কক্সবাজারে বর্ষায় পাহাড় ধসের শঙ্কায় রয়েছে ২০ লাখেরও বেশী মানুষ। জেলার ৯ উপজেলার আটটিতেই রয়েছে পাহাড়, বনভূমি আর সরকারী পেরাবন। এসব পাহাড়ে বসবাস করছেন ২০ লাখেরও বেশী মানুষ। বর্ষা এলেই পাহাড় ধসের শঙ্কায় নির্ঘুম রাত কাটান এসব এলাকার মানুষ। উখিয়া, টেকনাফ, রামু, কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, চকরিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালী উপজেলায় রয়েছে বিস্তীর্ণ পাহাড়। এসব পাহাড়ে গড়ে উঠেছে বিশাল জনগোষ্ঠীর অবৈধ বসবাস।
পাশাপাশি উখিয়া-টেকনাফের বিস্তীর্ণ পাহাড়ে গড়ে উঠেছে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প। এতে রয়েছে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বসবাস। পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষগুলো বর্ষায় প্রতিনিয়ত থাকেন পাহাড় ধসের আতঙ্কে। দেখা গেছে, শত শত একর বন ভূমি পাহাড় খেকুদের দখলে চলে গেলেও বনবিভাগের যেন কিছুই করার নেই। ক্ষেত্র বিশেষে বনবিভাগের কিছু কর্তাদের পরোক্ষ সহযোগিতায় বেহাত হয়েছে সরকারের বিস্তীর্ণ বনভূমি।
বন বিভাগের হিসেবে কক্সবাজারের ২ লাখ ৬০ হাজার একর বনভূমির মধ্যে প্রায় ৪৬ হাজার একর বেদখল হয়ে আছে পাহাড়, বন ও পেরাবন খেকুদের হাতে। দখলদারের তালিকায় রয়েছে, ৪৩ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও ৬৯৬টি সরকারী প্রতিষ্ঠান। এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে সেখানকার জীববৈচিত্রসমৃদ্ধ ভূমি দখল করে আছে। প্রায় প্রতিদিন এসব বনভূমির গাছ আর পাহাড় কেটে সেখানে নিত্যনতুন স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বনভূমি উদ্ধার নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলাও রয়েছে। বন বিভাগ থেকে এসব বনভূমি উদ্ধারের জন্য চিঠি দেয়া হলেও দখলমুক্ত না হয়ে বরং আরও বেশি দখলের শিকার হচ্ছে।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে জেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসে শতাধিক মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটে থাকে। চলতি বর্ষায়ও প্রবল বৃষ্টির সময় টেকনাফ, রামু ও কক্সবাজার সদরের কয়েকটি ইউনিয়নে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানরা মাইকে প্রচার করে জনগণকে সচেতন করতে দেখা গেছে।
কক্সবাজারে কারা কীভাবে বন ধ্বংস করছে, তা নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) এর এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, কক্সবাজার জেলায় বন ধ্বংসে এগিয়ে রয়েছে খোদ সরকারি সংস্থাগুলো। নিয়মিতভাবে নিত্যনতুন সরকারি সংস্থা এখানকার বনভূমি ইজারা নেওয়ার জন্য আবেদন করে চলেছে। অনেক সংস্থা অনুমোদন নেওয়ার আগেই সেখানে স্থাপনা গড়ে তুলছে।
সম্প্রতি শহরের কস্তুরাঘাট এলাকায় বাঁকখালী নদীর ভরাট অংশের বিস্তীর্ণ পেরাবন উজাড় করে সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করে চলেছে একটি শক্তিশালী চক্র। অবশ্য এ নিয়ে প্রশাসন দেরীতে হলেও সক্রিয় হয়ে মামলা করেছে দখলবাজদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই সবুজ পেরাবন কি আবার ফিরে আসবে সেখানে!
বেলা ও ইয়েসের গবেষণায় আরো দেখা গেছে, কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের জন্য যে পরিমাণে বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ বেশি বনভূমি খোদ সরকারি সংস্থাগুলো বরাদ্দ নিয়েছে। মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার পর রান্নার জন্য জ্বালানি কাঠ সংগ্রহে একের পর এক পাহাড়ি বন উজাড় করছিল। পরবর্তীতে সেখানে বিকল্প হিসেবে এলপিজি গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। এতে করে রোহিঙ্গা শিবিরের আশপাশের বনগুলো আবারও সবুজ হয়ে উঠছে। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলোর নামে বরাদ্দ পাওয়া জমিগুলোর বন কেটে তৈরি করা হচ্ছে নানা অবকাঠামো।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, সরকারি যেসব সংস্থার নামে কক্সবাজারের বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা যথাযথ সরকারি নিয়ম মেনে করা হয়েছে। আর জবরদখল করা বনভূমিকে অনেকে মালিকানা দাবি করে মামলা করেছেন। তবে একদম কোনো আইনি জটিলতা নেই, কিন্তু কেউ দখল করে আছে এমন বনভূমির তালিকা বন বিভাগ থেকে দেওয়া হলে অবশ্যই তা উচ্ছেদে সহযোগিতা করা হবে।
দেখা গেছে, কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি বনভূমি বরাদ্দ নিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। সংস্থাটি সোনাদিয়া দ্বীপ ও টেকনাফের ৮ হাজার ৮৮৫ একর জমি ইজারা নিয়েছে। সেখানে তারা শিল্প ও পর্যটন অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। এর বাইরেও মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় কয়েক হাজার একর বনভূমি বরাদ্দ নেওয়ার জন্য আবেদন করেছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে ২০২ দশমিক ২৪ একর ও ডুলাহাজারা খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হসপিটালকে ১৪ দশমিক ২৪ একর বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে সরকারের আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর নামেও বিপুল পরিমাণে বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
প্রকৃতি বিশেষজ্ঞদের মতে, কক্সবাজার হচ্ছে দেশের একমাত্র এলাকা যেখানে পাহাড়ি ও সমতল ভূমি থেকে শুরু করে দ্বীপে গড়ে ওঠা ম্যানগ্রোভ বনভূমি রয়েছে। মিষ্টি পানির নদী দিয়ে শুরু হয়ে তা সমুদ্রের নোনাপানির সঙ্গে মিশেছে। সে কারণে এই অঞ্চলকে বাংলাদেশের সবচেয়ে জীববৈচিত্রপূর্ণ এলাকা বলা হয়।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন সূত্রমতে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে কক্সবাজার অঞ্চলের উপকূলকে রক্ষায় ওই বনভূমি রক্ষাকবজের ভূমিকা পালন করছে। আর এশীয় বন্য হাতির অন্যতম বিচরণস্থলসহ দেশের বিলুপ্তপ্রায় অনেক বন্য প্রাণীর আশ্রয়স্থল এই জেলার বনভূমি। তাদের মতে এখানকার বনভূমিগুলো জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধার করে জীববৈচিত্রের জন্য সংরক্ষণ করা উচিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন