শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৭ আগস্ট, ২০২২, ১২:০১ এএম

রেকর্ড পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে জ্বালানির মূল্য। এর আগে একবারে জ্বালানির এমন মূল্যবৃদ্ধি দেখেনি বাংলাদেশ। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় এরই মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে পরিবহন খাতে। তৈরি পোশাকখাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, এর ফলে কারখানার উৎপাদন খরচ বাড়বে, সময়মতো শিপমেন্ট দিতে পারবে না অনেক কারখানা। শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর দাবি তুলবেন। এতে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পোশাকখাতের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ, বিজিএপিএমইএসহ সংশ্লিষ্ট নেতাদের মতে, অর্থনীতির প্রতিটি সেক্টরেই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির এই প্রভাব পড়বে। দেশের বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়াকে অশনি সঙ্কেত হিসেবে দেখছেন উদ্যোক্তারা। অনেক কারখানাই বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে মত তাদের। তবে সবচেয়ে বেশি আশঙ্কায় রয়েছে রফতানি আয়ের ৮২ শতাংশ নেতৃত্ব দেয়া পোশাকখাত।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে দেশের তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে, বাংলাদেশে উল্টো বাড়ানো হয়েছে। এ অবস্থায় বাজারে টিকে থাকা আমাদের জন্য কষ্টকর হবে। পুরোনো অর্ডারগুলোতে প্রচুর লোকসান হবে। অনেক কারখানা নতুন অর্ডার নিতে পারবে না। ফলে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, এই মুহূর্তে কারখানায় গ্যাস সঙ্কট চলছে। সরকার নির্দেশিত লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুৎ থাকে না ৫-৬ ঘণ্টা। এ কারণে দিনে ৬ ঘণ্টার জন্য জেনারেটর ব্যবহার করতে হয়। জেনারেটরের ব্যবহার বাড়ায় জ্বালানি তেলও বেশি ব্যবহার করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পোশাক খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, আমাদের হাতে প্রচুর কাজের আদেশ (অর্ডার) রয়েছে। বড় অঙ্কের লোকসান দিয়ে এখন ওই (অর্ডারের) পণ্য উৎপাদন করতে হবে।

ফারুক হাসান বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় দেশে পরিবহন ভাড়া বাড়বে, ট্রাক ভাড়া বাড়বে, জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, বাড়বে মুদ্রাস্ফীতি। এসবের সঙ্গে শ্রমিকদের বেতনও বাড়াতে হবে। লোকসান থেকে বাঁচতে চাইলে অনেক কারখানা বন্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতি টিকে আছে ফরেইন এক্সচেঞ্জের (বৈদেশিক মুদ্রাবিনিময়) ওপর। গত বছর যে রফতানি আয় হয়েছে তার ৮২ শতাংশই এসেছে পোশাক খাতের মাধ্যমে। এ কারণে এখনও মুদ্রাস্ফীতি আমাদের সেভাবে বাড়েনি। কিন্তু নতুন করে জ্বালানির দাম বাড়ায় বিশ্ববাজারে আমাদের টিকে থাকা কষ্টকর হবে। দেশের স্বার্থে এই মুহূর্তে প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও তেলের দাম স্থিতিশীল রাখা উচিত ছিল।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় এ বছর যে পরিমাণ রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সেই টার্গেট অর্জন করা যাবে না। পুরোনো অর্ডারগুলোতে অনেক লোকসান হবে। নতুন করে উৎপাদনে যাওয়া যাবে না। ফলে রফতানিতে পিছিয়ে যাব। এ বছর যে পরিমাণ রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তেলের দাম বাড়ায় সেই টার্গেট অর্জন করা যাবে না উল্লেখ করে বিজিএমইএ সভাপাতি বলেন, পুরোনো অর্ডারগুলোতে অনেক লোকসান হবে। নতুন করে উৎপাদনে যাওয়া যাবে না। ফলে রফতানিতে আমরা পিছিয়ে পড়ব।

বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়বে। আমদানি পণ্যের খরচ বেড়ে যাবে, আমাদের পোশাক কারখানায় খরচ বেড়ে যাবে। পরিবহন খরচ আগের চেয়ে অনেক বাড়বে। এতে পণ্য উৎপাদন কমবে। সময় মতো মালামালও ডেলিভারিও দিতে পারবে না কারখানাগুলো। এসব কারণে অনেক কারখানাই বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা এ পোশাক শিল্প উদ্যোক্তার।

এ বিষয়ে পোশাক খাতের তরুণ উদ্যোক্তা মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, আমাদের সবকিছুই ঊর্ধ্বমুখী। বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের ফলে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। এখন আবার জ্বালানির দাম বাড়ায় বাজার প্রতিযোগিতায় তার প্রভাব পড়বেই, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি বলেন, এখন যে অর্ডারগুলো আছে, এগুলো দু-তিন মাস আগের অর্ডার নেয়া। এগুলোর খরচ তো বেশি পড়বে। নতুন করে যে অর্ডার আসবে তার উৎপাদন ব্যয়ও বাড়বে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় নিটওয়ার মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, পোশাক খাত ‘অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর’। এখন আর কিছু বলার নেই। এভাবে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি কোনোভাবেই কাম্য নয়। তিনি বলেন, সরকার অবশ্যই বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি হলে সেটা সমন্বয় করবে। এর সঙ্গে কোনো দ্বিমত নেই। তাই বলে কী এক সঙ্গে ৪৪-৫১ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি? এটা অস্বাভাবিক, এটা হতে পারে না।

এর আগেও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কথা বলে সরকার বাড়িয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিন্তু বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমানোর পর বাংলাদেশে কমেছে বলে আমার জানা নেই। এখানে আমাদের প্রস্তাব প্রতি ছয় মাসে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা উচিত।

মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আইএমএফের চাপে পড়ে সরকার যদি এটি করে থাকে তবে এক সঙ্গে বৃদ্ধি না করে সরকার তাদেরকে বলতে পারতো, পর্যায়ক্রমে করা হবে। আরেকটা হতে পারতো অকটেনের দাম কিছুটা বাড়িয়ে ডিজেলের দাম আপাতত না বাড়ানো। কারণ এই বছরেই ডিজেলের দাম একবার বাড়ানো হয়েছিল। মূল্যবৃদ্ধির এই প্রভাব পড়বে সাধারণ জনগণের উপর। এ মুহূর্তে এভাবে দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি।

বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি বলেন, কেউ কেউ বলতে চাইছেন জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে রফতানি খাতের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি বলছি, এটার সঙ্গে সম্পর্ক আছে। এটা কীভাবে? প্রথমত পণ্য আমদানি-রফতানির জন্য যে পরিবহন ব্যবহার করি, সেই পরিবহন কস্ট আজ থেকে বেড়ে গেছে। এমনিতেই তেলের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে পরিবহন খরচ বাড়ানো হয় ২০ শতাংশ। এখন ৪৪ শতাংশ বেড়েছে। এবার যে কত শতাংশ বাড়াবে তা সহজে অনুমান করা যায়।

শুধু তেলের দামের মধ্যেই পরিবহন খরচ সীমাবদ্ধ নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সবকিছু মিলে বাড়াতে পারে। কিন্তু তারা তেলের দামের অজুহাতে এই মূল্যবৃদ্ধি করে। স্বাভাবিকভাবে যাতায়াতের ভাড়া বাড়িয়ে দেবে। এছাড়া যাতায়াত ভাড়া বাড়লে আমদানি-রফতানির উপর প্রভাব পড়বে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দু’দিন পর বিদ্যুতের মূল্য আবারও বৃদ্ধির জন্য যৌক্তিকতা আসবে। আর বিদ্যুতের মূল্য আবারও বাড়ানো হলে সরাসরি আমাদের উপর আসবে। তখন আরেকটা ইফেক্ট পড়বে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সেসরিজ এন্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সাবেক সভাপতি আব্দুল কাদের খান ইনকিলাবকে বলেন, দীর্ঘদিন থেকে কারখানায় গ্যাস সঙ্কট। সরকারের বিদ্যু সাশ্রয় নীতিতে এমনিতেই কারখানায় ৫-৬ ঘন্টা জেনারেটর চালাতে হয়। পণ্য পরিবহনে ট্রাকভাড়া ডাবল হয়ে গেছে। যাতায়াত ভাড়া বাড়ায় আমদানি-রফতানির উপর প্রভাব পড়বে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। যা পোশাক খাত সংশ্লিষ্টদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, এক দফায় এতো বাড়ানো ঠিক হয়নি। একসঙ্গে না বাড়িয়ে ক্রমান্বয়ে বাড়ালে ভালো হতো। তাই দ্রুত দামের সমন্বয় করার দাবি জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার রাত ১২টার পর জ্বালানি তেলের নতুন দাম কার্যকর করেছে সরকার। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রোলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে।#

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন