরুপম/হেথা মোর তীলে তীলে দান/করুন মুহূর্তগুলি গন্ডুষ ভরিয়া করে পান/হৃদয় অঞ্জলি হতে মম/ওগো তুমি নিরুপম/হে ঐশ্বর্যবান,/তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান,/গ্রহন করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়/হে বন্ধু বিদায়।/বন্যা/উপন্যাসে বিরহের জন্য আর কি চাই?
কোন মন বিশ্লেষণ, দর্শন বা রাজনীতি কিছুই নয় পাঠক যেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল সেটা আর কিছু নয় সেটা ছিল ্র দেবদাসগ্ধ। শরৎচন্দ্র মাত্র সতের বছর বয়সে এই কালজয়ী উপন্যাসটি লিখেছিলেন, কিন্তু মুক্তি দিয়েছিলেন আরও সতের বছর পর অর্থাৎ ১৯১৭ সালে। দেশ বিদেশের প্রায় সতেরটি ভাষায় এই উপন্যাসের বহু চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে। বাঁশ বাগানে বসে লুকিয়ে হুকো খাওয়া থেকে শুরু করে কি করেনি সে? দেবদাস পার্বতীর খুনসুটি সারাজীবনের।
তার জীবনে কখনো পার্বতী আবার কখনো চন্দ্রমূখী উঁকি দিয়েছে।
একবার দেবদাস চন্দ্রমুখীকে চিঠি লিখেছিল-
বৌ, মনে করেছিলাম আর কখনো ভালো বাসবোনা, একেতো ভালোবেসে শুধু হাতে ফিরে আসাটাই বড় যাতনা তার পরে আবার নতুন করে ভালো বাসতে যাওয়ার মত এমন বিড়ম্বনা সংসারে আর নাই। ( পৃ :৮৪)
সব শেষ, পার্বতীরও বিয়ে হয়ে গেছে অনেক আগে। শুন্য, বিদ্ধস্ত এক প্রাণহীন কাঠামো নিয়েই দেবদাসের পথচলা। অবশেষে দীর্ঘ দিনের রোগ শোকে, নিজের প্রতি নিজের অত্যাচারে পার্বতীর বাড়ির সামনেই দেহ ত্যাগ করল দেবদাস।
স্বয়ং লেখকও দেবদাসের পাশে এসে দাড়ালেন-
মরনে ক্ষতি নাই,কিন্তু সে সময়ে যেন একটি স্নেহ করস্পর্শ তাহার ললাটে পৌছে- যেন একটিও করুনার্দ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়।মরিবার সময় যেন কাহারও এক ফোটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারেগ্ধ ( শেষাংশ)এইসব কালজয়ী উপন্যাসগুলো বহুযুগ ধরে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে রাখবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন