শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

গেট আছে ম্যান নেই

চট্টগ্রামে অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে মরণফাঁদ দুর্ঘটনায় বাড়ছে প্রাণহানি

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ৩১ জুলাই, ২০২২, ১২:০১ এএম

গেট আছে, ম্যান নেই। কোথাও আবার গেটম্যান কিংবা প্রতিবন্ধক বা ব্যারিকেড কিছুই নেই। অরক্ষিত এসব রেল ক্রসিং যেন এক একটি মরণ ফাঁদ। প্রতিনিয়ত এসব বৈধ-অবৈধ ক্রসিংয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা। বেঘোরে মৃত্যুর পরও টনক নড়ছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের।

কোথায়ও কোন দুর্ঘটনা ঘটলেই গ্রেফতার হন গেটম্যান। মামলা হয় দ্রুত গতিতে। তড়িঘড়ি গঠন করা হয় একাধিক তদন্ত কমিটি। তবে সুরক্ষিত হয় না রেল ক্রসিং। গেটম্যানদের কাজ তদারকির দায়িত্ব যাদের, তাদের কিছুই হয় না। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না।

ফলে অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ে মৃত্যুও থামে না। এমনই একটি অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে শুক্রবার প্রাণ গেছে ১১ কিশোর-তরুণের। গুরুতর আহত হয়েছেন আরো ছয় জন। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর খন্দকিয়া এলাকার একটি কোচিং সেন্টারের ছাত্র-শিক্ষক মিলে ১৭ জন একটি মাইক্রোবাসে মীরসরাইয়ের অন্যতম পর্যটন স্পট খৈয়াছড়া ঝরনায় বেড়াতে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে তাদের মাইক্রোবাসটি ওই ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে।
অরক্ষিত ক্রসিংয়ে মাইক্রোবাসটি উঠতে দ্রুতগতির আন্তঃনগর মহানগর প্রভাতী প্রচণ্ড ধাক্কা দেয় মাইক্রোটিকে। মাইক্রোটি ধুমড়ে মুচড়ে আটকে যায় ট্রেনের ইঞ্জিনের সাথে। ওই অবস্থায় যাত্রীতে ঠাসা মাইক্রোটিকে প্রায় দেড় কিলোমিটার নিয়ে যায় ট্রেন। বিধ্বস্ত মাইক্রোবাসে প্রাণ যায় ১১ জনের।

এই দুর্ঘটনার সময়ও মীরসরাই বড়তাকিয়া রেলক্রসিংয়ে ছিলেন না গেটম্যান সাদ্দাম হোসেন। গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিংটি অরক্ষিত রেখেই তিনি সেখান থেকে চলে যান। দুর্ঘটনার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যথারীতি তাকে আসামি করে মামলা হয়েছে। তাকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে। কিন্তু তাকে যারা তদারক করছিলেন, তাদের কারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়ার খবর গতকাল শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ক্রসিংয়ে গেটম্যান অথবা প্রতিবন্ধক থাকলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতো না। শুরুতে রেলের কর্মকর্তারা গেটম্যানের পক্ষ নেন। তারা জোর দিয়ে বলেন, প্রতিবন্ধক ঠেলে মাইক্রোটি জোর করে ক্রসিং অতিক্রম করেছে। এই কারণে দুর্ঘটনা। কিন্তু পরে ট্রেনের চালক, দুর্ঘটনায় আহতদের দুইজন এবং স্থানীয় বাসিন্দা ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের রেল কর্মকর্তাদের সুর পাল্টে যায়।

গ্রেফতার করা হয় সাদ্দামকে। রাতে মামলা হয় তাকে একমাত্র আসামি করে। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের একেকটি রেলক্রসিং যেনো একেকটি মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পূর্বাঞ্চল রেলে থাকা ৮৫০টি ক্রসিংয়ের বেশিরভাগই ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে সিগনাল বা ব্যারিকেড মানে না কেউই। রং সাইড দিয়ে অবাধে চলছে গাড়ি এবং পথচারী। কোথাও রেল লাইনের উপর বসছে বাজার। রেলের প্রকৌশল দফতরের তথ্য মতে, সারা দেশে অনুমোদিত রেলক্রসিং রয়েছে এক হাজার ৫৪০টি। এর বাইরে অবৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা হাজারেরও বেশি। যার মধ্যে পূর্বাঞ্চলেই ৮৫০টি। আর শুধুমাত্র চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের ৩০ কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে ৭০টি অবৈধ লেবেল ক্রসিং। গত ৫ বছরেই অবৈধ এসব রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেছে অন্তত ১২০ জন।

গত বছরের ৪ ডিসেম্বর নগরীর খুলশী থানার জাকির হোসেন রোডের ঝাউতলা রেলক্রসিংয়ে এক দুর্ঘটনায় তিনজন নিহত এবং আটজন আহত হন। ওই ঘটনা তদন্তেও দুটি কমিটি করে রেলওয়ে। তবে ওই কমিটির প্রতিবেদনের পর দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা আর জানা যায়নি। তখন বলা হয়েছিল সেখানে কর্তব্যরত গেটম্যানের অবহেলায় ঘটে দুর্ঘটনা। গেটম্যান একদিকের বার নামিয়ে দিলেও অন্যদিকে ছিল খোলা। আর খোলা পথে উল্টো দিক থেকে একটি মিনিবাস, একটি টেম্পু ও একটি অটোরিকশা উঠে পড়ে ক্রসিংয়ে। আর তখনই চলে আসে ট্রেনে। এর আগে মীরসরাই, সীতাকুণ্ডসহ বিভিন্ন এলাকায় রেলক্রসিংয়ে একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের পাশাপাশি রেললাইনের উপর হাটবাজারের কারণেও দুর্ঘটনা বাড়ছে। নগরীর ঝাউতলা রেলক্রসিংয়ে ট্রেন চলে যাওয়ার সাথে সাথেই টেবিল চেয়ার পেতে বসে পড়েন দোকানিরা। ক্রসিংয়ের দুই পাশে রেললাইনের উপর এমন শতাধিক দোকান বসলেও দেখার যেন কেউ নেই। একই অবস্থা নগরীর কদমতলী, ষোলশহর, রেলক্রসিংয়েও।

অনেক এলাকায় ট্রেন কাছাকাছি চলে আসলে সড়কের দু’পাশে ফেলা ব্যরিকেড টপকেই ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছে মানুষ। গেটম্যান এখানে যেনো অসহায়। ব্যস্ততম ক্রসিংগুলোতে লোকবল সঙ্কটও রয়েছে। জানা যায়, চট্টগ্রাম জেলায় কমপক্ষে ১৫০টি রেল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। যার অর্ধেক অবৈধ। খোলা থাকা, গাড়ি ও পথচারী পার হওয়াসহ নানা কারণে অহরহই ঘটছে দুর্ঘটনা। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কোনো স্থানে ক্রসিং নির্মাণ করলে সেখানে গেটকিপার নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে বা অনুমোদন না নিয়ে এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও রেললাইনের উপর লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করছে। সেখানে কোন গেটম্যান নেই। ফলে অরক্ষিত এসব ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন