শেলী কীটস সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো অল্প বয়সে পরপারে চলে গেছেন কবি আবুল হাসান (৪/৮/১৯৪৭Ñ২৬/১১/১৯৭৫)। বাংলাদেশে দু’টি ঘটনা ঘটে তার জন্ম এবং মৃত্যুর সময়। সাতচল্লিশে দেশ বিভাগ আর পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর হত্যা। দুটি ঘটনায় বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দেশ বিভাগ থেকে স্বাধীনতা এ সময়ে অসংখ্য আন্দোলন হয়েছে বাংলাদেশে। দেশ উত্তাল ছিল। মানুষ সংগ্রাম করত। এমন সময় স্বল্প আয়ুর কবি আবুল হাসানের সময় কাল। ষাটের দশকের এই কবি উত্তাল আন্দোলনে তার লেখনির মাধ্যমে এবং সশরীরে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। তার কবিতায় দেশ মাতৃকার জন্য আত্মত্যাগের কথা ফুটে উঠেছে। আন্দোলন সংগ্রামের সময় দুঃখবোধ, মৃত্যুচেতনা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, নিঃসঙ্গচেতনা, স্মৃতি মুগ্ধতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে প্রকাশ পেয়েছে তার কবিতায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কবি আবুল হাসান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে মানুষের হতাশাবোধ, অস্থিরতা প্রকাশ পেয়েছে তার কবিতায়। সময়কে তিনি যথার্থই ধরেছিলেন। সময় ধরে তিনি এগিয়ে এসেছেন এবং সফলও হয়েছেন। তার কবিতার সমসাময়িক সময়কে ধারণ করে। সমসাময়িক সময়ের চলমান অস্থিরতার দর্পণ হচ্ছে আবুল হাসানের কবিতা।
আবুল হাসানের নিঃসঙ্গতাবোধ চরম আকারে প্রকাশ পেয়েছে তার কবিতাগুলোতে। কিশোর বয়স পেরিয়ে নব যৌবনে পা দেওয়া এই কবি কেনো নিঃসঙ্গ ছিলেন? তার মধ্যে নিঃসঙ্গতাবোধ এত বেশি কেনো? এই প্রশ্নর জবাব কি হতে পারে। পরিবেশ মানুষের উপরে প্রভাব বিস্তার করে। পরিবেশ তাকে বিভিন্ন আচারÑআচারণে অভ্যস্ত হতে সাহায্য করে। আর মানুষ তার প্রয়োজনে অভিযোজিত হয়ে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য বিভিন্ন কৌশল রপ্ত করে। কারণ তাকে টিকে থাকতে হবে। সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের উত্তাল সময়ে তার জন্ম। দেশে পরিবর্তন আসছে। আমূল পরিবর্তন। সে পরিবর্তন এতটা দ্রুত যে কিছু বুঝে উঠার আগেই তা ঘটে যাচ্ছে। শৈশবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন দেখেছেন তিনি। একটু বুঝতে শিখলে ছয় দফা, ঊনসত্তরের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ এই সব আন্দোলনের সময়কাল হচ্ছে তার জীবনকাল। এ রকম অস্তির সময়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা খুবই কঠিন। কারণে-অকারণে সংঘাত, আন্দোলন, মিছিল মিটিংয়ে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। যে যার মত ব্যস্ত। কারোর দিকে কারোর তাকানোর সময় নেই। আর সে সময়ে আবুল হাসানের কবিতায় নিঃসঙ্গতাবোধ উঠে আসা স্বাভাবিক ব্যাপার। কারণ সাহিত্য সমাজের দর্পণ। সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজকে দর্শন করা যায়। নিঃসঙ্গবোধের কবি আবুল হোসেন মিয়া (আসল নাম)। তিনি কত সহজে কবিতার মাধ্যমে তার সময়কে ধরেছেন তা নিয়ে আমরা আলোচনা করব।
কৈশোর বয়স মানুষের সবচেয়ে আনন্দের সময়। কোনো চিন্তা থাকে না। খেলা আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা। মানুষের জীবনের সবচেয়ে মধুর সময় কৈশোর কাল। বন্ধুরা মিলে নারকেল বাগান থেকে ডাব পেড়ে খেয়ে যে কি আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তবু দেশ যখন উত্তাল আন্দোলনে। পট পরিবর্তনের সময় সে বন্ধু যে যার মতো চলে গেছে। একটু বুঝতে শিখলে তারা বিভিন্ন সেক্টরে চলে গেছে। কেউ কেউ জীবিকার তাগিদে দূরে কোথায় গেছে। কারোর সাথে মাঝে মাঝে যোগাযোগ হয়। কারোর সাথে মোটেও যোগাযোগ নেই। এভাবে নিঃসঙ্গতায় ভোগে মানুষ। বন্ধুরা মিলে নানা ক্রিয়া করতো, নাটক করতো, মেয়েদের বিষয়ে গোপন আলোচনা চলতো সেই দূরন্তপনা আর নেই। তারা সব কোথায় হারায়ে গেছে সময়ের ব্যবধানে। বাস্তবতার কারণে স্মৃতি কাতর কবি সেই সব অন্তর থেকে মিস করেন। সময়ের ব্যবধানে অনেকে মারা গেছে। কৈশোরের সেই নারকেল গাছ বুড়ো হয়ে গেছে। তবু স্মৃতিরা খেলা করে একাকী নিঃসঙ্গ জীবনে। নস্টালজিয়া নির্ভর আবুল হাসানের “স্মৃতিকথা” কবিতা এই ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেনÑ “যে বন্ধুরা কৈশোরে নারকেল বনের পাশে বসে/ আত্মহত্যার মতো বিষণœ উপায়ে উষ্ণ মেয়েদের গল্প করতো? শীতকালে চাঁদের মতোন গোল বোতামের কোটপড়ে ঘুরতো পাড়ায়,/যে বন্ধুরা থিয়েটারে পার্ট কোরতো,/কেউ সাজতো মীরজাফর, কেউবা সিরাজ/তারা আজ, এখন কোথায়?/.../অনেকেই চলে গেছে, অনেক নারকেল গাছ হয়ে গেছে বুড়ো/অনেক প্রাঙ্গন উঠে গেছে/ গোলাপ চারার মতো সুন্দর বয়সমাখা প্রসিদ্ধা তরুণী,/ মধ্যরাতে নারকেল বনের কাছে ভেঙে যায় আমার গল্পগুলি/ স্মৃতিকথা সেখানে নিশ্চুপ।”
মানুষ পৃখিবীতে আসে একা। আবার যখন চলে যায় তখনো একা। যৌবনে চারপাশে মানুষের ভিড় থাকে। কর্মব্যস্ত হয়ে যায় মানুষ। কিন্তু বৃদ্ধ বয়েসে মানুষ এতো একাবোধ করে যে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। চারপাশে সবকিছু থাকতেও সে যেনো একা কোনো নির্জন দ্বীপের অধিবাসী। বৃদ্ধ বয়স বড় নিঃসঙ্গ জীবন। এই সময় সব থাকতেও কিছু থাকে না। মনে হয় গতিশীল পৃথিবীতে একমাত্র তিনিই বেমানান। মাঠের মধ্যে গাছের মতো একা নির্জন নিঃসঙ্গ। এই সময়ে প্রতিটি সন্তানের উচিত তাদের দিকে বিশেষ লক্ষ্য দেওয়া। কিন্তু বাস্তব আরো কঠিন। বাস্তবের সাথে তাল মিলতে গিয়ে আমরা তাদের আরও দূরে ঠেলে দিই। চমৎকার উপলব্ধির কবি আবুল হাসান “পাখি হয়ে যায় প্রাণ” কবিতায় সে কথা বলেছেনÑ “অবশেষে জেনেছি মানুষ একা!/জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!/দৃশ্যের বিপরিত সে পারে না একাত্ব হতে এই? পৃথিবীর সাথে কোনোদিন।/... / বদলপ্রয়াসী এই জীবনের জোয়ারে কেবল? অন্তঃশীল একটি দ্বীপের মতো/সবার গোচরহীন আছি আজো সুদূর সন্ধানী!/দূরে বসে প্রবাহের অন্তর্গত আমি, তাই নিজেই অচেনা নিজে/কেবল দিব্যদুষ্ট শোনিতের ভারা ভারা স্বপ্ন/বোঝাই মাঠে দেখি,/সেখানেও বসে আছে বৃক্ষের মতোন একা একজন লোক,”
বাংলাদেশে সাতচল্লিশ থেকে পঁচাত্তর অস্থির সময়। এই সময় মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন সেখানে বিনোদন করার অবকাশ নেই। অনিরাপত্তাÑভয় উৎকণ্ঠায় প্রাণ ত্রাহি ত্রাহি। এ সময় শুভ কিছু করতে গেলেও নানা সমস্যা। কখন কি জানি হয়ে যায়। স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হতে সময় লাগে না। আর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে মানুষের উপড়ে। মানুষ হিং¯্র হয়ে যায়। কেউ কারোর সাথে মিল হয়ে থাকতে চায় না। সব কিছুর পেছনে স্বার্থ খোঁজা তখন মানুষের স্বভাব হয়ে যায়। মানুষ এতটা হিং¯্র হয়ে যায় যে বনের পশুরাও ভয় করে মানুষকে। তখন আর কাউকে কেউ বিশ্বাস করে না। আর অবাধে বনভূমিÑ সবুজ ধ্বংস করছে মানুষ। তাতে নিজেদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। “বনভূমির ছায়া” কবিতায় এই সব কথা লিখেছেন কবিÑ “আমরা হঠাৎ কী রকম অসহায় আর একা হয়ে গেলাম!/আমাদের আর পিকনিকে যাওয়া হলো না,/লোকালয়ের কয়েকটি মানুষ আমরা/কেউই আর আমাদের এই ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা? একাকীত্ব, অসহায়বোধ/আর মৃত্যুবোধ নিয়ে বনভূমির কাছে যেতে সাহস পেলাম না! ”
মানুষ সঙ্গ প্রিয়। কিন্ত মৃত্যু সবার জীবনে আসবে। মানুষ মরে গেলেও স্মৃতি রেখে যায়। খুব অল্প বয়েসে যদি কোনো মানুষ মারা যায়। তখন বন্ধুদের খেলার মাঠেÑআড্ডায় কখনো কখনো তাকে স্মরণ করে। বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই, কবি অল্প বয়েসে মারা গেছেন। তিনি কি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি মারা যাবেন! কবিরা তার সময়ের চেয়ে অগ্রগামী। তারা ভবিষ্যৎ অনুমান করতে পারেন। কবির জীবনে যা ঘটেছে তা তার কবিতার ভাষা। যা পরবর্তীতে বাস্তবায়ন হয়েছে। কবির স্মৃতি আপনজনদের কাঁদাবে। এই সব কথা দেখতে পাই কবির “বন্ধুকে মনে রাখার কিছু ২” নামক কবিতার চরণে। তিনি লিখেছেনÑ “দল বেঁধে সিনেমায় ঢুকে/ মনে পড়ে যায় যদি আমাকে সবার কোনোদিন/দীর্ঘায়িত পর্দার অলৌকিক স্পর্শে সেদিন/ পরিপূর্ণ শিহরনময় একটি দুঃখের দৃশ্যে?/ আমাকে খুঁজবে তুমি?/ ঘরে ফিরে যাবার বেলায় মনে হবে?/ নাকি, সেÑ রাতের কথা অকস্মাৎ দগ্ধ কোরে দেবে? ”
বিপদ যখন আসে চারদিক থেকে আসে। তখন সোনা ধরলেও ছাই হয়ে যায়।আস্তে আস্তে মানুষ নিজের প্রতি বিশ্বাস হারায়ে ফেলে। নিজেকে অপায়া অলক্ষণে মনে করে। ব্যর্থতা গ্রাস করে তখন। চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়। নিঃসঙ্গ হয়ে যায় মানুষ। নিঃসঙ্গতাবোধ মৃত্যুকেও মাঝে মাঝে ডেকে আনে। নিঃসঙ্গ মানব জীবনে কোনো কিছুতে সফলতা আসে না। আবুল হাসানের ‘অপরিচিতি’ নামক কবিতা সে প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়Ñ “যেখানেই যাই আমি সেখানেই রাত!/ স্টেডিয়ামে খোলা আকাশের নিচে রেস্তোরাঁয়/ অসীমা যেখানে তার অত নীল চোখের ভিতর/ধরেছে নিটোল দিন নিটোল দুপুর/সেখানে গেলেও তবু আমার কেবলই রাত/ আমার কেবলই শুধু রাত হয়ে যায়! ”
অথবা
“আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি” শিরোনামের কবিতায় তিনি লিখেছেনÑ “ক্লাশভর্তি উজ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে / ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ!/আমি বাজে ছেলে, আমি লাস্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না!/ ক্ষমা করবেন বৃক্ষ, আপনার শাখায় আমি সত্য /পাখি বসাতে পারবো না !/... / সচ্চরিত্র ফুল আমি যত বাগানের মোড়ে লিখতে যাই, দেখি / আমার কলম খুলে পড়ে যায় বিষ পিঁপড়ে, বিষের পুতুল! ”
নিঃসঙ্গবোধ প্রকাশে আবুল হাসান বাংলা সাহিত্যে অদ্বিতীয়। তার কবিতার উপমা অলংকারে নিঃসঙ্গতাবোধের হাহাকার আমরা প্রত্যক্ষ করি। তার আর্ত হাহাকার যে প্রতিটি মানুষের হাহাকার। তার কবিতা পড়লে আমরা উপলব্ধি করতে পারি মানুষের এই নিঃসঙ্গতা বোধকে। আমরা মানুষকে ভালোবেসে পরস্পর কাছে থেকে ভুলিয়ে দিতে পারি এই দুঃখবোধ। মানব জীবনকে সুন্দর করতে কবির এই সাবধানী সূক্ষ চোখ আমাদের আবেগ আপ্লুত করে। জীবনের নতুন বোধের সন্ধান দেয়। নিঃসঙ্গ মানুষদের পাশে থেকে তাদের জীবনকে আনন্দে ভরে দেবো এই প্রত্যয়ে আগামী হোক শুভময়।
নিঃসঙ্গতাবোধে আবুল হাসান
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন