বর্তমান জাতীয় সংসদ সদস্যদের অর্ধেকের বেশি ব্যবসায়ী হওয়ায় আগামী অর্থ বছরের জন্য ঘোষিত বাজেট হয়েছে ধনীশ্রেণি বান্ধব। তারা নিজেদের স্বার্থে বাজেট ঘোষণা দিয়েছে। এ বাজেটের মাধ্যমে অনৈতিকতা, দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ বিদেশে পাচারকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। যতই সুবিধা দেয়া হোক পাচারকৃত টাকা দেশে ফেরত আসবে না। এসব মন্তব্য করেছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। গতকাল রোববার ঢাকার ব্র্যাক সেন্টার ইনের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এসব মন্তব্য করেন। এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম-এর আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০২২-২০২৩: পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কী আছে? -শিরোনামে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মধ্যবিত্ত এখন ত্রিমুখী আক্রমণের শিকার। এগুলো হলো- বৈষম্যমূলক অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূলের দাম বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এই ত্রিমুখী আক্রমণের শিকার মধ্যবিত্তের সুরক্ষায় প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু নেই। পাশাপাশি মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই মূহূর্তে রাজনৈতিকভাবে প্রতিনিধিত্বহীন। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবেও মধ্যবিত্তের অভিভাবক নেই। আর প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটেও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাজেটে ভর্তুকিত পরিমাণ বাড়ানো হলেও এর এক বড় অংশ বিদ্যুৎ খাতে চলে যাওয়ায় দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরা তেমন সুবিধা পাবেন না। সামাজিক নিরাপত্তা বরাদ্দেও দরিদ্ররা উপেক্ষিত থাকছেন বলে তিনি মনে করেন।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, গত এক দশকে গড়ে উঠা মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার বিষয়ে অবহেলা করা হয়েছে। উপরন্তু মধ্যবিত্তরা কর ফাঁকি দেয় বলে অর্থমন্ত্রী অভিহিত করেছেন। অথচ এই শ্রেণির মানুষের মেধা ও যোগ্যতাকে কতটা ব্যবহার করা হচ্ছে, তাদের প্রতি কতটা সুবিচার করা হচ্ছে তার আলোচনা এই বাজেটে নেই। এই মধ্যবিত্তরা যে সমস্ত জিনিস ব্যবহার করে যেমন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র ও রেফ্রিজারেটর- সেগুলোর কর বাড়ানো হয়েছে।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, সামাজিক নিরাপত্তায় টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বাড়লেও জিডিপি ও বাজেটের আকারের তুলনায় কমেছে। সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশনের বরাদ্দ বাদ দিলে সামাজিক নিরাপত্তায় প্রকৃত বরাদ্দ প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে। তিনি বলেন, ৫০০ টাকার ভাতায় একটা পরিবার বা দুস্থ মানুষের কিছুই হয় না। আমরা প্রতিটি সুবিধাভোগীর জন্য ১০০০ টাকা ভাতার প্রস্তাব করেছিলাম। যুবকদের ভাতাও চালু হয়নি। সাধারণভাবে ভাতাও বাড়েনি। ২০১৮ সালে জাতীয় আয়ের অংশ হিসেবে এই মানুষগুলো চার শতাংশের কম ভাতা পেতো। এখন পাচ্ছে ২.১ শতাংশ। পুরো দেশের মাথাপিছু আয় বাড়ল। তাদের কোন বরাদ্দ বাড়ল না। এই মানুষগুলোর অপরাধ কী? হয় মাথাপিছু আয় বাড়েনি, নয়তো এই মানুষগুলোকে বঞ্চিত করা হয়েছে। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বেড়েছে খুবই সামান্য। সামাজিক সুরক্ষায় সুদ, পেনশন, প্রকল্প সহায়তাসহ এমন অনেক উপাদান আছে যেগুলোর সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় দেখানো সঙ্গত নয়। সার্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও এ খাতে কোন বরাদ্দ নেই।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পাচার করা টাকা কর দিয়ে দেশে ফেরত আনা যাবে পাচারীদের এমন সুবিধা দিলেও ওইসব টাকা দেশে ফেরত আসবে না। সংসদ সদস্যদের অর্ধেকের বেশি ব্যবসায়ী হওয়ায় আগামী অর্থ বছরের জন্য ঘোষিত বাজেট হয়েছে ধনীশ্রেণি বান্ধব। তারা নিজেদের স্বার্থে বাজেট দিয়েছে। এ বাজেটের মাধ্যমে অনৈতিকতা, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
ড. ইফতেখারুজ্জমান বলেন, পাচারকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে বাজেটে সংবিধানবিরোধী অবস্থানকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ফলে বৈষম্য বাড়বে এবং আইনের শাসন নষ্ট হবে। সেসঙ্গে যে প্রশ্নটি সামনে আসছে, তাহলে সরকার কী অর্থ পাচার আইন বাতিল করে দিলো? এ সিদ্ধান্তের ফলে সরকার একদিকে দেশে যেমন সমালোচনার মুখে পড়ছে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবে চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়বে। কারণ বাংলাদেশ অর্থপাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা, এগমন্ড গ্রুপের সদস্য। অর্থ পাচারীদের সুবিধা দিলেও দেশে পাচারের টাকা ফেরত আসবে না বলে এ সময় মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়া এর আগে সিঙ্গাপুর থেকে যেভাবে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পাচারের টাকা ফেরত আনা হয়েছে তিনি সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করার পরামর্শ দেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন