মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

মহানবী (স.) -এর মহাজীবন

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ১১ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রাক-ইসলামি যুগে যখন চরম উচ্ছৃঙ্খলতা, পাপাচার, দুরাচার, ব্যভিচার, মিথ্যা, হত্যা, লুণ্ঠন, মদ্যপান, জুয়ায় ভরপুর ছিল, অন্যায়-অপরাধ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, নৈরাশ্য আর হাহাকার বিরাজ করছিল, ঠিক তখন মানবতার মুক্তির দিশারী সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও সর্বশেষ নবী প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.) বিশ্ববাসীর হেদায়েতের জন্য আবির্ভূত হলেন। রাসুল (সা.) হলেন বিশ্বমানবতার জন্য আল্লাহর এক অনন্য রহমত স্বরুপ প্রেরিত। মহানবী (সা.) ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। ক্ষমা, উদারতা, ধৈর্য, সহনশীলতা, সততা ও সত্যবাদিতা, দয়া, দানে, কাজে-কর্মে, আচার-আচরণে, মানবতা ও মহত্ব সব গুণের অধিকারী। তিনি ছিলেন সর্বকালের সব মানুষের জন্য উত্তম আদর্শ। এ জন্য আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রাসুলের জীবনে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে।’ (সুরা আহজাব : ২১)।
জন্ম ও পরিচয়
মহানবী (সা.) ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২০ এপ্রিল (রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ) সোমবার মক্কার বিখ্যাত কোরাইশ গোত্রের বনী হাশেম বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবদুল্লাহ, মায়ের নাম আমিনা। তার দাদার নাম ছিল আবদুল মুত্তালিব। জন্মের পর তার নাম রাখা হয় মুহাম্মদ এবং আহমদ। তার জন্মের আগে পিতা আবদুল্লাহ মারা যান। ছয় বছর বয়সে মা আমিনাকে হারান। আট বছর বয়সে তার দাদা মৃত্যুবরণ করেন।
দুগ্ধপান
সর্বপ্রথম তাকে তার মা দুগ্ধ পান করান। এরপর আবু লাহাবের বাদী সুওয়াইবা তাকে দুগ্ধ পান করান। অতঃপর ধাত্রীর সন্ধান করতে থাকেন। হাওয়াজিন গোত্রের বনী সাদের হালিমা সাদিয়া এ বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী হন। হালিমার ঘরে এলাহি বরকতের জোয়ার শুরু হলো। দু’বছর দুগ্ধপানের পর বিবি হালিমা শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে তার মায়ের কাছে হাজির হন। আকাঙ্খা ব্যক্ত করেন, শিশুকে আরও কিছুদিনের জন্য তার কাছে যেন থাকতে দেওয়া হয়। এদিকে মক্কায় তখন মহামারী চলছিল। উভয় দিক চিন্তা করে বিবি আমেনা তার শিশুকে হালিমার কাছে ফিরিয়ে দেন। এভাবে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত মহানবী (সা.) বনী সাদে লালিত পালিত হন। সেখানে তিনি তার দুধ ভাইদের সঙ্গে জঙ্গলে ছাগল চরাতেন। (বোখারি : ১/১৭২)।
বেড়ে ওঠা
পাঁচ বছর বয়সে তিনি মা আমিনার কোলে ফিরে আসেন। আদর-সোহাগে মা তাকে লালন পালন করতে থাকেন। কিন্তু মায়ের আদর তার কপালে বেশিদিন স্থায়ী হলো না। তার ছয় বছর বয়সে মাও ইন্তেকাল করেন। এবার তিনি পিতামাতা দুজনকে হারিয়ে এতিম হয়ে যান। এরপর তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিবের আদর-স্নেহে লালিত-পালিত হতে থাকেন। কিন্তু আট বছর বয়সের সময় তার দাদাও মারা যান। এরপর তিনি চাচা আবু তালিবের আশ্রয়ে বড় হতে থাকেন। আবু তালিবের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। কিশোর মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন কর্মঠ। চাচার অস্বচ্ছল পরিবারের নানাভাবে সাহায্য করতেন। বাড়তি আয়ের জন্য রাখালদের সঙ্গে ছাগল, মেষ চরাতেন। রাখাল বালকের জন্য তিনি ছিলেন আদর্শ। তাদের সঙ্গে তিনি সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বজায় রাখতেন। রাখালদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হলে তিনি বিচারকের ভূমিকা পালন করতেন। তিনি চাচার ব্যবসা-বাণিজ্যেও সাহায্য করতেন। একবার চাচার সঙ্গে ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়ায় গেলেন। এ সময় বাহিরা নামক এক পাদ্রীর সঙ্গে তার দেখা হয়। বাহিরা তাকে অসাধারণ বালক বলে মন্তব্য করেন। শেষ নবী বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তিনি আবু তালেবকে তার ব্যাপারে সাবধান করেন। কারণ শত্রুরা তার অনিষ্ট করতে পারে।
হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠা
সিরিয়া থেকে ফেরার পর বালক মুহাম্মদ (সা.) ফিজার যুদ্ধ বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করে আঁতকে ওঠেন। উকাজের মেলায় জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে এ যুদ্ধ হয়েছিল। কায়েস গোত্র অন্যায়ভাবে এ যুদ্ধ কোরাইশদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। এ জন্য একে হারবুল ফিজার বা অন্যায় সমর বলা হয়। এ যুদ্ধ চলে একটানা পাঁচ বছর। অনেক মানুষ আহত, নিহত হলো। যুদ্ধের বিভীষিকাময় করুণ দৃশ্য দেখে ও আহতদের আর্তনাদে তার কোমল হৃদয় কেঁপে উঠল। তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। তিনি শান্তিকামী উৎসাহী যুবকদের নিয়ে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে একটি সংগঠন করেন। এ সংঘের উদ্দেশ্য ছিল, আর্তের সেবা করা, অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা, অত্যাচারিতকে সাহায্য করা, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং গোত্রে গোত্রে সম্প্রীতি বজায় রাখা ইত্যাদি। তিনি তার প্রচেষ্টায় অনেক সফলতা লাভ করেন। এরই মধ্যে সত্যবাদী, বিচক্ষণ, আমানতদার, পরোপকারী, শান্তিকামী যুবক হিসেবে মুহাম্মদ (সা.)-এর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আপন-পর সবাই তাকে সত্যবাদী ও আল আমিন উপাধিতে ভূষিত করল। তার কাছে ধন-সম্পদ আমানত রাখতে লাগল।
হাজরে আসওয়াদ স্থাপন
বহুদিন আগের নির্মিত পুরনো কাবাঘর সংস্কারের কাজ হাতে নিল কোরাইশরা। যথারীতি কাবাঘর সংস্কার করল তারা। কিন্তু পবিত্র হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর স্থাপন নিয়ে বিবাদ লেগে গেল। প্রত্যেক গোত্রই এ পাথর কাবাঘরের দেয়ালে স্থাপনের সম্মান নিতে চাইল। যুদ্ধের সাজ সাজ রব পড়ে গেল। অবশেষে প্রবীণতম গোত্র প্রধান উমাইয়া বিন মুগিরার প্রস্তাব অনুসারে সিদ্ধান্ত হলো, আগামীকাল যে ব্যক্তি সবার আগে কাবাঘরে আসবেন, তার ওপর বিবাদ মীমাংসা অর্পিত হবে। তার সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নেবে। মহানবী (সা.) কাবাঘরে সবার আগে প্রবেশ করেন। সবাই আনন্দে চিৎকার করে বলল, ‘আল আমিন আসছেন। আমরা তার প্রতি সন্তুষ্ট। সঠিক মীমাংসাই হবে।’ রাসুল (সা.) একখানা বিছানার চাদর বিছিয়ে দিলেন। তারপর চাদরে নিজ হাতে পাথরখানা রাখলেন। গোত্র সওদাগরদের ডেকে চাদর ধরতে বললেন। তারা ধরে তা যথাস্থানে বহন করে নিয়ে গেল। রাসুল (সা.) নিজের হাতে পাথরখানা কাবাঘরের দেয়ালে বসিয়ে দিলেন। একটি অনিবার্য যুদ্ধ থেকে সবাই বেঁচে গেল। পাথর তোলার সম্মান পেয়ে সবাই খুশি হলো।
খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসার দায়িত্ব গ্রহণ ও বিয়ে
তখনকার দিনে আরবে একজন বিখ্যাত ধনী ও বিদূষী নারী ছিলেন। নাম তার খাদিজা। তিনি তার বিশাল বাণিজ্য দেখাশোনা করার জন্য একজন বিশ্বাসী বিচক্ষণ লোক খুঁজছিলেন। মহানবী (সা.)-এর উত্তম চরিত্রের সুনাম শুনে তিনি তার ওপর ব্যবসার দায়িত্ব অর্পণ করেন। রাসুল (সা.) খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসার দায়িত্ব নিয়ে সিরিয়া যান। তার সঙ্গে খাদিজা (রা.)-এর বিশ্বস্ত কর্মচারী মাইসারাও ছিলেন। ব্যবসায় আশাতীত লাভ করে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন। মাইসারার কাছে মুহাম্মদ (সা.)-এর সততা, বিচক্ষণতা ও কর্মদক্ষতার কথা শুনে খাদিজা (রা.) অত্যন্ত মুগ্ধ হন। তিনি তার সঙ্গে নিজের বিয়ের প্রস্তাব দেন। মুহাম্মদ (সা.)-এর চাচা আবু তালেব রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে খাদিজার বিয়ের সব ব্যবস্থা করে দেন। শুভ বিবাহ সম্পন্ন হলো। তখন মুহাম্মদ (সা.)-এর বয়স ২৫ বছর, আর খাদিজার বয়স ৪০ বছর। তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের হয়েছিল। খাদিজা (রা.) বেঁচে থাকতে তিনি অন্য কোনো বিয়ে করেননি। বিয়ের পরে খাদিজার আন্তরিকতায় তিনি প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হন। কিন্তু তিনি এ ধন-সম্পদ ভোগ-বিলাসে, আরাম-আয়েশে ব্যয় না করে গরিব-দুঃখী ও আর্ত-পীড়িতদের সেবায় অকাতরে ব্যয় করেন।
নবুওয়ত লাভ
মহানবী (সা.) শিশু বয়স থেকেই মানুষের মুক্তি ও শান্তির জন্য ভাবতেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার এ ভাবনা আরও গভীর হয়। মূর্তিপূজা, কুসংস্কার এবং নানা দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত মানুষের মুক্তির জন্য ছিল তার সব ভাবনা। মানুষ তার স্রষ্টাকে ভুলে যাবে। হাতে বানানো মূর্তির সামনে মাথা নত করবে, এটা হয় না। এসব চিন্তা-ভাবনায় বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে হেরা পর্বতের গুহায় নির্জনে ধ্যান করতেন। কখনও কখনও একাধারে তিনদিন সেখানে ধ্যানমগ্ন থাকতেন। এভাবে দীর্ঘদিন ধ্যানমগ্ন থাকার পর অবশেষে ৪০ বছর বয়সে রমজান মাসের কদরের রাতে আঁধার গুহা আলোকিত হয়ে উঠল। জন্মের ৪১তম বছরে ২৭ রজব (হিজরতের ১৩ বছর আগে) মোতাবেক ৬১০ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে জাগ্রত ও চৈতন্য অবস্থায় এ ঘটনা ঘটে। জিবরাইল (আ.) আল্লাহর মহান বাণী নিয়ে এলেন। মহানবী (সা.)-কে বললেন, ‘পড়ুন।’ তিনি মহানবী (সা.)-কে সুরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত তেলাওয়াত করে শোনান। নবীজি (সা.) ঘরে ফিরে খাদিজার কাছে সব ঘটনা প্রকাশ করলেন। বললেন, ‘আমাকে বস্ত্রাবৃত করো। আমি আমার জীবনের আশঙ্কা করছি।’ তখন খাদিজা নবীজিকে সান্ত¦না দিয়ে বললেন, ‘না, কখনও না। আল্লাহর কসম! তিনি কখনও আপনার অনিষ্ট করবেন না। কারণ, আপনি আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন। আর্তপীড়িত ও দুঃস্থদের সাহায্য করেন। মেহমানদের সেবা যত্ন করেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাহায্য করেন। খাদিজার এ উক্তি দ্বারা প্রমাণিত হয়, নবুওয়ত লাভের আগে মহানবী (সা.) নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে মানবিক গুণাবলির অনুশীলন করতেন। মানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকতেন। বর্বর আরবদের মধ্যে থেকেও তিনি নির্মল ও সুন্দর জীবনযাপন করতেন। তিনি ছিলেন সমগ্র মানবজাতির জন্য আদর্শ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন