নদ-নদীর দেশ বাংলাদেশ। নদী এদেশের মানুষের জীবনের সাথে মিশে আছে ওতপ্রোতভাবে। নদী কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধারই নয়, এদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার অন্যতম উৎসও বটে। মানুষের সমস্ত শরীরে শিরা-উপশিরা যেমন বয়ে নিয়ে চলে শোণিতের ধারা, নদীও তেমনি জীবনপ্রবাহ হয়ে বয়ে গেছে এদেশের শরীরের উপর দিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই নদী জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশের সাহিত্যেও। নদী কখনো কখনো দেশমাতৃকার প্রতীক হয়ে ধরা দিয়েছে বাংলা কবিতায়। সুদূর ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে বসে কবি মধুসূদন আর্তনাদ করে উঠেছেন তাঁর কৈশোরের নদী কপোতাক্ষের বিরহে- ‘বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদী-দলে,/ কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জ¦লে!’ কপোতাক্ষ এখানে মাতৃভূমির রূপ ধরে হাজির হয়েছে কবির কাছে। জীবনানন্দ দাশ মৃত্যুর পর শঙ্খচিল-শালিকের বেশ ধরে আবার ফিরে আসতে চেয়েছেন তাঁর প্রিয় নদী ধানসিঁড়ির তীরে। বাস্তবিকই নদীর সাথে বাঙালির সখ্য সারা জীবনের। হাজার নদীর দেশ বাংলাদেশের প্রধান নদী পদ্মা; বাংলা কবিতা ও কথাসাহিত্যে পদ্মানদীর আধিপত্যও তাই সবার চেয়ে বেশি।
হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে গঙ্গা নদী রাজশাহী জেলা দিয়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। এখানে এসে নদীটি ধারণ করেছে পদ্মা নাম। গঙ্গার অন্য শাখাটি ভাগীরথী নাম নিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ভারতের হুগলির দিকে। উৎপত্তিস্থল হতে ২২০০ কিলোমিটার দূরে গোয়ালন্দে যমুনা নদীর সাথে মিলিত হয়ে মিলিত প্রবাহ পদ্মা নামে আরও পুব দিকে চাঁদপুর জেলায় মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। সবশেষে পদ্মা-মেঘনার মিলিত প্রবাহ মেঘনা নাম ধারণ করে মিশে গেছে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে। পদ্মা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী। এর দৈর্ঘ্য ৩৬৬ কিলোমিটার। পদ্মার প্রধান উপনদী মহানন্দা ও পুনর্ভবা। মহানন্দা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা এবং পুনর্ভবা বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পদ্মার বিভিন্ন শাখানদীর মধ্যে গড়াই, বড়াল, আড়িয়াল খাঁ, কুমার, মাথাভাঙ্গা, কপোতাক্ষ প্রভৃতি অন্যতম। পদ্মার বিভিন্ন প্রশাখা নদীসমূহ হলো: মধুমতী, পশুর, ভৈরব ইত্যাদি। এই নদীগুলো কুষ্টিয়া, রাজবাড়ি, যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, মাগুরা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, বরিশাল, পটুয়াাখালি প্রভৃতি জেলার উপর দিয়ে বিস্তৃতি লাভ করেছে। এককথায়, প্রায় গোটা বাংলাদেশকেই ঘিরে আছে পদ্মানদী। পদ্মার তাই এত গুরুত্ব এদেশের মানুষের জীবনে, অর্থনীতিতে ও সাহিত্যে।
রবীন্দ্রসাহিত্যের একটা বিরাট অংশ দখল করে আছে নদী। পদ্মা তার মধ্যে অন্যতম। চৈতালী কাব্যগ্রন্থে একটি কবিতাই আছে পদ্মা নামে। এ কবিতায় কবি পদ্মাকে সম্বোধন করে বলেছেন তার সাথে তাঁর সখ্যের কথা। কবির ভাষায়-
নিভৃতে শরতে গ্রীষ্মে শীতে বরষায়
শতবার দেখাশুনা তোমায় আমায়।
কতদিন ভাবিয়াছি বসি তব তীরে
পরজন্মে এ ধরায় আসি যদি ফিরে,
যদি কোন দূরতম জন্মভূমি হতে
তরী বেয়ে ভেসে আসি তব খরস্রোতে,
কত গ্রাম, কত মাঠ, কত ঝাউঝাড়
কত বালুচর কত ভেঙে পড়া পাড়
পার হয়ে এই ঠাঁই আসিব যখন
জেগে উঠিবে না কোন গভীর চেতন?
মৃত্যুর পর কেবল জীবনানন্দ দাশই তাঁর প্রিয় নদীর কাছে ফিরে আসতে চাননি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তার বহু আগে তাঁর পুনর্জন্মে ফিরে আসতে চেয়েছেন তাঁর প্রিয় নদী পদ্মার কাছে।
নজরুলের বিখ্যাত গান ‘পদ্মার ঢেউ রে’ বাংলার আকাশে বাতাসে এখনও ঘোষণা করে চলেছে পদ্মার মহিমা-
পদ্মার ঢেউ রে
ও মোর শূন্য হৃদয়-পদ্ম নিয়ে যারে।
এই পদ্মে ছিল রে যার রাঙা পা
আমি হারায়েছি তারে।।
মোর পরান-বঁধু নাই,
পদ্মে তাই মধু নাই নাই রে
বাতাস কাঁদে বাইরে
সে সুগন্ধ নাই রে
মোর রূপের সরসীতে আনন্দ-মৌমাছি নাহি ঝংকারে।।
ও পদ্মারে, ঢেউয়ে তোর ঢেউ ওঠায় যেমন চাঁদের আলো
মোর বঁধুয়ার রূপ তেমনই ঝিলমিল করে কৃষ্ণ কালো।
সে প্রেমের ঘাটে ঘাটে বাঁশি বাজায়
যদি দেখিস তারে, দিস এই পদ্ম তার পায়
বলিস কেন বুকে আশার দেয়ালি জ্বালিয়ে
ফেলে গেল চির-অন্ধকার।।
প্রমত্তা পদ্মার কী দুরন্ত রূপ, তার চিত্র তুলে ধরেছেন আবদুল লতিফ তাঁর বিখ্যাত ‘সর্বনাশা পদ্মানদী, তোর কাছে শুধাই’ গানে, যা অমর শিল্পী আবদুল আলীমের কণ্ঠে জীবন্ত হয়ে সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে যাচ্ছে আজও দেশের আকাশে বাতাসে-
সর্বনাশা পদ্মানদী,
তোর কাছে শুধাই
বল আমারে তোর কি রে আর
কূল কিনারা নাই।।
পারের আশায় তাড়াতাড়ি
সকাল বেলায় ধরলাম পাড়ি
আমার দিন যে গেল সন্ধ্যা হলো
তবু না কূল পাই।।
পদ্মা, রে তোর তুফান দেইখা
পরান কাঁপে ডরে
ফেইলা আমায় মারিস না তোর
সর্বনাশা ঝড়ে।
একে আমার ভাঙা তরী
মাল্লা ছয়জন শল্লা করি
আমার নায়ে দিল কুড়াল মারি
কেমন পারে যাই।।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘পদ্মার প্রতি’ কবিতায় তুলে ধরছেন পদ্মার প্রলয়ংকরী ও কল্যাণময়ী রূপÑ
হে পদ্মা! প্রলয়ংকরী! হে ভীষণা! ভৈরবী সুন্দরী!
হে প্রগলভা! হে প্রবলা! সমুদ্রের যোগ্য সহচরী
তুমি শুধু, নিবিড় আগ্রহ আর পার গো সহিতে
একা তুমি সাগরের প্রিয়তমা, অয়ি দুবিনীতে!
দিগন্ত বিস্তৃত তোমার হাস্যের কল্লোল তারি মত
চলিয়াছে তরঙ্গিয়া, - চির দৃপ্ত, চির অব্যাহত।
দুর্নমিত, অসংযত, গূঢ়চারী, গহন গম্ভীর;
সীমাহীন অবজ্ঞায় ভাঙিয়া চলেছ উভতীর ।
রুদ্র সমুদ্রের মত, সমুদ্রেরি মত সমুদার
তোমার বদরহস্ত বিতরিছে ঐশ্বর্যসম্ভার।
উর্বর করিছ মহি, বহিতেছ বাণিজ্যের তরী
গ্রাসিয়া নগর গ্রাম হাসিতেছ দশদিক ভরি।
চল্লিশের দশকের প্রধান কবি ফররুখ আহমদও সনেট লিখেছেন ‘পদ্মা’ শিরোনামে। এখানেও তিনি তুলে ধরেছেন পদ্মার রুদ্র ও কল্যাণময়ী রূপÑ
অনেক ঘূর্ণিতে ঘুরে, পেয়ে ঢের সমুদ্রের স্বাদ,
জীবনের পথে পথে অভিজ্ঞতা কুড়ায়ে প্রচুর
কেঁপেছে তোমাকে দেখে জলদস্যু- দুরন্ত হার্মাদ
তোমার তরঙ্গভঙ্গে বর্ণ তার হয়েছে পাণ্ডুর।
------ ----- -----
বর্ষায় তোমার স্রোতে ভেসে গেছে সাজানো বাগান,
অসংখ্য জীবন আর জীবনের অজস্র সম্ভার,
হে নদী, জেগেছে তবু পরিপূর্ণ আহ্বান
মৃত জড়তার বুকে খুলেছে মুক্তির স্বর্ণদ্বার
তোমার সুতীব্র গতি, তোমার প্রদীপ্ত স্রোতধারা।
বাংলা ভাষায় অনেক উপন্যাস রচিত হয়েছে এদেশের নদ-নদীকে নিয়ে। বাংলা সাহিত্যের নদীভিত্তিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬)-এর ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ (১৯৩৬), অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১)-এর ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৫৬), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১)-এর ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ (১৯৪৭), হুমায়ুন কবীর (১৯০৬-১৯৬৯)-এর ‘নদী ও নারী’, সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮)-এর ‘গঙ্গা’ (১৯৫৫), আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩)-এর ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ (১৯৮৬), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০১০)-এর ‘কর্ণফুলী’ (১৯৬২), শহীদুল্লা কায়সার (১৯২৭-১৯৭১)-এর ‘সারেং বৌ’ (১৯৬২) প্রভৃতি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ পদ্মাকে নিয়ে রচিত বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। উপন্যাসটি পদ্মাপাড়ের মানুষের বিচিত্র জীবনকাহিনী তুলে ধরে, তুলে ধরেছে মূলত নদীমার্তৃক বাংলাদেশকেই।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন