শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

নাট্যকার হুমায়ূন

আহমেদ উল্লাহ্ | প্রকাশের সময় : ২২ জুলাই, ২০২২, ১২:০১ এএম

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অনন্য এক বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী হুমায়ূন আহমেদ। উপন্যাস থেকে শুরু করে ছোটোগল্প, সংগীত ও নাটক-সিনেমায় বিস্মিত করেছেন বাংলাভাষী মানুষকে। যে বিস্ময়ের অন্ত খুঁজে পাওয়া দায়; যে বিস্ময় ছড়িয়েছিটিয়ে আছে শহর, নগর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম-বাংলায়। যার তুলনা শুধু তিনিই। এই বিস্ময়মানব সফল হয়েছেন তার সব ধরনের নির্মাণশৈলীতে। এমনকী বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপকেন্দ্রিক নতুন শৈলীর জনক। তিনি যেমন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিরও পথিকৃৎ, তেমনি একজন সফল নাট্যকার ও সিনেমা পরিচালক হিসেবেও অগ্রগণ্য।
আশির দশক থেকে তিনি ধারাবাহিক এবং টেলিফিল্ম রচনা শুরু করেন। তার রচিত প্রথম কাহিনীচিত্র প্রথম প্রহর বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয় ১৯৮৩ সালে, নাটকটি পরিচালনা করেন নওয়াজিশ আলি খান; যা রাতারাতি তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। এরপর থেকে তিনি বহু এক পর্ব ও ধারাবাহিক বহুপর্বের নাটক নির্মাণ করেছেন। যেমন- মধ্যে খেলা, অচিন বৃক্ষ, খাদক, একি কাণ্ড, একদিন হঠাৎ, অন্যভুবন উল্লেযোগ্য।
হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক উড়ে যায় বকপক্ষী, আনঅফিসিয়াল পোস্টার, এই সব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, অয়োময়, আজ রবিবার, সবুজ সাথী, এই মেঘ এই রৌদ্র, কালা কইতর, চন্দ্র কারিগর, সবুজ ছায়া, সেদিন চৈত্র মাস, জোছনার ফুল, শুক্লপক্ষ ইত্যাদি। তার রচিত প্রতিটি নাটকের কাহিনির চরিত্র জীবনঘনিষ্ট, বাংলার মানুষের যাপিত জীবনের আখ্যান। তিনি নাটকের কাহিনির যথোপযুক্ত চরিত্র নিমার্ণের পাশাপাশি সংলাপ প্রয়োগে যথেষ্ট পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
তার সাড়া জাগানো নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে কোথাও কেউ নেই, এইসব দিনরাত্রি, ‘অয়োময়, আজ রবিবার ইত্যাদি। এই ধারাবাহিক নাটকগুলোর বাইরেও অসংখ্য খণ্ডনাটক নির্মাণ করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তার নাটকগুলো আলাদা গল্পের, আলাদা ধাচের, আলাদা রস ও আনন্দদায়ক। তার নাটকে উপস্থাপিত মুসলিম রীতি-নীতি’র বিষয়গুলো মুসলিম সমাজকে বেশ আকৃষ্ট করেছে। হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন নাটকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, ধর্মীয় শিক্ষক, মৌলবী, মাওলানা, পীর ফকির, কাজী, হাফেজসহ ধর্মীয় বহুবিধ চরিত্রের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
তিন প্রহর নাটকে আমরা দেখেছি, ডান পা ফেলে যাত্রা শুরু করা, কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ্ বলা, কোরআন ছুঁয়ে আশির্বাদ নেয়া, শোকরানা নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, বিপদে কালেমা পড়া, মিলাদ পড়া, এবং আল্লাহ্র দরবারে মোনাজাত ইত্যাদি ইসলামিক বিষয়গুলো সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
কোথাও কেউ নেই হুমায়ূন আহমেদের বহুল আলোচিত ও দর্শকনন্দিত একটি নাটক। এই নাটকে ঘটনা প্রসঙ্গে হাদিসের বাণী শোনা যায়। যেমন- মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ্ পছন্দ করেন না; অন্যদের নামাজ পড়ানোর তাগিদ দেয়া ইত্যাদি কাজগুলো মুসলিম পরিবারে হরহামেশাই করা হয়ে থাকে। তিনি দেখিয়েছেন, ইসলাম ধর্মের প্রসঙ্গ এলে সাহিত্য বা নাটক কখনো দুর্বল হয়ে যায় না; বরং তা আরও জীবনঘনিষ্ট আকর্ষনীয় হয়ে ওঠে। হুমায়ূন আহমেদ কখনোই কোনো ধর্মকে ছোট করে দেখেননি; তিনি সব ধর্মকেই সম্মান করেছেন। ধর্মের পাশাপাশি বিজ্ঞানকেও উপস্থাপন করেছেন অনন্যভাবে। তবে কখনোই বিজ্ঞানকে বড় করতে গিয়ে ধর্মকে ছোট করেননি। ফলে তার নাটকের দর্শকপ্রিয়তা সর্বাগ্রে। তিনি যুক্তি উপস্থান করতে গিয়েও কখনো ধর্মকে আঘাত করেননি। ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদকে আমরা ধার্মিক না বললেও তার নাটকে ধর্মকে যথাযথ মর্যাদায় ব্যবহার করতে দেখেছি। ধার্মিককে তিনি ধার্মিক, ভণ্ডকে তিনি ভণ্ডই বলেছেন। ভণ্ডের মুখোশ উন্মোচন করতে গিয়ে কখনো খাঁটি ধার্মিকের বিরাগভাজন হননি; যেমনÑ মাটি বাবা, জুতা বাবাসহ অসংখ্য কমেডি নাটক রচনা করেছেন।
আবার কোনো ধর্মকেই মাথায় তুলে নাচেননি। তিনি তার সৃষ্ট চরিত্রের বাস্তবিক দিকটি দর্শককে উপলব্ধি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। প্রেক্ষাপট অনুযায়ী চরিত্র নির্মাণ, যথপোযুক্ত সংলাপ এমনকী উপযুক্ত শব্দটিই নির্বাচন করেছেন। এখানেই হুমায়ূন আহমেদের নাটক রচনায় মূল সার্থকতা।
কমেডি হাস্যরস্যাত্মক নাটক রচনায়ও হুমায়ূন আহমেদ যথেষ্ট সফল; তার রচিত মাটি বাবা, জুতা বাবাসহ বহু কমেডি নাটকের মধ্যদিয়ে তিনি বাংলা নাট্যাঙ্গনে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন।
হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক নাটকসমূহের মধ্যে এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, আজ রবিবার, সবুজ সাথী ও সবুজ ছায়া, উড়ে যায় বকপক্ষী, জোছনার ফুল বাংলা নাটকজগতে অনন্য অবস্থান সৃষ্টি করেছে। মূলত একটি সমাজে সব শ্রেণির মানুষই কতটা গুরুত্বপূর্ণ এটা বোঝাতেই তিনি সব শ্রেণির চরিত্রকে সমানভাবে উপস্থাপন করেছেন চরিত্র চিত্রনের মধ্যদিয়ে, এরই সাথে সংলাপ প্রয়োগে। ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ খিস্টাব্দে জন্ম নেয়া এই মহান প্রতিভাধর লেখক বাংলা সাহিত্য ও নাট্যজগতকে অনন্য অবস্থানে উন্নীত কওে ১৯ জুলাই ২০১২খ্রি. মৃত্যুবরণ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী লেখকগণের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ট লেখকের স্থান অলংকৃত করা হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্য তথা নাট্যাঙ্গনে দীর্ঘকাল স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন