২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স ২ হাজার ৪৭৮ কোটি (২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন) আসলেও, সদ্যসমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসীদের আয় প্রবাহ নিম্নমুখী ধারায় শেষ হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৬ লাখ (২১ দশমিক ০৩ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা আগের বছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম। হিসাব মতে, বিদায়ী অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমেছে ৩ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার।
সূত্র মতে, অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ১৮৩ কোটি ৭৩ লাখ (১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে এসেছে। যা গত বছরের জুনের চেয়ে ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ কম। আর আগের মাস এপ্রিলের চেয়ে কম ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। গত এপ্রিলে ১৮৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ২০২১ সালের জুনে এসেছিল ১৯৪ কোটি ৮ লাখ ডলার। খোলা বাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেশি হওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে বেশি টাকা পাওয়া যাচ্ছে। সে কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
যদিও সদ্যবিদায়ী অর্থবছরের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে রেমিট্যান্সে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছিল, ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে রেমিট্যান্স আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০ শতাংশ বাড়বে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। কিন্তু পুরো অর্থবছরের প্রবাসী আয় কমেছে। একই সঙ্গে কমেছে রিজার্ভের পরিমাণ। করোনাভাইরাস সৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরে অর্থনীতির প্রতিটি সূচক বিধ্বস্ত হলেও চাঙা ছিল দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ। কিন্তু সদ্যবিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির ধারা নিম্নমুখী হয়।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্সে হঠাৎ যে উল্লম্ফন হয়েছিল, তার একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট ছিল। ওই বছরের পুরোটা সময় করোনার কারণে পুরোবিশ্ব কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। সে কারণে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোও বন্ধ ছিল। প্রবাসীরা সব টাকা পাঠিয়েছিলেন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে। সে কারণেই রেমিট্যান্স বেড়েছিল। আর কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় এবং কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেশি থাকায় এখন আগের মতো অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। তাই বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম এসেছে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে রেমিট্যান্স কম এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার (৩ জুলাই) রেমিট্যান্স প্রবাহের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে ১৮৭ কোটি ডলার, আগস্টে ১৮১ কোটি ডলার, সেপ্টেম্বরে ১৭২ কোটি, অক্টোবর ১৬৪ কোটি, নভেম্বর ১৫৩ কোটি, ডিসেম্বরে ১৬৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠান প্রবাসীরা।চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ১৭০ কোটি ডলার, ফেব্রুয়ারিতে ১৪৯ কোটি ডলার, মার্চে আসে ১৮৬ কোটি ডলার। এপ্রিলে ২০১ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, একক মাসের হিসাবে যা ছিল বিদায়ী অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি। মে মাসে ১৮৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার দেশে এসেছে। আর অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ১৮৩ কোটি ৭৩ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। বিদায়ী অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৪০ কোটি ২৭ লাখ ডলার। বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে ৩ কোটি ৭২ লাখ ডলার, বেসরকারি ৪১ ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১৬৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার, আর বিদেশি ৯ ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৯ কোটি ৪১ লাখ ৭০ হাজার ডলার। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে রেমিট্যান্সে সরকারি প্রণোদনার হার ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করা হয়েছে। দেশে বড় অঙ্কের রেমিট্যান্স পাঠানোর শর্তও শিথিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে ৫ লাখ টাকার বেশি রেমিট্যান্স পাঠালে তার বিপরীতে প্রণোদনা পেতে হলে আয়ের উৎস দেখিয়ে নথিপত্র ব্যাংকে জমা দিতে হতো। সম্প্রতি সে শর্তও শিথিল করা হয়েছে। তার পরও দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ না বেড়ে উল্টো কমেছে।
রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে গত অর্থবছরজুড়েই বেড়েছিল দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত বছরের আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু আমদানি ব্যয়ে অস্বাভাবিক উল্লম্ফনের পাশাপাশি রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে। রোববার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। এই সপ্তাহেই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন