শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

মহাপ্লাবন

জাকারিয়া জাহাঙ্গীর | প্রকাশের সময় : ২৪ জুন, ২০২২, ১২:০৮ এএম

আকরাম সাহেব গার্মেন্টসের ঝুটের ব্যবসা করে পয়সাকড়ি ভালোই বানিয়েছেন। টানা ২০ বছর ধরে আছেন এ ব্যবসায়। শূন্য হাতে ঢাকায় এসে এখন নিজের একটি ফ্ল্যাটও হয়েছে। স্বপ্ন দেখছেন সামনে একখণ্ড জমি আর একটি প্রাইভেট কার কেনার। বন্যায় জমিজমা-বাড়িঘর হারিয়ে গ্রাম থেকে শহরে এসে শুরুতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। একসময় সুতা, দড়ি, ট্রাউজার, শর্টস, জ্যাকেট, টিশার্ট, ক্যাপ, খেলনাসহ ঝুটের তৈরি বিভিন্ন পণ্য ফেরি করে বিক্রি করেছেন। তারপর ধীরে ধীরে বড় ব্যবসায়ী হয়ে যান।

বাংলাদেশে বর্তমানে পাঁচ হাজারের বেশি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। দেশে গার্মেন্টনির্ভর যেসব শিল্প গড়ে উঠেছে, এরমধ্যে ঝুট ব্যবসা বেশ শক্তিশালী। এই পেশায় যারা জড়িয়েছেন তাদের মধ্যে অধিকাংশই নিজের ভাগ্য গড়েছেন। যারা দাঁড়াতে পারে না হয় শ্রম দিতে পারে না, নয়তো সিন্ডিকেটের দাপটে টিকতে পারে না। সবাই যে টিকতে পারবে, এমনটা ভাবাও ঠিক না। এ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে রক্তপাতের ঘটনাও কম নেই। এছাড়া চাঁদাবাজি তো আছেই। মহল্লার পাতিনেতা থেকে শুরু করে ঘাটে ঘাটে পয়সা খরচ করতে হয় ব্যবসায়ীদের। কেউ সিন্ডিকেটের বাইরে গেলেই তাকে ঝরে পড়তে হয়। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের জীবনে সিন্ডিকেট জড়িয়ে আছে। আকরাম সাহেব অবশ্য বেশ কৌশলী। শুরু থেকে এ পর্যন্ত কোথাও থমকে দাঁড়াতে হয়নি। বিয়ে করে সুখে জীবনযাপন করছেন। একমাত্র মেয়ে তিথি ঘর আলো করে আছে।
আকরামরা দুইভাই। আসলাম ও আকরাম। আসলাম বড়, আকরাম ছোট। আটাশি সালের ভয়াবহ বন্যায় আকরামের পরিবার জমিজমা, বাড়িঘরসহ সমস্ত সহায়-সম্পত্তি হারান। বন্যার পানি বাড়ার সাথে সাথে যমুনায় ভাঙন শুরু হয়। সর্বনাশা যমুনার গর্ভে হারিয়ে যায় একবিঘা জমির মধ্যে থাকা বিরাট বাড়ি, মাঠের প্রায় পাঁচ বিঘা আবাদি জমি। জন্মদাতা বাবার মৃত্যুর পর তার দাফন পর্যন্ত করতে পারেননি। লাশ কলার ভেলায় ভাসিয়ে দিতে হয়েছে। বাবার মৃত্যুর কয়েকদিন আগে আসলামের স্ত্রী কন্যাসন্তান প্রসব করে। বন্যার সময় মেয়ে হওয়ায় আসলামের বাবা নাতির নাম রাখেন বন্যা। কোল আলো করে সন্তান জন্ম নিলেও পরিবারে খুশি ছিলো না, বরং এতে কষ্ট আরো বেড়ে যায় বহুগুণ।
পরিবারের বড় সন্তানকে সংসারের সব দায়িত্ব পালন করতে হয়। সবার জন্য করতে গিয়ে নিজের জন্য কিছুই করা হয় না। আবার বেলা শেষে তাকেই অপরাধী সাজতে হয়, এটাই দুনিয়ার রীতি। আসলামের ভাগ্যটাও এমন। নিজে পড়াশোনা করতে পারেননি। তবে ছোটভাই আকরামকে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়িয়েছেন। নিজের পরিশ্রমে দুইবোনকেও মানুষ করে বিয়েশাদি দিয়েছেন। যখন বন্যায় তারা নিঃস্ব হয়ে যান; তখন আসলাম তার মা, ভাই, দুইবোন, স্ত্রী ও নবজাতক শিশু বন্যাকে নিয়ে যমুনার প্রায় দুই কিলোমিটার পূর্বে হাইওয়ের জমিতে আশ্রয় নেন। কোনোরকম হালের গরু ও পালের ছাগলগুলোকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। শেষ সম্বল সেগুলোও বিক্রি করে কোনোরকম খুপরি ঘর বানিয়ে বসবাস শুরু করেন সরকারি জায়গায়।
আকরাম ছোট থেকেই একটু বেয়াড়া ছিলেন। সবার ছোট বলে কারো কথা তেমন শুনতেন না। সংসারের কাজ কী জিনিস তা তো জানতেনই না। চরম অভাবে পড়ে কষ্ট কী তা অনুধাবন শুরু করেন। এদিকে নতুন যেখানে বাড়ি করেছেন তারা, তার নিকটবর্তী বাড়ির মঈনুদ্দিন নামের এক লোক ঢাকায় চালের আড়তদার। মঈনুদ্দিন যখন গ্রামে আসেন, তখন আকরামের সাথে দেখা হয়। পরিবারের সবকিছু শুনে তাকে চালের আড়তে কর্মচারী হিসেবে নিতে চান। শুনে আকরাম রাজি হয়ে যায়। আসলাম সবকিছু শুনে না করতে পারেন না। একার দিনমজুরি আয় দিয়ে সংসার চালাতে খুবই কষ্ট হচ্ছিলো। তিনি ভাবলেন, হয়তো ছোটভাই ঢাকায় কিছু আয়-রোজগার করলে পরিবারের অনেক উপকার হবে। মায়ের চিকিৎসা খরচ, সামনে দুইবোনের বিয়ে; কত চিন্তা!
কিন্তু সবই কপালের লিখন! আকরাম ঢাকায় গিয়ে সব ভুলে যায়। মাঝে ছয়মাস বা একবছর অন্তর কয়েকবার বাড়ি এলেও মায়ের মৃত্যুর পর প্রায় দশবছর হয় সে কোনো খোঁজখবর রাখেনি। এরমধ্যে আসলাম অনেক কষ্ট করে দুইবোনকে বিয়ে দিয়েছেন। তার ঘরে আরো এক ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম হয়েছে। এদিকে বন্যাও বড় হয়ে গেছে। সে নিজেই একটা ছেলেকে পছন্দ করে গোপনে বিয়ে করে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর আসলাম তাদের বিয়ে মেনে নিলেও ওই ছেলের বাবা-মা মেনে নেয়নি। ছেলেপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় বিয়ের কিছুদিন পর বন্যাকে তালাক দেওয়া হয়।
বন্যার তালাকের কিছুদিন পর। হাইওয়ের যে জমিটা দখল করে তারা ঘর বানিয়ে বসবাস করছিলো, পাশেই নতুন রেললাইন স্থাপন হওয়ায় সেটিও হাতছাড়া হয়ে যায়। একভাই ঢাকায় নিজের ভাগ্য গড়তে ব্যস্ত থাকলেও তারই বড়ভাই মহাকষ্টে ভাসতে লাগলেন। মাঝেমধ্যে অতীত মনে করে আসলাম ডুকরে কাঁদলেও নিজেই নিজেকে শান্তনা দেওয়া ছাড়া কিছু করার ছিলো না। কোনো উপায় না দেখে আসলাম এক পরিচিত লোকের সাথে তার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় চলে যেতে বাধ্য হন। বস্তির একটি খুপরি ঘর ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন।
যার সাথে তারা ঢাকা যান, তিনি বন্যাকে গার্মেন্টে একটি চাকরি নিয়ে দেন। এদিকে বন্যা গার্মেন্টের জিএম-এর নজরে পড়ে যান। গ্রামের সাজগোজহীন সুন্দরী মেয়েরা শহরের আভিজাত্যের ছোঁয়া পেলে দেখতে অপরূপা লাগে। বত্রিশ-তেত্রিশ বছরের বন্যাকে দেখতে জিএম-এর চোখে যেন স্বর্ণের ভাণ্ডারে ডায়মন্ড মনে হয়। জিএম বন্যাকে কাছে পেতে ভালো বেতন আর নানা সুযোগ-সুবিধার প্রলোভনে ফুসলাতে লাগলেন। অভাব আর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বন্যাও একসময় রাজি হয়ে যায়।
পাকাপোক্ত কথা অনুযায়ী জিএম সাহেব প্রিয় বন্ধুর বাসায় বন্যাকে নিয়ে যান। বন্ধুর বউ-বাচ্চা বাইরে, এই সুযোগে দুই বন্ধু মিলে ভালো একটা সময় কাটাবে। কথা অনুযায়ী বন্যাকে সুদৃশ্য ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলেন জিএম। আগে থেকেই ভেতর থেকে দরোজা খোলা ছিলো। একটু পর গায়ে দামি পারফিউম লাগিয়ে সামনে আসলেন আকরাম। বন্যার মুখোমুখি হতেই মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। নিজের হাতে নিজের গলা চেপে ধরবেন কি-না, সেটা মনে হচ্ছিলো। যেন আটাশি সালের ভয়াবহ বন্যার মহাপ্লাবন আজই প্রথম টের পাচ্ছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন